ফিচার

ঋতুরানি শরৎ

  • পৃথ্বীশ চক্রবর্ত্তী
  • প্রকাশিত ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ। আর এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পেছনে রয়েছে এদেশের ছয়টি ঋতু। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। বাংলাদেশকে তাই ষড়ঋতুর দেশ বলা হয়। এর মধ্যে শরৎ ঋতুর অস্তিত্ব অন্য দেশেও যে আছে তা ইংরেজ কবিদের কবিতায় পাওয়া যায়। শরতের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কবি M. K. Rawling বলেন—  

The Wonders of an autumn morning I get light for turning the motto of life All the Long, to Pipe

অর্থাৎ শারদ প্রভাতের বিচিত্র সৌন্দর্যে জীবনের গতি পরিবর্তনের পথ খুঁজে পাই। বর্তমানে বাংলাদেশে শরৎ ঋতুর পালা। বাংলা ভাদ্র ও আশ্বিন এই দুই মাস শরৎকাল। সব ঋতুকে নিয়ে লিখলেও, আমার মনে হয় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শরৎ নিয়ে সবচেয়ে বেশি কবিতা লিখেছেন, গান লিখেছেন, সুর করেছেন, গেয়েছেনও। তাই ‘নীল আকাশে কে ভাসালে/ সাদা মেঘের ভেলা।’ — শরৎকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই দুই পিক্ত দিয়েই শুরু করতে চাই শরতের কথামালা।

শরতের প্রভাতে লাল ঝলমল সূর্য ওঠে। পাখি ডাকে। বায়ু বয়। নানা ফুল ফোটে। নীল আকাশে ভাসে শাদা মেঘের ভেলা। রৌদ্র-মেঘের লুকোচুরি খেলা আরো কত কি! তাই তো কবিগুরু বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘আজিকে তোমার মধুর মুরতি/হেরিনু শারদ প্রভাতে;/ হে মাতঃ বঙ্গ! শ্যামল অঙ্গ/ ঝলিছে অমল শোভাতে।/ডাকিছে দোয়েল, গাহিছে কোয়েল/ তোমার কানন সভাতে।/ মাঝখানে তুমি দাঁড়ায়ে জননী/শরৎকালের প্রভাতে।’ শরৎ সকালের মোহনীয় বর্ণনা এ কবিতায় বিধৃত। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বাংলা সাহিত্যে শরতের বর্ণনা অসম্ভব। তাই শরতের কথা লিখতে গেলেই রবীন্দ্রনাথ এসে হাজির হন। আর এটা যেন বাঙালির জন্য স্বাভাবিক। শরৎ সকালের আরেকটি বর্ণনা আমরা কবিগুরুর কবিতা থেকে নিতে চাই, ‘শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি/ ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি/ শরৎ তোমার শিশির-ধোওয়া কুন্তলে/ বনের পথে লুটিয়ে পড়া অঞ্চলে/ আজ প্রভাতের হূদয় ওঠে চঞ্চলি।’ বসন্তকে ফুলের ঋতু বলা হলেও শিউলি, কাশফুল, শাপলা, কলমি, জলপদ্ম, স্থলপদ্ম, মালতী, জুঁই, টগর-সহ নানা বৈচিত্র্যের নানা বর্ণের নানা গন্ধের ফুলে ফুলে ভরে ওঠে শরৎ কানন। শরতের ফুলের অবারিত সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বিশ্বকবি গেয়ে ওঠেন— ‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ/ আমরা গেঁথেছি শেফালী মালা;/ নবীন ধানের মঞ্জরি দিয়ে/ সাজিয়ে এনেছি ডালা।’

শরৎ চাকচিক্যের বা হই-হুল্লোড়ের ঋতু না হলেও এর বৈচিত্র্য বিশিষ্টতা দান করেছে। শরতের মেঘমুক্ত ফুরফুরে আমেজের সকাল বেলার দৃশ্য খুবই চমৎকার ও উপভোগ্য, যা অন্য কোনো ঋতুতে পরিলক্ষিত হয় না। নিশির-শিশির সিক্ত দূর্বাঘাসে ভোরের অরুণ আলোয় যখন ঝিকমিক করে ওঠে, তখন ঘাসের ডগার শিশির ফোঁটায় অসংখ্য সূর্যের সমাবেশ বলে ভ্রম হয়। শিউলির তলায় শিশু-কিশোর-কিশোরীদের সমাগম চোখে পড়ার মতো। শিউলি ফুল দিয়ে মালা বানিয়ে কুমারির গলায়, হাতে, নাকে, কানে কিংবা চুলের বেণিতে পরালে কার না ভালো লাগে! শরতের নদীতীরের কাশবনে মেঘশুভ্র কাশফুলকে দূর থেকে দেখে মনে হবে মর্ত্যের বনে যেন আকাশের মেঘমেয়েরা নেমে এসে হাওয়ায় হাওয়ায় নৃত্য করছে। ধানক্ষেতে এই সময়ে বাতাসে বাতাসে সবুজের ঢেউ খেলে যায়। নীল আকাশের বুক দিয়ে শাদা মেঘভেলাকে দেখে মনে হবে নীল সমুদ্র দিয়ে শাদা পাল তোলা জাহাজের ছড়াছড়ি। আকাশ রাঙিয়ে শরতের সকালে সূর্য ওঠার এবং বিকেলে সূর্যাস্তের আবিররাঙা দৃশ্যকল্পের সঙ্গে আমরা সবাই কম-বেশি পরিচিত। শরতের দুপুরে সূর্য প্রখর আলো দান করে। অনেকে এ রোদকে ‘তালপাকা রোদ’ও বলে থাকে। কারণ ওই সময়ে প্রচণ্ড গরমে গাছের কাঁচা তালগুলো পাকে। রাতের আকাশে চাঁদ-তারার মিলনমেলা অপূর্ব সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে।

শরতের একমাত্র উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসব। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় মহোৎসব, যা বর্তমানে সার্বজনীনতা পেয়েছে। বাংলার মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানসহ সব ধর্মাবলম্বীরা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করে থাকেন। শরতের দুর্গাপূজায় শিশু-কিশোরদের আরেকটি আকর্ষণীয় দিক হলো ‘মেলা’। প্রত্যেক পূজামণ্ডপের এই মেলা বাংলাদেশের সব শিশু-কিশোর-কিশোরীর মিলনের উৎসস্থল হয়ে ওঠে। সার্বিক বিবেচনায় শরৎ ঋতুকে ঋতুরানি হিসেবে অভিহিত করা যায়। ঋতুরানি শরতের এমন মোহনীয় সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হয়ে আমরা সবাই কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায় বলতে চাই- ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ/ খুঁজিতে যাই না আর...’ ৎ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads