এক অনন্য রাজনীতিকের নাম

সংগৃহীত ছবি

মুক্তমত

মওলানা ভাসানী

এক অনন্য রাজনীতিকের নাম

  • নিতাই চন্দ্র রায়
  • প্রকাশিত ২০ নভেম্বর, ২০১৮

১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ ও ’৭৬-এর ফারাক্কা মিছিলসহ বাঙালির প্রতিটি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তিনি বিশ্বাস করতেন এ পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা এদেশের কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের মুক্তি আনতে পারে না। মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্য সমাজতন্ত্র তথা সাম্যবাদী সমাজের কোনো বিকল্প নেই। আবার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ফাঁসির দড়ি থেকে বঙ্গবন্ধুকে বাঁচানোর জন্য মওলানা ভাসানীর জ্বালাওপোড়াও সংগ্রামের কথাও জানে না আজকের প্রজন্ম।

মহাত্মা গান্ধীর মতো মওলানা ভাসানী অত্যন্ত সহজ-সরল জীবনযাপন করতেন। তার কথাবার্তা, চালচলন ও আচার-আচরণের মধ্যেই বাংলার নির্যাতিত ও নিপীড়িত কৃষক-শ্রমিকের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিধ্বনিত হতো। ক্ষমতার প্রতি তার কোনো লোভলালসা ছিল না। ছিল না আয়েশি জীবনের প্রতি কোনো মোহ। সাধারণ তাঁতের লুঙ্গি, সুতির পাঞ্জাবি, বেতের টুপি ও এক জোড়া চটি ছিল তার প্রিয় পোশাক। কোনো রাজপ্রাসাদ নয়, সন্তোষের ছনের ঘরই ছিল তার সারা জীবনের আশ্রয়।

১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের ধানগড়া গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হাজি শরাফত আলী ও মাতার নাম মোসাম্মৎ মজিরন বিবি। মাত্র ছয় বছর বয়সে আবদুল হামিদের পিতা মারা যান এবং এগার বছর বয়সে স্নেহময়ী মায়ের মৃত্যু হয়। পিতৃ-মাতৃহীন এ অনাথ বালকটি কিছুদিন তার চাচা ইব্রাহিমের আশ্রয়ে থাকেন। ওই সময় ইরাকের এক আলেম ও ধর্ম প্রচারক নাসিরউদ্দীন বোগদাদী সিরাজগঞ্জে আসেন। আবদুল হামিদ তার আশ্রয়ে কিছুদিন কাটান। এরপর তিনি জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি, ভারতের আসাম এবং সবশেষে ১৯০৭ সালে ইসলামী শিক্ষার উদ্দেশ্যে দেওবন্দ যান। দু’বছর সেখানে অধ্যয়ন করে পুনরায় আসামে ফিরে আসেন।

১৯১৭ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ময়মনসিংহ সফরে এলে তার ভাষণ শুনে ভাসানী অনুপ্রাণিত হন। ১৯১৯ সালে কংগ্রেসে যোগদান করে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে দশ মাস কারাদণ্ড ভোগ করেন। ১৯২৫ সালে তিনি জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার জমিদার শামসুদ্দীন আহম্মদ চৌধুরীর মেয়ে আলেমা খাতুনকে বিয়ে করেন। ১৯২৬ সালে তিনি তার সহধর্মিণী আলেমা খাতুনকে নিয়ে আসাম গমন করেন এবং আসামে প্রথম কৃষক-প্রজা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান। ১৯২৯ সালে আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসান চরে প্রথম কৃষক সম্মেলনের আয়োজন করেন। এখান থেকেই তার নাম রাখা হয় ‘ভাসানীর মওলানা’ এরপর থেকেই তার নামের সঙ্গে ভাসানী শব্দটি যুক্ত হয়। ১৯৩৭ সালে ভাসানী কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগদান করেন। ১৯৪০ সালে শেরেবাংলা এ.কে. ফজলুল হকের সঙ্গে মুসলিম লীগের লাহোর সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৯৪৪ সালে মওলানা ভাসানী আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালের শেষের দিকে তিনি আসাম ছেড়ে টাঙ্গাইলের সন্তোষ চলে আসেন।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন নব গঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন টাঙ্গাইলের শামসুল হক। জেলে থেকে দলের প্রথম যুগ্ম সম্পাদক হন শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত ৮ বছর মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন।

১৯৫৭ সালের ৮ থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক কাগমারি সম্মেলনে তিনি বলেন, পূর্ববাংলা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের দ্বারা শোষিত হতে থাকলে পূর্ববঙ্গবাসী তাদের আসসালামু আলাইকুম জানাতে বাধ্য হবে। এ ছাড়া ওই সম্মেলনে ভাসানী পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবি জানান। প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী এই দাবি প্রত্যাখ্যান করলে ১৮ মার্চ ভাসানী আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন এবং একই বছর ২৫ জুলাই তার নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠিত হয়। ন্যাপ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভাসানী প্রকাশ্যে বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন এবং এরপর থেকে সবসময় তিনি বাম রাজনীতির সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন।

তিনি রাজনীতি ছাড়াও অনেক সমাজ উন্নয়ন ও শিক্ষামূলক কাজ করেন। ১৯৭৬ সালের ২ অক্টোবর তিনি খোদায়ী খেদমতগার নামে একটি নতুন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন এবং সন্তোষের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি সন্তোষে একটি কারিগরি কলেজ, মেয়েদের একটি স্কুল এবং একটি শিশু কেন্দ্র স্থাপন করেন। তিনি পাঁচবিবিতে নজরুল ইসলাম কলেজ এবং কাগমারিতে মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়া তিনি আসামে প্রায় ৩০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন।

১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই দেশবরেণ্য নেতা মৃত্যুবরণ করেন। তাকে টাঙ্গাইল জেলার সদর উপজেলার সন্তোষ নামক স্থানে পীর শাহজামান দীঘির পাশে সমাহিত করা হয়। তিনি ছিলেন নেতা তৈরির এক দক্ষ কারিগর। তার হাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, মশিউর রহমান যাদু মিয়া, আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, রাশেদ খান মেনন ও কাজী জাফর আহমেদের মতো নেতার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি ছিলেন গরিব-দুঃখী মেহনতি মানুষের মুক্তির দূত। সত্য, সুন্দর ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের অগ্রসৈনিক।

লেখক : নিবন্ধকার

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads