ফারহান ইশরাক
সাম্প্রতিক সময়ে ইস্তান্বুুল শহরের বুক চিরে একটি খাল খননের প্রকল্প নিয়ে আলোচনার ঝড় বইছে আন্তর্জাতিকমহলে। তুরস্কের উচ্চাভিলাষী প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান কেন খালটি খনন করতে চান, তার সঠিক উত্তর এই মুহূর্তে জানার সুযোগ নেই। তাই এটি নিয়ে তর্ক-বিতর্কের পাল্লাও ভারী হচ্ছে দিনে দিনে। এরদোয়ানের এই ‘ক্রেজি প্রজেক্ট’ ঘিরে দুটি পক্ষ তৈরি হয়েছে তার দেশে; এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সরকারের মধ্যেও। আসলে বর্তমান সময়ে পৃথিবীর দেশগুলো অন্য যে-কোনো সময়ের তুলনায় একে অপরের সাথে বেশি সম্পর্কযুক্ত। এক দেশের সিদ্ধান্ত তাই অন্য একটি দেশকে ভাবিয়েও তোলে খুব বেশি। আবার বিগত কয়েক বছরে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তুরস্কের উত্থানকেও এর সাথে জড়িয়ে ফেলছেন অনেকে।
তুরস্কের সরকারের পক্ষ থেকে ইস্তান্বুুল ক্যানেলকে অর্থনৈতিক প্রজেক্ট বলা হলেও, এটিকে তুরস্কের নতুন ‘লাইন অব ডিফেন্স’ বা সামরিক পরিকল্পনার অংশ বলে মনে করা হচ্ছে। সেইসাথে তুরস্ককে বিশ্বমঞ্চে শক্তিশালী অবস্থানে নেওয়ার যে স্বপ্ন এরদোয়ান দেখছেন, সেটির সাথে যোগ করে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়েছেন অনেকেই। বর্তমান শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে এসে একটি তত্ত্ব সারা পৃথিবীতে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। মিডিয়া স্বীকৃত কোনো নাম না থাকলেও এটিকে ‘সুপার পাওয়ার থিওরি’ বা ‘পরাশক্তি তত্ত্ব’ হিসেবে নামকরণ করা যেতে পারে। কোনো একটি দেশ যখনই শিক্ষায়, শিল্পে, বাণিজ্যে, সমরাস্ত্রে সমৃদ্ধ হতে শুরু করেছে, তখনই মনে করা হচ্ছে দেশটি সুপার পাওয়ার তথা বিশ্বের পরাশক্তি হতে চায়। দেশগুলোর কূটনৈতিক বক্তব্য, আগ্রাসী কৌশল এই আলোচনার হালে পানি দিলেও বাস্তবেই কি দেশগুলো পরাশক্তি হতে চায়, নাকি এটি তাদের জোরালো অগ্রগামী যাত্রাকে স্তিমিত করে দিতে মিডিয়ার অব্যর্থ প্রয়াস, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। এ কথা সবারই জানা, বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমগুলো নিয়ন্ত্রণ করে পশ্চিমা বিশ্ব, সম্মিলিতভাবে যারা পুরো পৃথিবীরই নিয়ন্ত্রক। হতে পারে এটি বনে নতুন সিংহের আগমনকে থামিয়ে দেওয়ার আত্মরক্ষা পদ্ধতিরই একটি কৌশল মাত্র। এক বনে দুই সিংহ থাকার নিয়ম প্রকৃতি দেয়নি। তাই নতুন পরাশক্তির উত্থান হতে থাকলে বর্তমান পরাশক্তির গদি নড়েচড়ে ওঠাটাই স্বাভাবিক।
তবে এ কথা যেমন সত্য, ‘সুপার পাওয়ার থিওরি’র অন্য দিকটিও সমানভাবে সত্য। বিদ্যমান পরাশক্তিগুলোই কেবল অন্য দেশগুলোকে থামিয়ে দিতে চায় না, বরং কিছু দেশ বাস্তবেই চায় বিশ্বের পরাশক্তি হয়ে উঠতে। এর পেছনের কারণগুলোও একটু বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। গত শতাব্দীতে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে চলা স্নায়ুযুদ্ধ শেষে অনানুষ্ঠানিক বিজয় ঘটে পুঁজিবাদের আদর্শপন্থি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। নতুন শতাব্দীর প্রাক্কালে স্নায়ুযুদ্ধের ফলাফল যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বের বুকে একচ্ছত্র আধিপত্যের সুযোগ করে দেয়। সেই সুযোগকে তারা কাজে লাগিয়েছিল সর্বক্ষেত্রেই। চলমান এই সহস্রাব্দ যখন শুরু হয়, তখন বিশ্বজুড়ে মার্কিনিদের জয়জয়কার। পৃথিবীর নানা প্রান্তে তাদের সৈন্যরা ঘাঁটি গেড়েছে। মহাসাগরগুলোতে ভেসে বেড়াচ্ছে মার্কিন নৌবহর। সারা পৃথিবীর মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু তখন নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন ডিসির মতো শহরগুলো। বিশ্বব্যাপী মার্কিনদের প্রভাব, প্রতিপত্তি, শক্তি, সামর্থ্য, সক্ষমতার গগণবিদারী গর্জন যেন মানুষের পৃথিবীতে অলৌকিকতার দেখা পাওয়ার মতো ঘটনা। গত শতাব্দীর শেষ দশক থেকে এই শতাব্দীর প্রথম দুটি দশকে পৃথিবীজুড়ে রাজত্ব কায়েম করেছে মার্কিনিরা। সবসময় যে বলপ্রয়োগ কিংবা কূটনৈতিক কৌশলে তাদের এ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এমনটি নয়। শিক্ষা, গবেষণা, চিকিৎসা, প্রযুক্তি, বাণিজ্যের মাধ্যমে তারা সমস্ত পৃথিবীতে সাফল্যের ছড়ি ঘুরিয়েছে। নিজেদের আয়ত্তে এনেছে পুরো বিশ্বব্যবস্থাকে। গত দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে মার্কিন আধিপত্যের এই সূর্যালোক ফিকে হয়ে আসতে শুরু করলেও পৃথিবীতে এখনো পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ কোনো পরাশক্তির উদ্ভব ঘটেনি। এখনো এই দেশটি বৈশ্বিক সমাজব্যবস্থার প্রধান ক্রীড়নক। উচ্চাকাঙ্ক্ষা জন্মগতভাবেই মানবজাতির প্রধানতম বৈশিষ্ট্যের একটি। তাই যখন একটি রাষ্ট্রের দিগ্বিজয়ী ক্ষমতা দৃষ্টিগোচর হয়, তখন রাষ্ট্রগুলোও সে শক্তি অর্জনের স্বপ্ন দেখে, হয় অনুপ্রাণিত; কিঞ্চিৎ ঈর্ষান্বিতও বটে। এভাবেই দেশগুলো স্বপ্ন দেখে সুপার পাওয়ার হয়ে ওঠার, হতে চায় বৈশ্বিক পরিস্থিতির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক।
একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এসে প্রযুক্তির ব্যবহার সারা পৃথিবীর মানুষকে সংযুক্ত করেছে। সেই সাথে মুক্তবাজার অর্থনীতি খুলে দিয়েছে অবারিত সম্ভাবনার দুয়ার। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশ এর সুফল ভোগ করতে শুরু করেছে। বিশেষ করে আঞ্চলিক শক্তিধর দেশগুলো এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি করেছে। পথ যত কঠিন আর কণ্টকাকীর্ণই হোক, চীন, ভারতের মতো নব্য শক্তিধর দেশগুলো পরাশক্তি হওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কখনো পারমাণবিক শক্তি, কখনো আঞ্চলিক রাজনীতি তাদের যাত্রায় সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু সাথে সাথে তারা এও বুঝেছে যে, সুপার পাওয়ার হয়ে ওঠা চাট্টিখানি কথা নয়। রয়েছে নানা বাধা-বিপত্তি, চ্যালেঞ্জ। আবার যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত মিডিয়াগুলোর লাগাম টেনে ধরার কৌশলও রয়েছে সমান্তরালে। এতসব চাপ সামলিয়ে নতুন একটি পরাশক্তির উত্থান বেশ কঠিনই বলা যায়।
অন্যদিকে বিগত সময় আর বর্তমানের প্রেক্ষাপটে রয়েছে বিস্তর ব্যবধান। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় কোনো দেশের পক্ষে এককভাবে পরাশক্তি হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। নানা বাস্তবতায় বৈশ্বিক অর্থনীতি, রাজনীতি, কূটনীতির ধরন বদলেছে। সামনের দিনগুলোতে কোনো দেশ সত্যিকার অর্থেই পরাশক্তি হয়ে উঠতে চাইলে তাকে হয়তো আঞ্চলিক বা সামরিক জোট গঠন করতে হবে। ন্যাটো কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়নকে এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে ধরা যেতে পারে। আবার এমনও হতে পারে, নতুন বিশ্বব্যবস্থায় পরাশক্তি বলে কিছুই থাকবে না। দেশগুলো একে অপরের সাথে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে চলবে। একক আধিপত্য অর্জনের জন্য যে সময় ও সম্পদ বিনিয়োগের প্রয়োজন তা বিনিয়োগ করবে অন্য কোনো সেক্টরে। এটি বলার কারণ হলো, গত কয়েক দশকে চীনের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উত্থান আর আগ্রাসী কূটনীতি বিশ্বের বুকে নতুন পরাশক্তি অভ্যুদয়ের সম্ভাবনা তৈরি করেছিল। তবে সেই সম্ভাবনার পতন ঘটতেও বেশি সময় লাগেনি। দক্ষিণ এশিয়ার আরেক পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র ভারত অল্প কিছুদিনের জন্য হলেও পরাশক্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল। তবে সময়ের যাত্রায় তারাও বুঝতে পেরেছে, এ তো সহজ কথা নয়!
তুরস্ক নতুন পরাশক্তি হবে নাকি পরাশক্তিদের নতুন জোট গঠন করে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবে, সে প্রশ্নের উত্তর হয়তো কয়েক বছরের মধ্যেই বিশ্ববাসী জেনে যাবে। তবে বিশ্ব রাজনীতিতে একটা আমূল পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে চলতি দশকেই। পশ্চিমকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা যে ভেঙে পড়েছে, সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্বকে তাই শাসন করতে হলে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের নেতৃত্বের মাঝে ব্যালেন্স সৃষ্টি করতে হবে। শক্তিধর দেশগুলোর নতুন মেরূকরণই আমাদের অনুমাননির্ভর ‘সুপার পাওয়ার থিওরি’র ফলাফলকে নিশ্চিত করবে। সময়ই বলে দেবে, আগামীতে কার জয় হতে যাচ্ছে। নতুন পরাশক্তির নাকি পরাশক্তিহীন পৃথিবীর।
লেখক : নিবন্ধকার
farhanishrak1971@gmail.com