মুক্তমত

ঐতিহ্যবাহী পর্যটনকেন্দ্রগুলোর সুরক্ষা প্রয়োজন

  • প্রকাশিত ১ নভেম্বর, ২০২০

রুকাইয়া আক্তার

 

অনেক আগে থেকে পর্যটনশিল্পের যাত্রা শুরু হলেও একবিংশ শতাব্দীতেও এর কোনো উন্নত যাত্রার আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের দেশে অনেকগুলো পর্যটন স্থান রয়েছে এবং বছরের পর বছর ধরে দেশিসহ বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করে যাচ্ছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে এসব আকর্ষণীয় স্থান বিলীন হয়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন, মানুষের বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড, পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পর্যটন স্থানগুলোতে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশ তার অপার সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলছে। কুয়াকাটা, কক্সবাজার ও সুন্দরবনের মতো বিখ্যাত দর্শনীয় স্থানগুলো এখন সৌন্দর্য বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

পটুয়াখালী জেলার অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারিণী যেটি ‘সমুদ্রকন্যা’ নামে পরিচিত, কুয়াকাটা এখন তার সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলছে। পৃথিবীর একমাত্র স্থান যেখানে একই স্থানে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দৃশ্যমান হয়। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন নেতিবাচক আভাস দেখা দিচ্ছে। এই বছরের বর্ষায় অস্বাভাবিক জোয়ার ও ঢেউয়ের তাণ্ডবে গাছপালাসহ বিভিন্ন স্থাপনা বিলীন হয়ে গেছে। জোয়ারের পানিতে তীরবর্তী অঞ্চলগুলো ডুবে গেছে। সমুদ্রের ঢেউয়ের তোড়ে অব্যাহত ভাঙনের ফলে প্রতিনিয়ত বিলীন হয়ে যাচ্ছে পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটা সৈকতের সৌন্দর্য। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত দশ বছরে কুয়াকাটা সৈকত লাগোয়া হাজার হাজার নারিকেল গাছ, ঝাউবনসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা ও একাধিক স্থাপনা সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। জোয়ারের সময় সৈকতের বেলাভূমিতে এখন আর ওয়াকিং জোন থাকে না। প্রতিনিয়ত বালু ক্ষয় হতে থাকলে সৈকত তার সৌন্দর্য হারাবে। স্থানীয় লোকজনসহ বিভিন্ন পর্যটক বলেছেন, সৈকতে এখন সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত অস্পষ্ট দেখা যায় এবং আস্তে আস্তে এটি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বালু ক্ষয় রোধের জন্য স্থায়ীভাবে সরকার কর্তৃক কোনো প্রকল্প নেওয়া হয়নি। এটি যদি অবহেলার দৃষ্টিতে রাখা হয় তাহলে সৈকতের সৌন্দর্য হারাবে।

কক্সবাজার পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, যেটি বছরের পর বছর ধরে পর্যটকদের আকর্ষণ করে যাচ্ছে। দেশিসহ বিদেশি পর্যটকরা এখানে বেড়াতে আসেন। তবে বর্তমানে কক্সবাজার রোহিঙ্গাদের আবাসস্থল হিসেবে গড়ে উঠেছে এবং পর্যটনশিল্প হুমকির মুখে পড়ছে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার থেকে পালিয়ে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তারা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের প্রায় ১০ হাজার একর বনভূমিতে অস্থায়ীভাবে বসবাস করছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে অনেক রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে কক্সবাজারে অবস্থান করছে এবং তারা স্থায়ীভাবে বসতি তৈরি করছে। তারা জীবিকা উপার্জনের জন্য রিকশা চালিয়ে আয় করছে। তবে পর্যটকদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া নেওয়া, স্থানীয় হিসেবে পরিচয় দেওয়া, ছিনতাই করা ইত্যাদি অপকর্মে জড়িয়ে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ আছে। ইয়াবা চালান, মজুত ও লেনদেনের নিরাপদ ঘাঁটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। তারা স্থানীয়দের অতিষ্ঠ করে তুলছে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যেও হাত লাগিয়েছে। এরকম পরিস্থিতি চলতে থাকলে পর্যটকরা মুখ ফিরিয়ে নেবে আর পর্যটনশিল্প হুমকির মুখে পড়বে।

দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম জলাভূমি এবং পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, পৃথিবীর একমাত্র মিঠা পানির ও সবচেয়ে বড় বাদাবন ‘সুন্দরবন’ তার বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে। লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় সুন্দরবনের অনন্য প্রজাতির উদ্ভিদ মারা যাচ্ছে। হারিয়ে ফেলছে তার নিজস্ব সৌন্দর্য। সুন্দরবন নামটি যে গাছের ওপর ভিত্তি করে নামকরণ করা হয়েছে ‘সুন্দরী’ গাছ কালো বর্ণ ধারণ করে মারা যাচ্ছে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার লবণাক্ত পানি পান করায় মারাত্মক লিভার সিরোসিস রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এবং মারা যাচ্ছে। সুন্দরবনের পুরো ইকোসিস্টেমের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা লবণাক্ততা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে ফারাক্কা বাঁধকে দায়ী করেন। ফারাক্কা বাঁধের ফলে মিঠাপানির অবাধ প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। উজানের মিঠাপানির সঙ্গে এখন সুন্দরবনের নদীগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই। বর্ষা মৌসুমে ‘জলাঙ্গী’ আর ‘হাড়িভাঙ্গা’ নদী দিয়ে মিঠাপানি প্রবেশ করলেও তা এখন শুকিয়ে যাচ্ছে। সুন্দরবন হারিয়ে ফেলছে তার নিজস্ব সৌন্দর্য।

এছাড়া সুন্দরবনের নিকটে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করার সিদ্ধান্ত সরকারের চরম অজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছে। কারণ সুন্দরবন বার বার ঘূর্ণিঝড় থেকে উপকূলীয় অঞ্চলসহ পুরো দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে। প্রতি বছর ২-৩টি ঘূর্ণিঝড়ের সম্মুখীন হয় এবং ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়। তাকে রক্ষণাবেক্ষণ না করে এবং ধ্বংসের হাত থেকে ফিরিয়ে আনার পরিবর্তে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিচ্ছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনার মাধ্যমে। এসব স্থাপনার প্রধান জ্বালানি হচ্ছে কয়লা যা পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। পরিবেশবিদদের মতে, এরকম স্থাপনা কোনো অঞ্চল থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে স্থাপন করতে হয়। এই বিধি লঙ্ঘন করে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে এই স্থাপনা গড়ে তুলছে যা সুন্দরবন অঞ্চলের জন্য মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হবে।

এই পর্যটন স্থানগুলো তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ফিরে পাওয়ার জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। সুন্দরবনকে বাঁচাতে হলে মিঠাপানির প্রবাহ বাড়াতে হবে। এজন্য ফারাক্কা বাঁধ উচ্ছেদ করার জন্য সরকারকে ভারতের সাথে সন্ধি করতে হবে। এছাড়া গড়াই, মধুমতি, কুমার, কপোতাক্ষ, ভৈরব, চিত্রা, নবগঙ্গার মতো নদী খনন করে ভাটিতে মিঠাপানির প্রবাহ বাড়াতে হবে। কক্সবাজারকে বাঁচাতে যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন করাতে হবে। কুয়াকাটার সৌন্দর্য রক্ষার্থে বালুক্ষয় রোধে স্থায়ী প্রকল্প নিতে হবে এবং দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। সরকার কর্তৃক পর্যটন স্থানগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে এবং পর্যটন শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বেসরকারিভাবে পর্যটনশিল্পে প্রণোদনা আসলেও সরকারিভাবে কোনো প্রণোদনা দেওয়া হয় না বলে দাবি তুলেছে ট্যুরিজম কমিটি। সরকারকে এ ব্যাপারে অবশ্যই সচেষ্ট থাকতে।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads