চলতি মাসেই শুরু হচ্ছে স্কুলের নতুন শিক্ষাবর্ষের ভর্তি কার্যক্রম। করোনাভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে এবারো সরকারি-বেসরকারি স্কুলের ভর্তি কার্যক্রম লটারিতে সম্পন্ন করতে চায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। এই লক্ষ্যে তৈরি হচ্ছে স্কুল ভর্তি নীতিমালা। এ সপ্তাহেই সভা করে নীতিমালা চূড়ান্ত করা হতে পারে। তবে সব শ্রেণিতে লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তির পক্ষে নন রাজধানীর শীর্ষ স্কুলের প্রধানরা।
মাউশির মহাপরিচালক ড. সৈয়দ গোলাম ফারুক জানান, ভর্তির নীতিমালা চূড়ান্ত করতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আশা করছি, শিগগির এই কমিটির বৈঠক হবে। এরপরই স্কুলে ভর্তির নীতিমালা প্রকাশ করা হবে।
তিনি বলেন, সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তির নীতিমালা চূড়ান্ত করার পর সেই নীতিমালা অনুযায়ী স্কুলে ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হবে। সম্ভবত এমাস থেকে বেসরকারি স্কুলে এবং ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সরকারি স্কুলে ভর্তির আবেদন প্রক্রিয়া শুরু হবে।’ তবে ভর্তির নীতিমালার বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এদিকে, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এরই মধ্যে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের প্রস্তুতি নিয়েছে বেসরকারি বিদ্যালয়গুলো। আর রাজধানীর সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি ফরম বিতরণ হবে ডিসেম্বরের শুরুতে এবং মাসের শেষ দিকে লটারি বা ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করা হবে। আবেদন কার্যক্রম চলবে অনলাইনে।
সাধারণত প্রতি বছর স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য প্রথম শ্রেণিতে লটারি অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া দ্বিতীয় থেকে নবম শ্রেণিতে ভর্তি সম্পন্ন হয় পরীক্ষার মাধ্যমে।
এদিকে, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, গত বছরের মতো এবারো ভর্তি পরীক্ষার বদলে প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করতে নীতিমালা সংশোধনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। করোনার ঝুঁকি এড়াতেই এমন প্রস্তাব করেছে মাউশি। স্কুলে ভর্তিতে কীভাবে ঝুঁকি এড়ানো যাবে, সেটিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি জানান, গত বছরের মতো এবারো শিক্ষার্থী ভর্তির আবেদন ফরম অনলাইনে সম্পন্ন করার নির্দেশ দেওয়া হবে। ফলাফলও প্রকাশ হবে অনলাইনে।
জানা গেছে, চলতি সপ্তাহে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সভা করে ২০২২ সালের স্কুল ভর্তি নীতিমালা চূড়ান্ত করার কথা রয়েছে। গত সপ্তাহের বুধবার এ সভা হওয়ার কথা থাকলেও এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি সংক্রান্ত সংবাদ সম্মেলনের কারণে সভাটি বাতিল হয়। এখন যে কোনো দিন এ সভা হতে পারে। গত বছর সরকারি-বেসরকারি স্কুলে লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছিল।
মাউশির মহাপরিচালকও জানান, করোনার মধ্যে স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তিতে কীভাবে ঝুঁকি এড়ানো যায় সে বিষয়টি বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। এ কারণে প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত লটারির মাধ্যমে ভর্তি করতে প্রস্তাব দেওয়া হবে। এ প্রস্তাব গৃহীত হলে আগামী বছরের শিক্ষার্থী ভর্তি লটারিতে করা হবে।
এদিকে মাধ্যমিকে লটারির মাধ্যমে ভর্তি করা হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন রাজধানীর ভিকারুননিসা ন্যূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক কামরুন্নাহার। তিনি বলেন, লটারির মাধ্যমে সব ক্লাসে ভর্তি করা হলে শিক্ষার্থী বাছাই করে নেওয়া সম্ভব হয় না।
তিনি জানান, অনেকে লটারিতে ভর্তি হলে পরে টিউশন ফি পরিশোধ করতে পারে না। যেহেতু শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ওপর নির্ভর করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যয় ও বেতন-ভাতা দেওয়া হয়। তাই কেউ যদি পাওনা পরিশোধ না করে তাহলে প্রতিষ্ঠানে সংকট তৈরি হয়। তবে লটারির মাধ্যমে ভর্তি হলে তদবির কিংবা অন্য চাপ থাকে না।
রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম বলেন, সব ক্লাসে লটারিতে ভর্তি করলে নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হয়। প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত লটারিতে ভর্তি হতে পারে। কিন্তু এর পরবর্তী ক্লাসে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি করালে শিক্ষার্থী বাছাইয়ের মাধ্যমে ভর্তি করানো সম্ভব হয়।
তার মতে, স্কুল পর্যায়ের বড় ক্লাসে লটারিতে ভর্তি করালে ভালো মানের শিক্ষার্থী পাওয়া যায় না। উপরের ক্লাসে শিক্ষার্থী ভর্তির বেশি চাপ থাকে না, সেখানে সহজে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব, প্রয়োজনে এক ক্লাসের পরীক্ষা ভাগ ভাগ করে কয়েকদিন আয়োজন করা যেতে পারে। পরীক্ষার মাধ্যমে ভালো শিক্ষার্থী ভর্তি না করালে প্রতিষ্ঠানের মান ধরে রাখাও কঠিন হয়ে পড়ে। সব ক্লাসে লটারিতে ভর্তি হলে তো বিশ্ববিদ্যালয়েও লটারিতে ভর্তি করানো যেতো, সেখানে কেন পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (সরকারি বিদ্যালয়) সৈয়দ ইমামুল হোসেন বলেন, সরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তি নীতিমালার কাজ শুরু হয়েছে। চলতি সপ্তাহে এ সংক্রান্ত নীতিমালা চূড়ান্ত করা হতে পারে। নীতিমালায় গত বছরের চেয়ে এ বছর বড় কোনো পরিবর্তন আসছে না বলে জানান তিনি।
মাউশি থেকে জানা যায়, ভর্থির জন্য এবার ঢাকা মহানগরীর ৪৪টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের তিনটি ফিডার শাখাসহ তিনটি গুচ্ছ বা ভাগে বিভক্ত থাকবে। আবেদনের সময় একজন শিক্ষার্থী একটি গ্রুপে পছন্দের ক্রমানুসারে সর্বোচ্চ পাঁচটি বিদ্যালয় নির্বাচন করতে পারবে।
আর সারা দেশের শিক্ষার্থীরা আবেদনের সময় প্রতিষ্ঠান নির্বাচনকালে থানাভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকা পাবে। তখন প্রার্থীরা প্রাপ্যতার ভিত্তিতে পছন্দক্রম অনুযায়ী সর্বোচ্চ পাঁচটি বিদ্যালয় নির্বাচন করবে।
গত বছর করোনাভাইরাস মহামারির কারণে প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। এর আগে শুধু প্রথম শ্রেণিতে লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হতো। আর দ্বিতীয় থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী ভর্তিতে পরীক্ষা নেওয়া হতো। নবম শ্রেণিতে ভর্তি করা হতো জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে।
করোনা মহামারি শুরুর পর গত বছরের ১৭ মার্চ সারা দেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর প্রায় দেড় বছর পর গত ১২ সেপ্টেম্বর স্কুল-কলেজে ক্লাস শুরু হয়। তবে প্রতিদিন সব শ্রেণিতে ক্লাস হচ্ছে না। শুধু চলতি বছর ও আগামী বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী এবং পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। আর অন্যান্য শ্রেণির মধ্যে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে দুই দিন এবং অন্যান্য শ্রেণির শিক্ষার্থীদের এক দিন ক্লাসে আসতে বলা হয়েছে।
এর আগে চলতি বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও সমমানের ইবতেদায়ি পরীক্ষা এবং জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।