ঈদে ভোগান্তির আশঙ্কা

ছবি : সংগৃহীত

যোগাযোগ

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত রেলপথ

ঈদে ভোগান্তির আশঙ্কা

  • রায়হান উল্লাহ
  • প্রকাশিত ২৫ জুলাই, ২০১৯

বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। এর ফলে সারা দেশে রেলওয়ের ৭টি রুটের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৩৩ কিলোমিটার রেলপথ। বিভিন্ন স্থানে রেললাইন বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। কোথাও কোথাও রেলসড়ক ভেঙে পানির তোড়ে ভেসে গেছে। কোথাও মাটি ও পাথরসহ দেবে গেছে রেলপথ। এ অবস্থায় বর্তমানে রেল চলাচলে ব্যাপক বিঘ্ন ঘটছে। রেলের কয়েকটি স্টেশনের সঙ্গে ঢাকার এখনো সরাসরি রেল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এসব লাইন মেরামতে মাসখানেক সময় লাগতে পারে। অবকাঠামো যেভাবে ধ্বংস হয়েছে, তা সংস্কার করা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। অনেক স্থানে বিকল্প রুট ব্যবহার করে ট্রেন চলাচল করছে। এতে সবকটি স্টেশন ধরা ট্রেনগুলোর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে রেলযাত্রীদের ভোগান্তি বেড়েছে বহুগুণে। এর মাঝে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা, বন্যায় রেলপথের ওপর প্রভাব পড়বে ঈদুল আজহার ট্রেনযাত্রায়। প্রসঙ্গত, কোরবানির ঈদের ছুটি শুরু হতে পারে আগামী ১০ বা ১১ আগস্ট।

সম্প্রতি চলমান বন্যায় রেলওয়ের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এতে বলা হয়, রেলের ৭টি রুট বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে রেলওয়ের বেনারপাড়া-বাদিয়াখালী (৩৬৮/০-৩৭৪/৪) সেকশনে রেললাইনের ওপর দিয়ে এখনো পানি প্রবাহিত হচ্ছে। যদিও ছোট ছোট স্পটে মেরামতকাজ চলছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুরোপুরি কাজ শেষ করতে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত সময় লাগবে। তারা এও বলছেন, এ রুটে ঈদের আগে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা নেই। একইভাবে বালিয়াখালী-গাইবান্ধা রুটে রেললাইনের ওপর দিয়ে তীব্র স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। এই রুটটি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ৫টি স্থানে রেললাইনের নিচের মাটি, পাথর ও বালি সরে গিয়ে গভীর গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এ রুটের ৩৭৪/৪-৩৭৪/৬ সেকশনে রেলওয়ে লাইনের নিচ থেকে মাটি ও পাথর সরে গিয়ে ১৫০ ফুট দৈর্ঘ্যের ১৬ ফুট গভীর একটি গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। একই রুটের ৩৭৫/০-২ সেকশনে ১৫ ফুট দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট ১০ ফুট গভীরতায় দুটি গর্ত সৃষ্টি হয়। এছাড়া ৩৭৫/২-৪ ও ৩৭৬/০-৩৭৬/৪ সেকশনে ৫০০ ও ৬০০ ফুট দৈর্ঘ্যের দুটি ১৮ ফুট গভীরতায় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।

এছাড়া বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে রেললাইনের নিচ থেকে মাটি ও পাথর সরে গেছে। যার আনুমানিক দৈর্ঘ্য ৩০০ ফুট। এই স্থানগুলোর ছোট ছোট স্পটে বিভাগীয়ভাবে বালির বস্তা দিয়ে মেরামত চলছে।

অন্যদিকে বালাবাড়ী-রমনা রুটের ৪৮৪/৬-৮ সেকশন দিয়ে পানি তীব্রবেগে প্রবাহিত হওয়ায় ১৩ ফুট গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৩০০ ফুট। একই রুটের ৪৮৪/৮-৪৮৫/০ সেকশনেও ১০০ ফুট দৈর্ঘ্যের ১২ ফুট গভীর গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এই সেকশনের অপর একটি স্পটে ৪০ ফুট দীর্ঘ ও ৭ ফুট গভীরতার একটি গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।

এর মাঝে হাসিমপুর-দোহাজারী রুটের ৪৫/০-৪৭/১ সেকশনে অতিবর্ষণে পাশের শঙ্খ নদী ওভার ফ্লো হয়ে ৪৪/০-৪৬/০ কিলোমিটার পর্যন্ত রেলওয়ের ট্র্যাক এবং দোহাজারী ইয়ার্ড পানিতে তলিয়ে গেছে। এ রুটে ১৫ জুলাই থেকে ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখা হয়। এতে বালি-মাটি দিয়ে প্যাকিং করে ১৭ জুলাই থেকে ট্রেন চলাচল শুরু করা হয়।

অন্যদিকে মেলান্দহ-দেওয়ানগঞ্জ বাজার রুটের ৪১৫/৪-৪৩৯/০ সেকশন এলাকায় ৪৩৪/৮-৯ কিলোমিটারে ৫০ ফুট দৈর্ঘ্যের ও ৫-১৮ ফুট গভীরতায় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এটি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ মাটি ও বালি দিয়ে ভরাট করে। ভবিষ্যতে এই স্থানে স্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে সেতু নির্মাণের পরিকল্পনার কথা জানানো হয় প্রতিবেদনে।

কয়েকটি ট্রেনের রুট পরিবর্তন : রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বন্যার কারণে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের জামালপুর-দেওয়ানগঞ্জ বাজার সেকশনের বিভিন্ন স্থানে এবং জামালপুর-তারাকান্দি সেকশনের সরিষাবাড়ী-বয়ড়া স্টেশনের মধ্যবর্তী স্থানে রেললাইন পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এর ফলে আন্তঃনগর তিস্তা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস ট্রেনসহ ঢাকা, ময়মনসিংহ এবং চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে ছেড়ে আসা অন্যান্য মেইল, এক্সপ্রেস, কমিউটার ও লোকাল ট্রেনগুলো দেওয়ানগঞ্জ বাজার এবং তারাকান্দি/বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব পর্যন্ত চলাচল না করে জামালপুর স্টেশন পর্যন্ত চলাচল করছে।

অন্যদিকে পশ্চিমাঞ্চলের বাদিয়াখালী রোড-ত্রিমোহনী জংশন স্টেশনের মধ্যবর্তী স্থানে রেললাইন বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। এর ফলে ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া আন্তঃনগর লালমনি এক্সপ্রেস ট্রেনটি ঢাকা-সান্তাহার-বগুড়া-বোনারপাড়া-কাউনিয়া-লালমনিরহাট রুটের পরিবর্তে ঢাকা সান্তাহার-পার্বতীপুর-লালমনিরহাট রুটে এবং রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনটি ঢাকা সান্তাহার-বগুড়া-বোনারপাড়া-কাউনিয়া-রংপুর রুটের পরিবর্তে ঢাকা-সান্তাহার-পার্বতীপুর-রংপুর রুটে চলাচল করছে।

এছাড়া আন্তঃনগর ৭৬৭/৭৬৮ দোলনচাঁপা এক্সপ্রেস ট্রেনটি দিনাজপুর সান্তাহার দিনাজপুর রুটের পরিবর্তে দিনাজপুর গাইবান্ধা-দিনাজপুর রুটে এবং আন্তঃনগর ৭১৩-৭১৪ করতোয়া এক্সপ্রেস ট্রেনটি সান্তাহার-বুড়িমারী-সান্তাহার রুটের পরিবর্তে সান্তাহার-বোনারপাড়া-সান্তাহার পর্যন্ত চলাচল করছে। ২১/২২ নং পদ্মরাগ এক্সপ্রেস ট্রেন বাদিয়াখালী স্টেশনে আটকা পড়ায় সান্তাহার-লালমনিরহাট-সান্তাহার রুটে আপাতত চলাচল করবে না।

অন্যদিকে পাঁচপীর-উলিপুর স্টেশনের মধ্যবর্তী স্থানের রেললাইন বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় লোকাল ট্রেন পার্বতীপুর-কুড়িগ্রাম-পার্বতীপুর এবং লোকাল ট্রেন তিস্তা জংশন কুড়িগ্রাম-তিস্তা জংশনের মধ্যে চলাচল করছে।

ক্ষতিগ্রস্ত ৩৩ কিলোমিটার রেলপথ : বন্যায় পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল রেলের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৩৩ কিলোমিটার পথ। অনেক জায়গায় রেললাইন গভীরভাবে দেবে গেছে। তবে কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সেটা এখনো নির্ধারণ করতে পারেননি রেল কর্মকর্তারা। এতে রেলের কয়েকটি স্টেশন থেকে ঢাকার সঙ্গে এখনো সরাসরি রেল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।

রেল সূত্রে জানা যায়, চলতি বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে গাইবান্ধা জেলায়। এ রেলপথে প্রায় ৭ কিলোমিটার রেলপথ গভীরভাবে দেবে গেছে। এছাড়া জামালপুর জেলায় ২৫ কিলোমিটার ও কুড়িগ্রাম জেলায় অর্ধ কিলোমিটার রেলপথ ভেঙেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, অতিবর্ষণ বা বন্যায় নড়বড়ে রেললাইনের নিচের মাটি নরম হয়ে যায়। এতে রেললাইন, পাথর ও স্লিপার সরে যায়। আর পানির তোড়ে দুই পাশের মাটি খসে যাওয়ায় প্রায় সময়ই দেবে যায় ব্রিজ। সব মিলিয়ে প্রতিমুহূর্তেই থাকে ট্রেনের লাইনচ্যুতি হওয়াসহ বড় ধরনের দুর্ঘটনার শঙ্কা। তাদের মত, দীর্ঘদিনের এ সমস্যা সমাধানে স্থায়ীভাবে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। জরুরি ভিত্তিতে এখনই টেকসই সংস্কারকাজ শুরু না করলে চলতি বর্ষায় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) খন্দকার শহিদুল ইসলাম জানান, একটি বিশেষ টিম মাঠ পর্যবেক্ষণ করছে। পানি সীমা অতিক্রম করলেই ট্রেন চলাচল বন্ধ করা দেওয়া হচ্ছে।

রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) আনোয়ারুল হক বলেন, বর্ষা মৌসুমে আমাদের আতঙ্কের পাশাপাশি উদ্বেগও বাড়ছে। এবার বর্ষা মোকাবেলায় চট্টগ্রাম-ফেনী, চট্টগ্রাম-ষোলশহর-দোহাজারী, ষোলশহর-মাঝিরহাট, আখাউড়া-সিলেট, আখাউড়া-কুমিল্লা, রংপুরের কাউনিয়া-লালমনিরহাট, কাউনিয়া-রংপুর, রংপুর-পাবর্তীপুর, বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম-পূর্ব, টঙ্গী-টঙ্গাইল রেলওয়ে এলাকাসহ প্রায় ৪৫০ কিলোমিটার রেলপথ বিশেষ নজরে রাখছি।

রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মিয়া জাহান বলেন, বন্যার কারণে রেললাইনের অনেক ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে ১৬ ফুট গভীরতায় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। স্রোতের কারণে রেললাইনের পাথর ও মাটি চলে গেছে। সেগুলো মেরামত করার কাজ চলছে। ঈদুল আজহার আগে আমরা সব ঠিক করার চেষ্টা করছি। পরিস্থিতির যদি অবনতি হয়, তাহলে ঈদযাত্রায় সমস্যা হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

রেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ শামসুজ্জামান বলেন, বন্যায় অনেক স্থানে রেলপথ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা কাজ শুরু করেছি, আশা করি ২৮ জুলাইয়ের মধ্যে সংস্কারকাজ শেষ করতে পারব। তিনি আরো জানান, নতুন করে বন্যা না হলে ঈদের আগেই সব কাজ শেষ হবে।

রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, বন্যার কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে রেলপথ পানিতে তলিয়ে গেছে। এ কারণে কয়েকটি রুটে ট্রেন চলাচল কিছুটা বিঘ্নিত হচ্ছে। তবে যাত্রীদের কথা বিবেচনায় রেখে আমরা সম্ভাব্য সব বিকল্প রুট ব্যবহার করে যাচ্ছি। বন্যা মোকাবেলায় রেলওয়ের প্রকৌশলীরা সার্বক্ষণিক মাঠপর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানান তিনি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads