ইমরান হোসেন
সভ্যতার শুরু থেকেই বিজ্ঞানীরা মানবতার কল্যাণে আবিষ্কার করে আসছেন বিভিন্ন ড্রাগস বা প্রতিষেধক, যা প্রতিরোধ করেছে ভয়াবহ সব রোগ। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় কোনো কোনো ড্রাগস আবার হয়ে উঠেছে মানব জাতির জন্য অভিশাপস্বরূপ। তেমনি অভিশপ্ত একটি ড্রাগস হলো এলএসডি বা লাইসার্জিক এসিড ডাই-ইথালামাইড। এটি মূলত এক ধরনের হ্যালোসিনেজিক ড্রাগ, যা গন্ধহীন এবং কিছুটা তেতো স্বাদযুক্ত। এরগট নামক এক ধরনের প্যারাসাইটিক ফাঙ্গাস দমনের কার্যকর ওষুধ হিসেবে সুইস বিজ্ঞানী আলবার্ট হফম্যান সর্বপ্রথম ১৯৩৮ সালে লাইসার্জিক এসিড থেকে এলএসডি আবিষ্কার করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি কম রক্তচাপ, মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি এবং শ্বাস-প্রশ্বাস উন্নত করার ওষুধ তৈরির জন্য লাইসার্জিক এসিড নিয়ে কাজ করেছিলেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে এলএসডি বিশ্বের সবচেয়ে দামি মাদক হিসেবে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ফলে অধিকাংশ দেশে এটি ক্রয় এবং অনুমোদন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত অপব্যবহারের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭০ সালে এলএসডিকে ‘দ্য আনকন্ট্রোল্ড সাবস্টেন্সেস অ্যাক্ট’-এর আওতাভুক্ত করে। পরে ১৯৭১ সালে জাতিসংঘের এক কনভেনশনে একে নিষিদ্ধের প্রস্তাব করা হয়। ফলে বেশিরভাগ দেশেই এলএসডি এখন এক নিষিদ্ধ রাসায়নিক বা মাদক। যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অব মেডিসিনের মতে, এলএসডি মূলত পাউডার, তরল, ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল আকারে পাওয়া যায়। মূলত সিরিঞ্জ কিংবা জিহ্বার নিচের অংশ ব্যবহূত হয় এটি গ্রহণ করার ক্ষেত্রে। এছাড়া এই মাদক প্রায়ই বল্টার কাগজ, চিনির কিউব বা জিলেটিনে বিক্রি করা হয়।
বর্তমানে মাদকের সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকা ভয়াবহ এই ড্রাগ সেবনে মানুষ উন্মাদে পরিণত হতে পারে মুহূর্তের মধ্যেই। সেবনকারী হ্যালোসিনেশনের ফলে বিপত্তিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে। এটি সেবনের ফলে সেবনকারী একটি কল্পনার জগতে বিচরণ করতে থাকে। যেমন, কখনো কখনো এলএসডি সেবনকারী ব্যক্তি এমনসব অদ্ভুত জিনিস দেখতে পায়, যার অস্তিত্ব পৃথিবীতে নেই অর্থাৎ তাদের মনগড়া বিষয়বস্তু নিজের চারদিকে কল্পনা করে। এছাড়া অবাস্তব চিন্তা, অযৌক্তিক ভয়, অন্যের ক্ষতি করার প্রবণতাসহ বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ করা যায় সেবনকারীদের মধ্যে। নেতিবাচক এই প্রভাবগুলো ‘ব্যাড ট্রিপ’ নামে পরিচিত। এলএসডি সেবনের পর সেবনকারী নিজেকে প্রচণ্ড শক্তিশালী ভাবতে শুরু করে, যা পরবর্তীতে আত্মঘাতী কাজের প্রতি প্রণোদনা জোগায়। গত ১৫ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাফিজুরের মৃত্যুরহস্য খুলতে গিয়ে সন্ধান পাওয়া যায় চাঞ্চল্যকর বিভিন্ন তথ্যের। তদন্তে জানা যায়, এলএসডি সেবনের ফলে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়ে নিজের গলায় নিজেই দা দিয়ে আঘাত করতে শুরু করেন এলএসডি সেবনকারী হাফিজুর। অনেকেই এই ড্রাগ ব্যবহার করে অলীক দৃশ্য দেখতে পায় এবং পরবর্তীতে দুর্ঘটনার শিকার হয়। অন্যদিকে অন্য আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, এলএসডি গ্রহণের ইতিবাচক প্রভাবগুলো আনন্দদায়ক ও উত্তেজক হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে সাধারণত এমন অনুভূতি জড়িত থাকে যে, সেবনকারী ভাসমান বাস্তবতা থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় অর্থাৎ আনন্দ বা উচ্ছ্বাস বোধ করতে থাকে। এ ধরনের ইতিবাচক প্রভাবগুলো ‘গুড ট্রিপ’ নামে পরিচিত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এলএসডির প্রভাবগুলো সাধারণত আধঘণ্টার মধ্যে শুরু হয় এবং তা ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. তাজুল ইসলাম বলেন, অন্যান্য মাদকের তুলনায় এলএসডি খুব বেশি ক্ষতিকর। এর সবচেয়ে খারাপ দিক হলো এটি গ্রহণ করার ফলে দৃষ্টি বিভ্রম বা হ্যালোসিনেশন হয়ে থাকে। ফলস্বরূপ গ্রহণকারীর মধ্যে রঙিন চিন্তা থেকে শুরু করে খারাপ জিনিসগুলোর প্রভাব বিস্তার লাভ করতে থাকে। সেই মুহূর্তে তার মধ্যে দুঃসাহসিক কাজের প্রতি আগ্রহ জাগ্রত হয়। তখন মারাত্মক কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে কিংবা ঘটিয়ে ফেলে। যেমন, উঁচু ভবন থেকে লাফিয়ে পড়তে পারে। এমনকি অনেক সময় আত্মহত্যাও পর্যন্ত করতে পারে। এলএসডিতে আসক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে নিদ্রাহীন, ক্ষুধা মন্দা, চোখের মণি ছোট হয়ে আসা ইত্যাদি লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়। এছাড়া আরো অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় প্রতিনিয়ত, যা শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
পশ্চিমা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলেও ইতোমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে প্রাণঘাতী এই মাদক, যদিও আমাদের দেশে এ মাদকের প্রচলন পূর্বে উল্লেখযোগ্য হারে দেখা যায়নি। করোনাকালীন এ দুঃসময়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে এর প্রতি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বাস্তবতা নিয়ে চরম হতাশাগ্রস্ত সাধারণ মানুষও এ নেশার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছেন। আকারে ছোট হওয়ায় কোকেন, হেরোইনসহ অন্যান্য মাদকের তুলনায় এলএসডি গোপনে বহন করা যায়। এর ফলে এটি সহজেই পাচার করা সম্ভব হয়। ফলে অন্যান্য দেশ থেকে প্রতিনিয়ত এ দেশে পাচার করা হচ্ছে প্রাণঘাতী অবৈধ এলএসডি। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ২০১৯ সালে কানাডা প্রবাসী এক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে এলএসডি উদ্ধার করা হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদের পর জানা যায়, ওই শিক্ষার্থী কানাডা থেকে ছুটিতে আসার সময় দেশে এলএসডি নিয়ে আসে। অতিসম্প্রতি ধানমন্ডি ও লালমাটিয়া এলাকা থেকে তিন তরুণকে ২০০টি এসএসডি ব্লটসহ গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। জিজ্ঞসাবাদে জানা যায়, তারা সবাই রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। গ্রেপ্তাররা আরো জানিয়েছে, দেশে এলএসডি নিয়ে কাজ করছে অন্তত ২০টি গ্রুপ। সাধারণত কুরিয়ার সার্ভিস, অনলাইন শপিং, বিদেশে ভ্রমণ করতে গিয়েই সঙ্গে করে এলএসডি নিয়ে আসছে অনেকেই। এছাড়া করোনাকালীন সময়ে ডার্ক ওয়েব ও টেলিগ্রামের মতো নিরাপদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাপ ব্যবহারের মাধ্যমে এটি পাচার করা হচ্ছে। ব্যয়বহুল এই মাদকটির প্রতি বিশেষ করে অভিজাত পরিবারের তরুণ-তরুণীরা আসক্ত হয়ে পড়ছে বেশি। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, তারা ইতোমধ্যে এলএলডি নিয়ে কাজ করে এমন কয়েকটি গ্রুপের সন্ধান পেয়েছে। বাকি গ্রুপগুলোকেও খুঁজে বের করতে তারা তৎপরতা চালাচ্ছে।
মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসন থেকে বাঁচতে পরিবার ও সমাজের সচেতনতা বাড়াতে হবে। পরিমিত জীবনযাপন, সঠিক বন্ধু নির্বাচন, দায়িত্বশীলতা ইত্যাদি মাদকাসক্তি প্রতিরোধ ও প্রতিকারের উপায়। এলএসডি ছাড়াও অন্য যে-কোনো মাদকের সাথে সম্পৃক্ত আছে এমন ব্যক্তিকে আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। মাদকমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারলে আমাদের তরুণ-তরুণীরা নিজেদের আলোকিত মানুষ হিসেব গড়ে তুলতে পারবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম