ধর্ম

উমর ইবনে আবদুল আজিজ : বিশ্বের দরদি খলিফা

  • প্রকাশিত ৪ জানুয়ারি, ২০২১

আবদুল্লাহ শাকের

 

 

উমর ইবনে আবদুল আজিজ। তিনি ছিলেন মুসলিম বিশ্বের দরদি খলিফা। যেদিন খেলাফতের আসনে অধিষ্ঠিত হলেন তার সামনে পেশ করা হলো খেলাফতের তরফ থেকে নামি-দামি জন্তুবাহন। খলিফা জিজ্ঞেস করলেন, এগুলো কী? কিসের জন্য? প্রজারা জবাব দিল, এগুলো দামি-বাহন। যাতে সাধারণ কেউ আরোহণ করতে পারে না। একমাত্র আগত খলিফাই এতে আরোহণ করে থাকেন। খলিফা খাদেমকে বললেন, এগুলো বাইতুল মালে পাঠিয়ে দাও। খলিফার জন্য বানানো হলো এমন দামি-দামি তাঁবু। খলিফাদের জন্যই কেবল বানানো হয় এই তাঁবুগুলো। খলিফা জিজ্ঞেস করলেন, এগুলো কী? প্রজারা জবাব দিল, এগুলো এমন তাঁবু যাতে বসেনি কেউ ইতোপূর্বে। খেলাফত লাভের পরে খলিফা মহোদয়গণ এতে বসে থাকেন। খলিফা খাদেমকে বললেন, বাইতুল মালের সাথে এগুলো মিলিয়ে নাও।

খেলাফত প্রাপ্তির প্রথম দিনেই খলিফা সারি সারি কাতারের মাঝ দিয়ে চলেছেন একজন সাধারণ মুসলমানের মতো। গ্রহণ করেননি কোনো অশ্বারোহী। দরকার হয়নি অজস্র পুলিশ ও দেহরক্ষী। অথচ সংখ্যায় তারা ছিল বিপুল বিশাল। ছয় শতাধিক। অতঃপর একটি মামুলি খচ্চরে আরোহণ করে আগমন করলেন বাইতুল খিলাফায়। সেখানে গিয়ে দেখতে পেলেন, পূর্ববর্তী খলিফা সুলায়মান ইবনে আবদুল মালিকের সন্তানদের ব্যবহূত লেবাস ও সুরভি-সুগন্ধি এক পাশে রাখা। আরেক পাশে রাখা অব্যবহূত সরঞ্জামাদি, পোশাক-আশাক। খলিফা জানতে চাইলেন, এগুলো কীসের জন্য? আর ওইগুলো কীসের জন্য? প্রজারা বললো, এই পাশেরগুলো ব্যবহূত আর ও পাশটায় যা রাখা তা অব্যবহূত। ওগুলো আপনার জন্য। খলিফা তখন বললেন, না। ওগুলো আমার জন্য নয়। খলিফা সুলায়মানের জন্যে নয়। তোমাদের জন্যেও নয়। ওগুলো অসহায় ও দুঃস্থ মানুষদের জন্য। খলিফা এগুলোও বাইতুল মালে পাঠিয়ে দিলেন। বাঁদিদেরকে হাজির করা হলো। তার সামনে পেশ করা হলো আরো সুন্দর করে। খলিফা একে একে সব বাঁদিকে প্রশ্ন করলেন, তুমি কে? কার অধীনে ছিলে তুমি? আর কেইবা এখানে পাঠালো তোমাকে? সবাই যার যার ঘটনা খুলে বললো খলিফার কাছে। খলিফা বাঁদিদের ঘটনার ফিরিস্তি শুনে পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। নিজ দেশে বাবার কাছে, মায়ের কাছে।

মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী, আরবের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ও সৈন্যসামন্ত, মানিত সিপাহশালার ও লোকলস্কর খলিফার কর্ম দেখে সবাই দৃঢ় প্রত্যয়ী হলো যে অচিরেই তিনি প্রতিষ্ঠা করবেন ন্যায়নীতি ও ইনসাফ। মানুষকে চালাবেন শরীয়তের ওপর। তাই হলো। তিনি ফিরিয়ে দিলেন মজলুমের অধিকার। কায়েম করলেন আল্লাহর বিধান আর জীবিত করলেন নবীজির সুন্নাহ। মনোযোগী হলেন খোদার আদর্শাবলি বাস্তবায়নে। আর তিনি নিজে পরিহার করলেন দুনিয়ার চাকচিক্য ও মনকাড়া জারিজুরি, চোখকাড়া ভারিভুরি। খেলাফত পরিচালনায় তিনি অনুসরণ করতেন হজরত উমর (রা.)-এর নীতি। প্রথম ওয়াক্তে নামাজ আদায় করতেন তিনি। নামাজ আদায়ে নবীজির গুণাবলির এত্তেবা করতেন খুব বেশি। খলিফা সম্পর্কে সায়্যিদা ফাতিমা বিনতে হোসাইন (রা.) বলতেন, ‘উমর ইবনে আবদুল আজিজ যদি যুগ-যুগান্তর আমাদের মাঝে বেঁচে থাকতেন তবে এরপর আমরা আর কোনো কিছুর প্রতি মুখাপেক্ষী হতাম না।’

হিজায, সিরিয়া, মিশর, ইয়েমেন ও বাহরাইনের অনেক সম্পত্তি তিনি পিতৃপুরুষ থেকে পেয়েছিলেন। সম্পদে ছিল তার বিশাল দখল। তার ভাগে প্রতি বছর চল্লিশ হাজার দিনার নির্ধারিত ছিল। এসব তিনি বাইতুল মালে ফিরিয়ে দিতেন। আর নিজের জন্য প্রাত্যহিক খরচ হিসেবে রাখতেন মাত্র দুই দিরহাম। একদিন খলিফাকে বলা হলো, আপনি কেনো গ্রহণ করেন না যা গ্রহণ করতেন হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)। শরীয়তও তার বৈধতা দিয়েছে। খলিফা বললেন, হজরত উমর (রা.)-এর সম্পদ ছিল না। আমার তো প্রয়োজনীয় সম্পদ মজুত আছে। দুই দিরহামই আমার জন্য যথেষ্ট প্রতিদিনের জন্য।

দুনিয়া খলিফার কাছে এসেছিল উপুর হয়ে। তিনি গ্রহণ করেননি। গ্রহণ করেননি খাদ্যের বিচিত্রতা। একদিন জর্ডানের বাদশাহ লোক মারফত দুই ঝুড়ি খেজুর পাঠালেন খলিফার কাছে। যাচাইয়ের জন্য খলিফা বললেন, এগুলো কী? কে পাঠাল? আগত লোকটি বলল, দুই ঝুড়ি খেজুর। জর্ডানের বাদশাহ আমাকে দিয়ে পাঠিয়েছেন আপনার কাছে। খলিফা বললেন, কিসে পাঠিয়েছে? লোকটি বলল, খচ্চরের মাধ্যমে। খলিফা বললেন, এগুলো বিক্রি করে দাও। এর মূল্য দিয়ে খচ্চরের খাবারের ব্যবস্থা করো। খলিফার ভাতিজা আগত লোকটিকে ইশারা করল, বাজারে নিয়ে দাম নির্ধারণ করো। কথামতো বিক্রি করল। দাম হলো চৌদ্দ দিরহাম। ভাতিজাই কিনলো দুই ঝুড়ি খেজুর। বুদ্ধি করে এক ঝুড়ি পাঠিয়ে দিলেন খলিফার ঘরে। আরেক ঝুড়ি রেখে দিলেন নিজের জন্যে। খলিফা তখন বললেন, এখন তা থেকে খাওয়া আমার জন্য জায়েজ হবে।

একবার তিনি গভর্নরদের সাথে বসে প্রজাদের খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। তাদের হালত সম্বন্ধে আলোচনা করছিলেন। পাশে বাতির আলো নিবুনিবু করছিল। খলিফা উঠে গিয়ে ঠিক করে স্বস্থানে ফিরে আসলেন। খলিফার কাণ্ড দেখে তারা বলে উঠলো, হে আমীরুল মুমিনীন! এ কাজ আপনি কেনো করতে গেলেন! আপনি তো আমাদের বাদশাহ! আমাদের প্রত্যেকের যে কেউই তো বাতিটি ঠিক করতে পারত। খলিফা তাদের কথা শুনে বললেন, শোনো, আমি উঠে গিয়ে বাতি ঠিক করেছি এবং ফিরে এসেছি। আমি তো উমরই আছি। তাই না? মেহমানের সেবা করা এটা তো কারো আত্মমর্যাদায় আঘাত হানে না। কারো গায়রত তো বিনষ্ট করে না।

একদিন জনৈক ব্যক্তি খলিফাকে ডাক দিল, হে আল্লাহর খলিফা! খলিফা তখন বললেন, আমার জন্মের সময় বাবা-মা নাম রেখেছেন উমর। এ নামে কেউ ডাকলে জবাব দেই। যখন বৃদ্ধ হয়েছি আমি আমার নাম তায়িন করেছি আবু হাফস। এ নামে কেউ ডাকলে জবাব দেই। আর আমি যখন খলিফা নিযুক্ত হয়েছি তোমরা আমাকে আমীরুল মুমিনীন বলে সম্বোধন করো। কেউ এ নামে ডাকলে জবাব দেই। কিন্তু কেউ যদি আমাকে ডাকে আল্লাহর খলিফা বলে তখন আমি জবাব দেই না। কারণ আমি তো আল্লাহর খলিফা নই। আল্লাহর খলিফা ছিলেন হযরত দাউদ (আ.)। আল্লাহ তার কালামে বলেছেন, ‘হে দাউদ! আপনাকে আমি খলিফা বানিয়েছি ধরার বুকে। (সূরা সাদ)

তখন চলছে গ্রীষ্মকাল। প্রচণ্ড গরমের গুমোট তাপ। এ সময় খলিফা এক খাদেমকে বললেন, পাখা দিয়ে একটু বাতাস করো তো। একটু ঘুমাই। খাদেম বাতাস করায় একসময় খলিফা ঘুমিয়ে গেলেন। বাতাস করতে করতে খাদেমেরও ঘুম পেয়ে গেলে ঘুমিয়ে পড়ে সে। খলিফা জাগ্রত হয়ে দেখতে পান খাদেম ঘুমাচ্ছে। খাদেমকে তিনি বাতাস করতে শুরু করলেন। খাদেম জেগে খলিফার বাতাস করা দেখে বিষম খেলো। ভীষণ লজ্জিত হলো। খলিফা তখন অভয় দিয়ে বললেন, ভয় পাবার কিচ্ছু নেই। তুমিও আমার মতো একজন মানুষ। তুমিও তো অনুভব করো গরমের ক্ষিপ্রতা। আমি তো কেবল একটু বাতাস করতে চেয়েছি তোমাকে। যেনো আরামে ঘুমাতে পারো খানিক। এই হলো উমর ইবনে আবদুল আজিজ। যিনি খলিফার অবস্থানে থেকেও খাদেমের কর্ম করতে দ্বিধাবোধ করেননি। নামাজ আদায়ের সময় হলে তিনি নিজ হাতে পানি ঢেলে অজু করতেন।

আরেকদিনের ঘটনা। খলিফার এক ছেলে অন্য ছেলেদের সাথে রাস্তায় খেলতে গেলো। খেলায় এক ছেলে খলিফার ছেলের চেহারায় আঘাত করলে রক্ত ঝরতে থাকে। খাদেমরা ওই আঘাতকারী ছেলেটিকে ধরে নিয়ে এলো খলিফার ঘরে। খলিফার স্ত্রী কী বলে তা জানার জন্য। খলিফা ঝগড়ার কথা শুনে ঘরে এলেন। এসে দেখেন আঘাতকারী ছেলেটা অঝোরে কাঁদছে। আর তার মা ছেলের অপরাধের জন্য খলিফার স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চাচ্ছে। খলিফা ঝগড়ার হেতু জানতে চাইলে খাদেমরা খুলে বললো সব ঘটনা। তিনি জানতে পারলেন, আঘাতকারী ছেলেটা এতিম। তার মায়ের স্বামী নেই। আসলেও ছেলের অপরাধের জন্য তার কোনো দোষ নেই। ফলে তিনি এতিম ছেলে ও তার মায়ের জন্য ব্যথিত হলেন। দয়াপরবশ হয়ে খাদেমদেরকে বললেন, মহিলাকে জিজ্ঞেস করো বাইতুল মাল থেকে তার ছেলের জন্য কোনো ভাতা আসে কিনা? মহিলা জবাব দিল, না। খলিফা বললেন, তোমরা তার নাম লিখে নাও অসহায়-এতিমদের দপ্তরে। খলিফার স্ত্রী ফাতিমা খলিফার কথা শুনে সংকীর্ণমনা হয়ে গেল। বললেন, আপনার এই সিদ্ধান্তের পর এতিম এবং দরিদ্র ছেলেদের থেকে আমার ছেলেদের ব্যাপারে আশংকাবোধ করছি। খলিফা স্ত্রী ফাতিমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার ছেলে তো ব্যথা পেয়েছে এই এতিম ছেলের জন্য। খলিফা তখন তাকে কোরআনের দুটি আয়াত শুনালেন, ১. ক্ষমা করা তাকওয়ার নিকটবর্তী। (বাকারা) ২. যারা রাগ সংবরণ করে, মানুষকে মার্জনা করে। নিশ্চয় আল্লাহ অনুগ্রহকারীদের ভালোবাসেন। (আলে ইমরান)। কোরআনের আয়াত শুনে স্ত্রী ফাতিমা স্থির হলো। শান্ত হলো। রাগটাও প্রশমিত হলো।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক, ছড়াকার

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads