মনতাজ আলি। একজন দিনমজুর। দিনের অধিকাংশ সময় অন্যের ক্ষেতে মজুরি দিতে চলে যায়। দুই ছেলে ও এক মেয়েসহ তার পাঁচ সদস্যের ক্ষয়িষ্ণু সংসার। মমেনা বেগম মনতাজ আলির সংসারটিকে অক্টোপাসের মতো পরম মমতায় জড়িয়ে রেখেছে। সোয়ামি যা পান মজুরি হিসেবে, তা-ই দিয়ে অর্ধপেট খালিপেট করে চৌদ্দ বসন্ত একচালের নিচে।
একটি ষাঁড় গরু আধি (ধার করে) নিয়ে পুষছে মমেনা। ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠিয়ে গরুটির পেছনেই সময় ব্যয় করে। সোয়ামি দুপুরে খেতে এলেও মমেনা গরু নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তাকে ভাত বেড়ে দিতে পারে না। রাতের বেলা গরুটিকে তাদের চালার এককোণে রাখে। রাতে মাঝে মাঝে ঘুম থেকে জেগে গরুটিকে দেখে। বস্তা ও পাসুন নিয়ে জমির আল থেকে ঘাস সংগ্রহ করে, বাঁশঝাড় থেকে বাঁশপাতা সংগ্রহ করে, আশপাশের গাছ থেকে পাতা সংগ্রহ করে গরুটিকে খাওয়ায়। দু’দিন পরপর আউলিয়াখানা নদীতে গোসল করায় গরুটিকে। সোয়ামি সংসার থেকে তার গরুটি অনেক খেয়ালের জায়গা।
গরুটি মোটাতাজা হলে কৈমারীর হাটে বিক্রি করে তাদের ভাগের টাকায় একটা ছাগল কিনে পুষবে। এই ছাগল পুষে পুষে টাকা জমাবে। মেয়েটার বয়স এখন বারো বছর। কয়েক বছর পর বিয়ে দিতে টাকা লাগবে। আর সে সময় ছাগল বিক্রির টাকা দিয়ে বিয়ের যাবতীয় খরচ সারবে।
মনতাজের বড় বোনের খুব অসুখ করেছে। পাশের বাড়ির আতারুল মাস্টারের মোবাইলে খবর পাঠিয়েছে। মনতাজ কাজ থেকে ফিরলে মমেনা তাকে পাঠিয়ে দেয় বড় বোনকে দেখার জন্য। রাতে মনতাজ বাড়িতে ফিরতে পারেনি। মনতাজ বাড়ি না ফেরায় মমেনার দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়। পাশের মৌজা গ্রাম থেকে গত সপ্তাহে দুটি গরু চুরি হয়েছে। মধ্যরাত পর্যন্ত নির্ঘুম কাটিয়েছে মমেনা। হঠাৎ বড় ছেলেটি চিৎকার করে ওঠে, ‘ও মা! গরুটা নাইগো মা! ও আল্লাহ, হামার গরুটা চুরি করি নিয়া গেইছে।’
ছেলের চিৎকার ও কান্নার শব্দে মমেনা ধড়ফড় করে উঠে বসে। দেখে সত্যি সত্যি গরুটা নেই। ঘরের একপাশের বেড়া কাটা। জোর গলায় মরা কান্না শুরু করে মমেনা। অন্য ছেলে-মেয়ে দুটিও চিৎকার করে কান্নাকাটি শুরু করে। প্রতিবেশী লোকজন ঘুমের ঘোরে মনে করে মনতাজের বড় বোন মনে হয় মারা গেছে। কিন্তু খানিক পরে কান্নাকাটির আওয়াজ থেকে বোঝে মনতাজের আধি নেওয়া গরুটা চুরি হয়েছে। প্রতিবেশীরা যে যারমতো টর্চলাইট নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সবাই জোরেশোরে চিৎকার করতে থাকে, ‘মনতাজের গরু চুরি করি নিয়া গেছেরে! সবাইগুলা ওঠো! আশেপাশে একনা উকটি দ্যাকো!’
মনতাজের বাড়ির উত্তর পাশে ‘হাম্বা’ করে ডেকে ওঠে। সবাই লাইট নিয়ে দৌড় দেয় সেদিকে। দেখে গরুটা ক্ষেতের মধ্যে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে চাওয়া-চাওয়ি করছে। মমেনা গরুটাকে জড়িয়ে ধরে আরো জোরে কাঁদা শুরু করে। খুব সম্ভবত গ্রামের লোকজন টের পাওয়ায় চোর গরু নিয়ে যেতে পারেনি। গরুটা ছেড়ে নিজেদের রক্ষার জন্য পালিয়েছে সে।
পরদিন মনতাজ বড় বোনের বাড়ি থেকে ফিরলে মমেনার সেই রাগ। ‘বইনের বাড়ি যেয়া আর আইসবার নাম নাই! আইতোত যে গরুটাক চুরি করি নিয়া গেইছলো! কতবা বাড়ি ভাগ্য ভালো হামার আল্লায় গরুকোনা ফিরি দিছে। আইজ বুধবার কৈমারী হাটোত গরুটাক বেচাইবেন।’
আউলিয়াখানা নদীতে গোসল করিয়ে, শিং, মাথা ও গোটা শরীরে সরিষার তেল মেখে গরুটাকে কৈমারীর হাটে নিয়ে যায় মনতাজ। যে গরুর মূল মালিক, সে তার পারিবারিক অন্য একটি কাজে ব্যস্ত থাকায় মনতাজকে বলে গরু বিক্রি করে টাকা নিয়ে বাড়ি আসতে। তার গরুর আসল মূল্য ও লভ্যাংশের টাকা বাড়িতে বুঝে নেবে। মনতাজ কৈমারী চড়কডাঙ্গার মাঠে গরু-ছাগলের হাটে বিশ হাজার টাকায় বিক্রি করে গরুটি। কচকচে লালরঙের বিশটি নোট দেয় মনতাজের হাতে দূরান্তের এক অচেনা ক্রেতা। মনতাজ বেশ ফুরফুরে মেজাজে হাটের ভেতরে রশিদুলের চায়ের দোকানে ঢুকে একটি মোগলাই অর্ডার করে।
চামচ দিয়ে মোগলাই খেয়ে এক কাপ চা খায় মনতাজ। চা খাওয়া শেষে ক্যাশ কাউন্টারের কাছে এসে হোটেলের ম্যাসিয়ারকে বলে কত বিল হয়েছে। ম্যাসিয়ার পঁচিশ টাকা বিলের কথা বলে। মনতাজ কোমরের লুঙ্গির প্যাঁচ থেকে বিশটি নোটের একটি নোট বের করে দেয়।
ক্যাশ কাউন্টারের ম্যানেজার মনতাজের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনতাজও ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে থাকে।
‘দ্যান, মোগ নয়শ পঁচাত্তর টাকা ফেরত দ্যান!’
‘আরে ঢঙ করা বাদ দিয়া আরো বিশ টাকা দ্যান! এ্যাটেকোনা এখান পাঁচ টাকার নোট। হাটের দিন ভ্যাজাল করেন নাতো। টপ করি দ্যাও।’
‘কী, এখান পাঁচ টাকার নোট? তোমাগুলা এইল্লা কী কবার নাগছেন?’
এক শিক্ষিত ভদ্রলোক নাশতা খাওয়া শেষ করে বিল দেওয়ার জন্য কাউন্টারে আসেন। মনতাজ আর ম্যানেজারের মধ্যে একটি পাঁচ টাকার নোট নিয়ে বািবতণ্ডা দেখে মনতাজকে বলে কী হয়েছে?
‘মুই এ্যালায় গরু ব্যাচেয়া এক হাজার টাকার বিশ খান নোট থাকি এখান ওমাক দিনুং। ওমা কয়ছে এখান বেলে পাঁচ টাকার নোট!’
‘হ্যাঁ! উনি তো ঠিকই বলেছেন, এটা পাঁচ টাকার নোট।’
‘কী! ততকরি এখান পাঁচ টাকার নোট?’
‘জি! সত্যিই এটা পাঁচ টাকার নোট।’
ভদ্রলোকের কথা শুনে মনতাজ জ্ঞান হারিয়ে কাউন্টারের সামনে ঢলে পড়ে। ৎ