এজ গ্যালারিতে ‘কালারস অব ট্র্যাডিশন’

সংগৃহীত ছবি

ফিচার

এজ গ্যালারিতে ‘কালারস অব ট্র্যাডিশন’

  • সালেহীন বাবু
  • প্রকাশিত ১১ এপ্রিল, ২০২১

এজ গ্যালারিতে এপ্রিলের ৩ তারিখ থেকে শুরু হয়েছে শিল্পী আবদুস শাকুর শাহ ও শম্ভু আচার্য্যের দ্বৈত প্রদর্শনী ‘কালারস অব ট্র্যাডিশন’। চিত্রপ্রদর্শনীটি আয়োজন করেছে এজ দ্য ফাউন্ডেশন। প্রদর্শনীতে ৭০টিরও বেশি চিত্রকর্ম রয়েছে। প্রদর্শনীতে দুজনই লোকজীবনের জীবন ভাবনার আনন্দময় প্রকাশ ঘটিয়েছেন।

শিল্পী আবদুস শাকুর শাহ গত চার দশক ধরে লোকশিল্পের ভাষায় অনুগামী হয়ে এক নিজস্ব ভাষা রচনা করে চলেছেন। শাকুরের ছবি শুধু চিত্রগত অলংকার নয়। কেননা শিল্পীর চিত্রজমিনে উপস্থিত হয়েছে অক্ষরমালায় কবিতার পিক্ত। মৈমনসিংহ গীতিকার মহুয়া, কাজলরেখা এসব পালা থেকে কয়েক ছত্র ছবির জমিনে লিখে দিয়েছেন। শাকুরের রক্তবীজে পালাকারদের মতো স্পষ্ট জোরালো প্রকাশের তাগিদ রয়েছে।

শাকুরের মধ্যে বাঙালির নৃতত্ত্বের এক অমোঘ টান আছে, যে তরুণ-তরুণীর অবয়ব তিনি চিত্রায়িত করেছেন বিভিন্নভাবে। তার ছবিতে বিবৃত হয়েছে লোক-বাংলা। প্রদর্শনীতে নেচার-টু, চন্দ্রবতী-১, চন্দ্রবতী-২, চন্দ্রবতী-৩, গ্রামের বিভিন্ন চিত্রকর্ম, কমলা-১, কমলা-২, কমলা-৩, কমলা-৪ ছবিগুলোর দেখা পাওয়া যায়।

শিল্পী পড়াশোনা করেছেন চারুকলা থেকে। শাকুরের প্রথম একক চিত্রপ্রদর্শনী হয় রাজশাহীতে ১৯৭৫ সালে। ২০২০ সাল পর্যন্ত তিনি দেশ-বিদেশে ২০টিরও বেশি একক চিত্রপ্রদর্শনী করেন। আর যৌথভাবে প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ শুরু করেন ছাত্র থাকাবস্থাতেই। ১৯৬৯ সালে পটুয়া গ্রুপের সদস্য হিসেবে খুলনা ও ঢাকাতে প্রদর্শনীর মাধ্যমে যাত্রা শুরু। এরপর দেশ-বিদেশে অংশগ্রহণ করেন দেড়শতাধিক যৌথ প্রদর্শনীতে। দেশ-বিদেশের নানা সংগ্রহশালায় ছড়িয়ে আছে তার চিত্রকর্ম। শিল্পী আব্দুর শাকুরের সংগ্রহেও রয়েছে আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানি, ভারত ইতালি, জাপান, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, পাকিস্তান, পোলান্ড, স্পেন, আমেরিকা, ব্রিটেন, দোহা, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশের খ্যাতিমান শিল্পীদের চিত্রকর্ম। বাংলাদেশের প্রথিতযশা শিল্পীদের কাজ তো রয়েছেই। বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে তার শিল্পকর্ম নিয়ে সুদৃশ্য বইও। শিল্পী শাকুর শাহ ১৯৭৭ সালে ভারতের গুজরাটের ললিতকলা একাডেমিতে চিত্রপ্রদর্শনীর জন্য শ্রেষ্ঠ পুরস্কার, ১৯৮৩ সালে ঢাকায় বাটা আন্তর্জাতিক শিল্প প্রদর্শনীতে প্রথম পুরস্কার, জাপানে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় এক্সেলেন্স পুরস্কার, ১৯৯৮ ও ২০০০ সালে জাপানের টকিওতে এসিসিইউতে রানারআপ পুরস্কার, ২০০২ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক চিত্রপ্রদর্শনীতে স্বর্ণপদক, ২০০৮ সালে শিল্পী এস এম সুলতান পদক, ২০১৯ সালে বার্জার পেইন্টস থেকে আজীবন সম্মাননাসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হন। ছবির মোহে ঘুরে বেরিয়েছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নামকরা সব সংগ্রহশালায়।

সাড়ে চারশ বছর ধরে পটচিত্রের গৌরবময় ঐতিহ্যের ধারাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন মুন্সীগঞ্জের কালিন্দীপাড়ার ঠাকুরবাড়ির আচার্য্য পরিবার। আট পুরুষ ধরে বাংলার আদি শিল্পধারাকে লালন করে চলেছেন তারা। সেই বংশধারার বর্তমানে একমাত্র কান্ডারি পটুয়া শম্ভু আচার্য্য। লোকশিল্প বংশপরস্পরায় চর্চিত হয়। কালের বিবর্তনে পটের আঙ্গিক ও বিষয়ের পরিবর্তন ঘটে। গাজীর পট রচনায় শম্ভুর বিশেষ দক্ষতা অর্জিত হয়েছে প্রাণের টানে। শম্ভুর কাজে ধর্ম-পুরাণের ইশারা প্রকট। চিত্রপ্রদর্শনীতে শম্ভু আচার্য চিত্রকর্ম গাজীর পট-১, ২ এবং ৩-এ গাজীর সময়ের জীবনকাহিনী বর্ণনা করেছেন। শিল্পী প্রতিটি ফ্রেমে স্তরক্রমে একাধিক বিষয়ে এঁকেছেন যা দর্শকদের গাজীর জীবন এবং সাহসিকতার একঝলক দেয়। নদী ও নারী শিরোনামের আরেকটি পেন্টিংয়ে একদল মহিলা দেখায় যারা একটি নদী থেকে জল সংগ্রহ করছে। কাজটি নদী ও মানুষের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়টি তুলে ধরেছেন। প্রাত্যহিক জীবনের কর্মকাণ্ড ও পুরাণের সম্মিলিত প্রকাশে শম্ভু তার চিত্রকর্মকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়।

শম্ভু আচার্য্যের বাবা আঁকতেন গামছায়। শম্ভু আঁকেন মোটা ক্যানভাসে। ইটের গুঁড়া ও চক পাউডারের সঙ্গে তেঁতুল বিচির আঠা মিশিয়ে তৈরি করা হয় মিশ্রণ। আঞ্চলিক ভাষায় একে বলে ‘ডলি’। এই ডলি দিয়ে পুরো মার্কিন কাপড়ে লেপে দিয়ে তৈরি হয় ‘লেয়ার’ বা ‘পরত’। তার ওপরে রেখার টান, নানা রঙের প্রয়োগ। রংগুলোও তৈরি হয় দেশীয় পদ্ধতিতে। ডিমের কুসুম, সাগুদানা, গাছের কষ, বেলের কষ, এলা মাটি, গুপি মাটি, রাজা নীল, লাল সিঁদুর, মশালের ধোঁয়া (শিশুদের চোখের কাজল) এসব দিয়ে তৈরি হয় রং। আর তুলি বানানো হয় ছাগলের লোম দিয়ে। সেসব রং রেখায় তিনি লোকায়ত জীবনের গল্প বলেন। তুলে আনেন পৌরাণিক কাহিনী। ধলেশ্বরী নদীর ধারে মুন্সীগঞ্জের কালিন্দীপাড়ায় শম্ভু আচার্য্যের নয় পুরুষের বাস। শতবর্ষী তমাল গাছের ছায়ায় এ বাড়িতেই গত নয় পুরুষ ধরে ছবি আঁকছেন তারা। শম্ভু আচার্য্য বললেন, আমাদের পূর্বপুরুষরা পটে চিত্র আঁকতেন। পরে এটা গামছায় ও ক্যানভাসে আঁকা শুরু করেন তারা। সেজন্যই এর নাম পটচিত্র। শম্ভু আচার্য্যের পড়াশোনা বেশিদূর না এগুলেও ছবি আঁকার গুণ তার রক্তে প্রবাহিত। ছবি আঁকার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না নিলেও ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকছেন। আর বর্তমানে শম্ভু আচার্য্য একজন স্বনামধন্য পটচিত্রকরে পরিণত হয়েছেন। তার পটচিত্র স্থান পেয়েছে ব্রিটিশ মিউজিয়াম, চীনের কুবিং মিউজিয়াম, সাংহাই মিউজিয়াম, জাপানের অঅনাগাওয়া ও ফকুকুয়া মিউজিয়াম, ইন্দোনেশিয়া মিউজিয়ামে। প্রদর্শনীটি ২৩ এপ্রিল শেষ হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads