পুষ্টিবিদ তামান্না রুবিন
অবিসিটি বা অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণের মূলমন্ত্র খাদ্য নিয়ন্ত্রণ। ওজন একটু বৃদ্ধি পেলেই নিজের বদ অভ্যাসগুলো ত্যাগ করার মানসিক প্রস্তুতি নিন, নিজের শরীরকে ভালোভাবে জানুন। কোন অবস্থাকে আমরা ‘ওজনাধিক্য’ বা ‘অবিসিটি’ কিংবা স্থূলতা বলব। স্থূলতা নির্ণয়ের একাধিক পদ্ধতি রয়েছে। কাম্য ওজন অপেক্ষা শতকরা ১০ ভাগ বেশি হলে সামান্য মোটা, কিন্তু ওজন যদি শতকরা ২০ ভাগের বেশি হয় তবে তাকে রীতিমতো মোটা বা স্থূল বলে গণ্য করতে হবে। এ ছাড়া পুরুষ-নারীর কোমর ও নিতম্বের মাপের অনুপাত দিয়েও ওজনাধিক্য নির্ণয় করা যায়, এক্ষেত্রে আদর্শ অনুপাত, পুরুষের >১.০ এবং নারীর >০.৯। তবে স্থূলতা নির্ণয়ের সর্বাধিক ব্যবহূত পদ্ধতি ‘বিএমআই’ পদ্ধতি। কারো বিএমআই যদি >২৪.৯৯ এর বেশি হয়, তবে সে স্থূল আর <১৮.৫০ এর কম হলে তবে সে ক্ষীণকায়, শরীরের এই দুই অবস্থাই ঝুঁকিপূর্ণ।
বিভিন্ন কারণে দেহের ওজন বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে প্রধান কারণ চাহিদার অতিরিক্ত ক্যালরি মূল্যের খাদ্যগ্রহণ। এ ছাড়াও জীবনযাত্রায় অভ্যাস পরিবর্তন, পারিবারিক ধারা, মানসিক সমস্যা, অপর্যাপ্ত পরিশ্রম, অনিয়ন্ত্রিত ঘুম, কিছু ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া, হরমোনের ইমব্যালান্স এবং বংশগত কারণ ওজনাধিক্যকে অনেকাংশে প্রভাবিত করে। দেহের এই ওজন বৃদ্ধির সঙ্গে নানাবিধ অসুখ-বিসুখের একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে। টাইপ২ ডায়াবেটিস, গল ব্লাডারের ডিজিজ, হাইপারটেনশন, ডিসলিপিডেমিয়া, ইনসুলিন রেজিসটেন্স, এথেরোস্ক্লেরোসিস, করোনারি হার্ট ডিজিজ, মেটাবলিক সিনড্রোম, স্ট্রোক, গাউট (গেঁটেবাত), অস্টিও আর্থ্রাইটিস, ক্যানসার, রিপ্রোডাকটিভ অ্যাবনরমালিটিস, স্লিপ এপনিয়া, হার্নিয়া, অ্যাজমা, স্কিন কমপ্লিকেশনসহ আরো নানাবিধ রোগের অন্যতম কারণ দেহের অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি। অবিসিটি বা স্থূলতা বর্তমানে সারা বিশ্বে একটা প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেহের বাড়তি ওজন নিয়ে একবারের জন্য দুশ্চিন্তা করেননি, বোধহয় এমন মানুষ পাওয়া বেশ কঠিন। ‘বাড়তি ওজন’ শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্য নষ্ট করে না, মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিও। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়, ‘ওজনাধিক্য’ বা ‘অবিসিটি’ দেহের স্বাভাবিক অবস্থা নয়, একটি রোগ।
ওজন নিয়ন্ত্রণ
প্রত্যেক মানুষের ক্যালরি চাহিদা ভিন্ন। এটা নির্ভর করে তার বয়স, উচ্চতা, ওজন ও দৈহিক শ্রমের পরিমাণের ওপর। ওজন নিয়ন্ত্রণে অনেকে যে মারাত্মক ভুলগুলো করে থাকেন তার মধ্যে দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকা, কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার একেবারে বাদ দেওয়া, রাতের খাবার একেবারেই না খাওয়া ইত্যাদি। এটা মারাত্মক ভুল। ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে আপনার বর্তমান ওজনের ওপর নির্ভর করে ব্যালান্সড ডায়েটের মাধ্যমে, না খেয়ে নয়। দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকলে আপনার শরীরের মেটাবলিক রেট অনেক স্লো হয়ে যাবে, আর এক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে আপনি যে খাবারটিই খাবেন তা আপনার শরীরে ধরে রাখবে, সুতরাং দীর্ঘসময় না খেয়ে থাকাও ওজন বাড়ার একটি অন্যতম কারণ।
কোন খাবার কতটুকু খাবেন
ওজন একটু বৃদ্ধি পেলেই ঘনীভূত ক্যালরিবহুল খাদ্যগুলো বাদ দিয়ে বয়স-ওজন-উচ্চতা অনুসারে সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক ও সঠিক পদ্ধতিতে খাদ্য তালিকা প্রস্তুত করে তা মেনে চলুন। আর তাই ওজন কমাতে বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হোন। আপনার দেহের ওজন যেমন রাতারাতি বৃদ্ধি পায়নি, সুতরাং তা নিয়ন্ত্রণে কিছুটা সময় দিন, নিজের এবং বিশেষজ্ঞের প্রতি ভরসা রাখুন।
- ক্যালরি নির্ধারণ করা। ক্যালরি নির্ভর করবে প্রত্যেক ব্যক্তির তার নিজস্ব ওজন, উচ্চতা, বয়স, দৈহিক শ্রমের পরিমাণ এবং শারীরিক অবস্থা ইত্যাদির ওপর। সুতরাং সঠিক ক্যালরি নিরূপণ করে সেই খাদ্য তালিকায় খাদ্যের প্রত্যেকটি বিভাগ থেকে খাদ্য নির্বাচন করতে হবে যেমন- কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, বিভিন্ন ভিটামিন এবং মিনারেলস জাতীয় খাবার।
- সারাদিনের খাদ্য তালিকাটিকে ছয় বেলায় ভাগ করে নিতে হবে। এক্ষেত্রে কার্বোহাইড্রেট থেকে ৬-৭ সার্ভিং, প্রোটিন জাতীয় খাদ্য থেকে ২ সার্ভিং, সবজি থেকে ৫ সার্ভিং, ফল থেকে ২ সার্ভিং, দুধ ও দুধজাতীয় খাদ্য থেকে ১ সার্ভিং, রান্নার তেল ৩ চা চামচ (মনো আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড), বাদাম ১.৫ আউন্স।
- ওজন নিয়ন্ত্রণে সকালবেলা পরোটা/ভাতের পরিবর্তে লাল আটার রুটি/ওট নেওয়া যেতে পারে। ডিম পোচ বা ওমলেটের পরিবর্তে ডিম সিদ্ধ হতে পারে এবং মিক্সড সবজি (রঙিন সবজি ৩-৪ রকমের) রাখা যেতে পারে। রান্নায় তেলের ব্যবহার কমাতে হবে। এক্ষেত্রে রান্নার সময় মাছটাকে না ভেজে রান্না করা যেতে পারে।
— কনসালট্যান্ট (পথ্য ও পুষ্টি)
আল-রাজী হাসপাতাল, ফার্মগেট, ঢাকা।