শরীফ মুহম্মদ ফয়েজুল আলম
আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার মাহাথির মোহাম্মদের একটি বই পড়েছিলাম Malay Dilemma। সেখানে একটি অধ্যায়ে মাহাথির তার দেশের ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের শিক্ষাদীক্ষায়, কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করে বলেন, ছেলেরা পড়ালেখা করছে না। মেযেরা ছেলেদের চেয়ে পড়ালেখার বিষয় অনেক আগ্রহী। তারা সবাই মাস্টার্স, ডক্টরেট করছে। পড়ালেখা শেষ করার আগে তারা কেউ বিয়ে করছে না, সংসারী হচ্ছে না। অন্যদিকে ছেলেরা স্নাতকও পাস করছে না। পড়ালেখা শেষ করে তারা যখন বিয়ের কথা চিন্তা করছে, তখন একদিকে তাদের অনেক বয়স হয়ে গিয়েছে, অন্যদিকে তারা তাদের উপযুক্ত ছেলেও খুঁজে পায় না। শেষ পর্যন্ত যাদের বিয়ে হচ্ছে, অধিক বয়সের কারণে তাদের সন্তানদের মধ্যে নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে মালয়েশিয়ার ভবিষ্যৎ সংকটাপন্ন অবস্থায় পড়বে।
আমাদের আজ টলস্টয়ের আদলে (How much land does a man require?) প্রশ্ন করা উচিত, How many degrees does a man require? ভারতীয় উপমহাদেশে যত ডক্টরেট আছে, বোধ করি তাবৎ আমেরিকা মহাদেশে তত গ্র্যাজুয়েটও নাই। অথচ তার উল্টোটা হলো পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ নামজাদা পণ্ডিত-বিজ্ঞানী- গবেষক-সাহিত্যিক পশ্চিমা। আমাদের এখানে সবাইকে নিদেনপক্ষে মাস্টার্স করতে হবে। না হলে মান থাকে না। অমুক পারলে তমুক কেন পারবে না। সবাই উচ্চশিক্ষিত হওয়ার প্রতিযোগিতায় মত্ত। কিন্তু সে উচ্চশিক্ষার মান অনুযায়ী দেশে উচ্চমানের কর্মসংস্থান আছে কিনা বা তৈরি হচ্ছে কিনা সেটি পরের ব্যাপার। দেশে সরকারি-বেসরকারি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিবিএ, এমবিএ, অনার্স, মাস্টার্সের ছড়াছড়ি। মান নিয়ে কোন মাথাব্যথা নাই।
অন্যদিকে কাজের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে আমাদের সমাজে ব্যাপক শ্রেণিবৈষম্য রয়েছে। ওটা ছোটলোকের কাজ, ওটা নিচুজাতের কাজ। এটা করা যাবে না। ওটা করা যাবে না। এত বড় পাস দিয়ে এ কাজ কীভাবে করব। এমএ পাস করে কেরানি কীভাবে হব? ব্যবসাকে আমরা বলি দোকানদারি! বিবিএ এমবিএ করে সহকারী হব কীভাবে। সমাজ কী বলবে, লোকজন কী ভাববে! তাই আমাদের হিসাবটাও মিলে না। সরকারি চাকরিতে কয়েক লক্ষ পদ খালি। আবার লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে শিক্ষিত বেকার। হাই-এন্ড এডুকেশনাল কোয়ালিফাইড লোকের জন্য হাই-এন্ড জব প্রয়োজন। কিন্তু কাগজে কলমে অনেকেই কোয়ালিফাইড। নিয়োগের বেলায় কাগজের কোয়ালিটি দিয়ে হয় না। সেখানে চাই কাজের কোয়ালিটি। তাই একদিকে পদ কম, প্রার্থী বেশি। অথচ প্রার্থীরা সেই কম পদের জন্যও প্রত্যাশিত মানসম্পন্ন নয়।
বাংলাদেশ ক্রমশ উন্নয়নশীল থেকে উন্নত দেশের দিকে হাঁটছে। তার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। এটি উন্নয়নের প্রাথমিক ভিত্তি। এর অংশ হিসেবে প্রচুর কল-কারখানা হবে, অবকাঠামো হবে, সুরম্য মার্কেট, শপিং মল হবে, হোটেল-মোটেল, হাসপাতাল-বিনোদনকেন্দ্র হবে। প্রচুর কায়িক শ্রমনির্ভর বা ক্লারিক্যাল কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। কিন্তু আমাদের কর্মের শ্রেণি-বিভাজিত দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকার লোকজন এসব মানের কাজ করতে আগ্রহী নয়। তারা চায় এক্সিকিউটিভ ধরনের চাকরি। সেটি হয়তো পাওয়া যাবে, তবে দেশ উন্নত রাষ্ট্রের মহাসড়কে উঠে গেলে তখন। এখন চলবে কনস্ট্রাকশন, তখন লাগবে মেইনটেন্যান্স।
উন্নয়নের সাথে সাথে বেসরকারি খাতের দ্রুত প্রসার ও বিস্তৃতি ঘটছে। বেসরকারি খাতেও নিয়োগ প্রয়োজন হচ্ছে। বেসরকারি খাতের প্রত্যেকটি পদক্ষেপ সময়, অর্থ এবং মুনাফার নিক্তিতে পরিমাপ করা হয়। সেখানে অযোগ্য-অদক্ষ লোক নিয়োগের কোন সুযোগই নেই। বেসরকারি খাত কাউকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবে না। সুতরাং সেখানে পদ অনুযায়ী যোগ্যতা ও দক্ষতা না থাকলে, কেবল কাগুজে সনদ বা তদবিরের জোরে চাকরির সুবিধা খুবই সীমিত। অনুচ্চারিত সত্য যে, এটি কেবলমাত্র গণখাতেই সম্ভব। কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বেকারত্ব লাঘব গণখাত তথা রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।
ব্যক্তিখাত নিজের খাতিরেই যেমন কাউকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ানোর বিলাসিতা দেখাবে না, গণখাতকে কিন্তু নিজের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্যই প্রয়োজনে তেমন বিলাসিতা দেখাতে হয়। বেকারত্ব বাড়লে যে তার মান থাকে না। আমাদের বেসরকারি খাত বলে, তারাও তাদের চাহিদাসম্পন্ন প্রকৃত যোগ্য লোক পান না। এখানে এসে থামি, ভাবি, গণখাত থাকায় তবু কিছু লোকের আশ্রয় জুটছে। না হলে এরা যেতোটা কোথায়। আবার উল্টোদিকে এটি ভয়ানক সংবাদও বটে। এমনিতেই গণখাত ব্যক্তিখাতের তুলনায় অধিকাংশ মানদণ্ডে পিছিয়ে। তার ওপর যেভাবেই হোক অনেক কাগুজে যোগ্যতার লোক গণখাতে ঢুকে পড়ছেন। আমাদের গণখাতের চাকরির প্রকৃতিই এমন যে, এটা কর্মঠদের অলস আর অলসদের গোঁফখেজুরে করে দেয়। আর বিভিন্ন সভা-সমিতি, আন্দোলন-সংগ্রামের কথা বাদই দিলাম।
ব্যক্তিখাত একদিকে যেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং লোভনীয় হয়ে উঠছে, তার ঠিক বিপরীতটাই ঘটছে গণখাতে। অধিকাংশ প্রকৃত মেধাবী আর যোগ্যরা ক্রমান্বয়ে ব্যক্তিখাতের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। আর গণখাত বিপরীত বৈশিষ্ট্যের কাগুজে মেধাবীদের এসাইলামে পরিণত হচ্ছে। এখন থেকে সাবধান না হলে এভাবে গণখাত ক্রমশ দুর্বল হবার প্রবল আশংকা রয়েছে। অথচ গণখাতের লোকজনই রাষ্ট্রের মূল চালক।
তাই সর্বপ্রথম আমাদের জিজ্ঞেস করতে হবে, আসলেই আমাদের এরকম যে মানেরই হোক গণ উচ্চশিক্ষা প্রয়োজন আছে কিনা? যদি প্রয়োজন থাকে, তাহলে তার সাথে সংগতিপূর্ণ উচ্চমানের চাকরি সৃষ্টি হচ্ছে কিনা? উত্তর যদি না হয়, তাহলে এখানে আমাদের অনেক ভাবার আছে। শ্রেণিবিভাজনের মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসার উদ্যোগ নিতে হবে। কাজগুলো আরও প্রমিত এবং মর্যাদসম্পন্ন করার উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে সেগুলোকে প্রত্যেক স্তরের শিক্ষাগত যোগ্যতার সাথে খাপ খাওয়ানো যায়।
অথবা উচ্চশিক্ষার রাস্তাঘাট সংকীর্ণ ও কঠিন করে দেয়া উচিত। এটি করার নানাবিধ উপায় আছে। সবার গণহারে উচ্চশিক্ষিত হবার দরকার নাই। সবাই যদি উচ্চ শিক্ষিত হয়, তাহলে রাষ্ট্রের আর কাজ কে করবে! শিক্ষার বিভিন্ন স্তরের সাথে সংগতি রেখে সকল চাকরির সুসমন্বয় বিধান করতে হবে। যাতে সব স্তরের শিক্ষাপ্রাপ্ত লোকজনের জন্য চাকরি সহজলভ্য করা যায়। এই সমন্বয় সম্ভব ও সাধন হলে বেকারত্বের পরিসংখ্যান অনেক সহজ হয়ে যাবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক