শাকিবুল হাসান
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এদেশের তিনদিকে স্থল ও একদিকে সমুদ্র। প্রতি বছর বর্ষাকালে অতিবৃষ্টির কারণে নদীগুলোর বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকে বন্যার সৃষ্টি করে। মাঠঘাট, ফসলের জমি, মাছের ঘেরসহ সবকিছু পানির নিচে তলিয়ে যায় এবং বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ সময় সবচেয়ে বেশি নাজুক অবস্থায় পড়ে দেশের নদী ও সমুদ্রবর্তী উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ। প্রতি বছর বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হয় ঊপকূলীয় অঞ্চলগুলো। আর প্রত্যেকবারের মতো বন্যা হলে অল্পকিছু ত্রাণ দিয়ে লোক দেখানো সাহায্য করা হয়। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর। অথচ বছর বছর ত্রাণের নামে অভিনয় না করে একবছর স্থায়ী ও টেকসই বাঁধ নির্মাণ করলে প্রতি বছর ত্রাণ দিতে হয় না। উপকূলবাসীরা ত্রাণ চায় না। তারা শুধু টেকসই বাঁধ চায়।
১৯৮৮ সালের বন্যা ছিল বাংলাদেশের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা। এ বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা বাংলাদেশের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছিল। বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় ফসলের। বন্যার কারণে হাজার হাজার কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়। এছাড়া গাছপালা, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, সেতু প্রভৃতির ক্ষতি সাধন হয়। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দেশের ১৯টি জেলার ১৪৭টি উপজেলা প্রকৃতিগত ভাবেই উপকূলীয় এলাকা। তার মধ্যে বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, ভোলা, বরগুনা, লক্ষ্মীপুর, সাতক্ষীরা, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস বেশি আঘাত হানে। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ১৯৬০ সাল ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫০টি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে। ১৯৭০ সালের সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাসে প্রায় ৫ লাখ লোক প্রাণ হারায়। ১৯৮৫ সালেও বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে হানা দেয় সর্বনাশা সাইক্লোন। এ সময় প্রায় দেড় লাখ মানুষ মারা যায়। এছাড়াও ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে আঘাত হানে ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস। এ সময় দেশের ১৬টি জেলার প্রায় ৪৭টি থানা বিধ্বস্ত হয়। এ দানবীয় প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে। এরপর ২০১৯ সালের ৪ মে’র টর্নেডো, ওই বছরের ১০ নভেম্বর বুলবুল, ২০২০ সালের ২০ মে আম্ফান এবং সবশেষে চলতি বছরের ২৩ মে মহা সাইক্লোন ইয়াস আঘাত হানে। ফনি ও বুলবুলের প্রভাবে খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতি না হলেও আম্ফানের তাণ্ডবে তছনছ হয়ে যায় উপকূল। এর ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার আগেই মহা সাইক্লোন ইয়াসের বিরূপ প্রভাবে বেড়িবাঁধ ভেঙে ও ঝড়ের কবলে পড়ে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, গাছপালা ও মাছের ঘেরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যা কাটিয়ে ওঠা উপকূলবাসীর জন্য অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা বা প্রকল্প যে হয়নি তা কিন্তু না। প্রকল্প, পরিকল্পনা সবই হয়েছে, তবে তা শুধু কথায় ও কাগজে। এ বিষয় নিয়ে টেলিভিশন, সংবাদমাধ্যমে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়, কিন্তু কাজের কাজ শূন্য। বাংলাদেশ সরকার দেশকে ডিজিটাল বলে ঘোষণা করলেও অনেক ক্ষেত্রে তা বাস্তবায়িত হয়নি। সমগ্র বাংলাদেশের ডিজিটাইলেশন হওয়ার পথে অনেক সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। যেমন— ঊপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের সংকট নিরসনে বাংলাদেশের কোনো সরকারের আমলেই উন্নয়নমূলক কাজের নজির খুব একটা নেই। দেশের সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে তারা অনেকটাই পিছিয়ে আছে।
অথচ দেশের এক-দশমাংশ এলাকা উপকূল, যার বিস্তৃতি প্রায় ৭১০ কিলোমিটার। এই বিস্তৃত ভূমিতে প্রায় চার কোটি মানুষের বসবাস। দেশের ২৫ শতাংশ নাগরিক যেমন উপকূলে বসবাস করে, তেমনি জাতীয় অর্থনীতিতে জিডিপির কমবেশি ২৫ শতাংশ অবদান রয়েছে উপকূলের। এখন ঊপকূলীয় নদ-নদীর ভাঙনপ্রবণ অঞ্চল চিহ্নিত করে বাঁধ নির্মাণ এবং পুরনো বাঁধ সংস্কার জরুরি। ক্ষেত্রবিশেষে ছয় থেকে সর্বোচ্চ দশ মিটার পর্যন্ত বাঁধ উঁচু করতে হবে। ঊপকূলীয় বাঁধগুলো টেকসই এবং নির্মাণ কাজে যথাযথ তদারক করা হলে আগামী ১০০ বছরেও এই বাঁধের কোনো ক্ষতি হবে না। টেকসই বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন হলে উপকূল এবং উপকূলের চর ও চরাঞ্চলগুলোর জীবন ও জীবিকার গতিপথ ত্বরান্বিত হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা পরিমাপ করা হলেও এখন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীর গতিপ্রকৃতি, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের প্রকৃতিও পরিবর্তিত হচ্ছে। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে এখনই উপকূলীয় অঞ্চল রক্ষায় বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সংরক্ষিত ও সমৃদ্ধ উপকূল গড়ে উঠলে মানুষের জীবনমানেরও উন্নতি ঘটবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, বরেন্দ্র কলেজ, রাজশাহী