কেফায়েত উল্লাহ,ইন্দুরকানী (পিরোজপুর) থেকে
সাপ ভয় পায় না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। প্রাণবিধ্বংসী ভয়ঙ্কর এ প্রজাতি তার বিষাক্ত ছোবলে নিমিষেই ধ্বংস করে দিতে পারে মানুষের জীবন। আঘাত পেলে ছাড় দেওয়ার পাত্র নয় বিষেভরা সর্পজাত। তবে ব্যথা না পেলে এরা কাউকে দংশন করে না। ব্যথাপ্রাপ্ত না হলে সাপ কাউকে দংশিবে না, এটা জানা সত্ত্বেও কোনো মানুষ সাপের সংস্পর্শে যাওয়ার সাহস দেখাতে পারে না। একমাত্র মানুষের মাঝে থাকা বেদে গোত্রই পারে ভয়ানক বিষাক্ত সরীসৃপ প্রাণীকে। তাদের তন্ত্রমন্ত্র ও কানুন-কায়দায় মাথা হার মানতে বাধ্য হয় এই প্রাণীরা। সাপ নিয়ে সর্বদা খেলায় মত্ত বেদে তবে দু:খ হয় যখন একদল অত্যাচারীজনের অসভ্যপনায় জ্বলেপুড়ে ছারখার হতে হয় বেদেদের। ইন্দুরকানী ঘুরে রিপোর্ট করেছেন কেফায়েত উল্লাহ
ইন্দুরকানীতে বঞ্চিত বেদেরা। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থন, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ সব কিছুইতে টানাপোড়েন তাদের। সাপ খেলা ও কবিরাজি বেদেদের জীবিকার অন্যতম মাধ্যম। কিন্তু বর্তমানে আগের মত সাপ পাওয়া যাচ্ছে না। আবার গ্রাম্য লোকজন অনেকটা সচেতন হওয়ায় বেদেদের চিকিৎসা গ্রহন করছেন না। ফলে কমে গিয়েছে তাদের আয়ের পরিমান। বাধ্য হয়েই অনাহার অর্ধানাহারে দিনাতিপাত করছে তারা।
সরেজমিনে দেখা যায়, তাদের শরিরে পোশাক পরিচ্ছেদ খুবই ছেড়া ও নোংরা। এমন পরিস্থির কথা জানতে চাইলে ইন্দুরকানীর বেদে পল্লীর তহিত (২৬) জানান , খেতেই পারি না। তার পরে আবার নতুন পোশাক! আমরা মানুষের বাসা থেকে চেয়ে পুরাতন পোশাক পেলে নিয়ে পরি এবং বাচ্চদের পরাই। আর থাকার জায়গা বলতে খোলা মাঠে পলিথিনের তাবু টানিয়ে অস্থায়ী ঘর নির্মান করে বসবাস করছেন বিভিন্ন এলাকায় রোদ, বৃষ্টি ও শীতে অত্যান্ত করুন ভাবে দিন পর করে চলছে। বেদে গোষ্ঠির প্রায় ৯৫ ভাগ পুষ্ঠিহীনতায় ভুগছে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাসের কারেন বিভিন্ন প্রকার রোগে ভুগছে তারা। বেদে পরিবার প্রায় ৯০ ভাগ নিরক্ষর। সরকার বিভিন্ন প্রাকার সুযোগসুুবিধা দিলেও তারা শিক্ষা ক্ষেত্রে পিছিয়ে। যার কারনে বাল্যবিবাহ,অধিক জন্ম হারসহ বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে ।
বেদে সম্প্রদায় দেশের প্রায় বিভিন্ন অঞ্চলে ১ থেকে ২ মাস অবস্থান করে। বিশেষ করে আগে তারা উপকুলীয় এলাকায় নৌ বহরে এসে ব্যবসা পরিচালনা করতেন। কিন্তু বর্তমানে তারা নৌকা তৈরীর কাঠের অভাব এবং সড়ক পথে যাতায়াতের সুবিধা বৃদ্ধি ও নদী কমে যাওয়ায় তাদের আবাসস্থলের পরিবর্তন করেছেন। নৌকা বাদ দিয়ে স্থলেই অস্থায়ী ভাবে বাস করে ব্যবসা করছেন তারা।
বর্তমানে ইন্দুরকানী শহীদ ফজলুল হক মনি সেতুর নিচে মুন্সিগঞ্জ থেকে আসা বেদে বহর অবস্থান করছেন। সেতুর নিচেই তারা ঘাটি গেড়েছেন। এক সময় চাড়াখালী খালে ও বলেশ্বর নদে বেদেরা নৌ বহর নিয়ে এসে দীর্ঘ দিন থেকে ব্যবসা করতেন। কিন্তু এখন তারা ঠিকই এই এলাকায় ব্যবসা করছেন তবে নৌ বহর নিয়ে নয়। থাকছেন পলিথিনের অস্থায়ী কুরে ঘর বানিয়ে।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোঃ বেলায়েত হোসেন জানান, আগে এক সময় এই বলেশ্বর নদের বিভিন্ন স্থানে বেদেদের নৌ বহর দেখা যেত। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে সেই নৌ বহর আর দেখা যাচ্ছে না। এই এলাকায় তারা পলিথিন দিয়ে কুরে ঘর বানিয়ে থাকছে।
সুনামগঞ্জ থেকে আসা বেদে বহরের রফিক (৩৩) জানান, আমাদের অবস্থা আর আগের মত নাই। বেদেদের যে ব্যবসা ছিল তা এখন পরিবর্তন করতে হচ্ছে। আগের মত এখন আর গ্রামে ব্যবসা হচ্ছে না। সাপও পাওয়া যাচ্ছে না।
সমাজসেবা অধিদফতরের হিসাবে দেশে যাযাবরের সংখ্যা প্রায় ৬৩ লাখ; যার মধ্যে দলিত ৪০ লাখ, বেদে ৮ লাখ এবং হরজিন ১৫ লাখ। ১৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে আরাকানরাজ বল্লার রাজার সাথে বেদেরা প্রথম ঢাকায় আসে। সেসময় তারা বিক্রমপুরে বসবাস শুরু করে। তারপরে সেখান থেকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ও আসামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে।