ধর্ম

ইতিহাসের মহানায়ক : ইমাম হারুন (রহ.)

  • প্রকাশিত ৩ জানুয়ারি, ২০২১

মুজীব রহমান

 

 

 

দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, ডেসমন্ড টুটু, স্টিব বিকো ও সিসুলুসহ আরো অনেক মহান নেতাদের নামই আমরা জানি। যারা তাদের জীবনের সর্বস্ব দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। কিন্তু আমরা জানি না, দক্ষিণ আফ্রিকার সেই বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা ইমাম আব্দুল্লাহ হারুনের কথা। ১৯৪৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল পার্টি ক্ষমতায় আসার পর ‘জাতিগত বিচ্ছিন্নতা’র নীতিগুলোকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বত্র বর্ণবাদকে তারা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল শেতাঙ্গদের কৃষ্ণাঙ্গ ও অন্যান্য জাতির ওপর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অগ্রাধিকার দেওয়া। সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে অন্যান্য জাতিকে বিচ্ছিন্ন করা, যা ছিল স্পষ্ট বর্ণবাদ ও বৈষম্যমূলকনীতি। এ বর্ণবাদী সরকারের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে অনেকেই মুখ খুলতে শুরু করেন। তখন ইমাম হারুনের কণ্ঠস্বরও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল। মাঠে ময়দানে মসজিদের মিম্বরে সর্বত্রই তখন ইমাম হারুনের কণ্ঠ উজ্জীবিত হতো বর্ণবাদের মোকাবিলায়।

১৯৬১ সালের ৭ মে কেপটাউনের ড্রিল হলে তৎকালীন বর্ণবাদবিষয়ক আইনের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠে সরকারকে হুঁশিয়ার করে দিলেন তিনি। তিনি সেদিন সরকারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষের সামনে বলেছিলেন, এ আইন সম্পূর্ণ অমানবিক, বর্বর, মানবতা ও ইসলামবিরোধী। এ আইন দেশের মানুষের মৌলিক অধিকারকে ক্ষুণ্ন করছে। জনগণের মাঝে জাতিগত ফাটল সৃষ্টি করছে।

এরপর থেকেই সরকার বিভিন্ন সময় তাকে হয়রানি করতে থাকে। তাকে নজরদারিতে রাখতে শুরু করে। তবু তিনি থেমে থাকেননি। নিজের অনুসারীদের সাথে নিয়ে বর্ণবাদ আইনের বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন আমৃত্যু।

১৯৬৮ সালে তিনি সৌদি আরবে বাদশাহ ফয়সাল ও তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী হাসান আব্দুল্লাহর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফেরার পরপরই ১৯৬৯ সালের ২৮ মে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার মিথ্যা মামলা দিয়ে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। এরপর জেলখানায় একশ ত্রিশ দিন বন্দি থাকার পর ১৯৬৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর পুলিশের অবর্ণনীয় নির্যাতনে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। তাকে জেলখানায় এমন অমানবিক নির্যাতন করা হতো যে, তিনি তা সহ্য না করতে পেরে চিৎকার করে বলতেন, ‘হে আল্লাহ আপনি আমাকে আপনার কাছে উঠিয়ে নিন। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আমার এ কষ্টের বিনিময়ে আমার জাতিকে বর্ণবাদ থেকে মুক্তি দিন।’ মৃত্যুর পর তার শরীরে পুলিশি নির্যাতনের ২৭টিরও বেশি দাগ ছিল। লাঠি দিয়ে পিটিয়ে তার বুকের দুটি হাড়ও ভেঙে ফেলা হয়েছিল। তার ওপর সরকারের এ বর্বর নির্যাতনের কারণে সাধারণ জনগণের মাঝে সরকারবিরোধী ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে। তার মৃত্যুর পর ২৯ সেপ্টেম্বর ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে চল্লিশ হাজার মানুষ রাজপথে নেমে এসেছিল। তারা তার লাশের খাটিয়াকে সামনে রেখে দশ কিলোমিটার পথ মিছিল করে তাকে মুসলিম গোরস্তানে দাফন করতে নিয়ে গিয়েছিল।

ইমাম আব্দুল্লাহ হারুন ছিলেন রাজধানী কেপ টাউনের ক্লেরামন্ট শহরের আলজামিয়া মস্কোর ইমাম ও খতিব। তিনি তরুণ বয়সেই এ মসজিদের ইমাম হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। অল্প বয়সেই মসজিদের খতিব নিয়োগ হওয়াই অনেকের মাঝেই খুব কানাঘুষা চলছিল- ‘আরে, ‘এ পিচ্চি ছেলে আমাদের ইমামতি করতে পারবে তো!’ অল্পদিনের মধ্যেই ইমাম হারুন তার তাকওয়া, বিনয় ও নেতৃত্বের গুণাবলি দিয়ে সকলের মন জয় করে নিয়েছিলেন। অল্প কয়েক দিনেই তিনি সকলের সুপরিচিত ও পছন্দের মানুষ হয়ে ওঠেন। ১৯৫৮ সালে তিনি ‘ক্লেরামন্ট মুসলিম ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশন’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে তিনি তরুণদের অগ্রাধিকার দিতেন। এ সংগঠনের উদ্যোগে গরিব ও অসহায় মানুষদের জন্য কাজ করতেন। তাদের দিকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। একদল মেধাবী তরুণকে নিয়ে তিনি একটি শিক্ষাবিষয়ক গবেষণা কেন্দ্রও তৈরি করেছিলেন। ১৯৫৯ সাল থেকে ইসলামিক মিরর নামে একটি মাসিক বুলেটিন বের করতে লাগলেন। এরপর ১৯৬০ সালে দেশের মুসলিমদের একমাত্র পত্রিকা ‘মুসলিম নিউজ’-এর অতিথি সম্পাদক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।

ইমাম হারুনের জন্ম ১৯২৪ সনের ফেব্রুয়ারি মাসের আট তারিখ, ক্লেরামন্ট শহরের নিউল্যান্ডস নামক গ্রামে। তিনি বংশগতভাবে ছিলেন মালয় সম্প্রদায়ের লোক। পাঁচ ভাইবোনের মাঝে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। শিশুকালেই তার মা মারা যায়। এরপর তার চাচির কাছে বড় হতে থাকেন। প্রাথমিক লেখাপড়া শেষ করেন তার গ্রামের তাল ফালাহ নামক এক স্কুলে। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য চলে যান মক্কায়। সেখান থেকে ফিরে এসে ১৯৫০ সালে গ্যালিনা সাদান নামক এক সম্ভ্রান্ত তরুণীকে বিয়ে করেন। তিনি সাংসারিক জীবনে ছিলেন তিন সন্তানের জনক।

ইমাম হারুন ছিলেন অন্য দশজন ইমামের মতোই সাধারণ একজন ইমাম। কিন্তু তার রাজনৈতিক বিচক্ষণতা তৎকালীন ইমামদের থেকে তাকে আলাদা করে রেখেছিল। তিনি সুস্পষ্টই জানতেন বর্ণবাদ আইন ইসলামবিরোধী। মানুষের গায়ের রং কোনোভাবেই তার মানবতার মাপকাঠি হতে পারে না। ইসলাম এটা সমর্থন করে না। এ আইন মজলুমকে আরো মজলুম বানাবে। দরিদ্রদের ঠেলে দেবে আরো দারিদ্র্যের দিকে। তিনি এর মোকাবিলা করাকে নিজের ঈমানি দায়িত্ব মনে করেছিলেন। তাই তিনি চুপ থাকতে পারেননি। মাঠে ময়দানে মসজিদের মিম্বরে সর্বত্রই গর্জে উঠেছিলেন। যেখানেই বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভ কিংবা সমাবেশ হতো তিনি তাতে সমর্থন জানাতেন। ধর্মঘটের সময়গুলোতে কেপটাউনবাসীকে তিনি রোজা রাখারও আমন্ত্রণ জানাতেন।

ইমাম আব্দুল্লাহ হারুনকে দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বশ্রেণির মানুষ এখনো শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। তার নামে সন্তানদের নাম রাখে আব্দুল্লাহ হারুন। দক্ষিণ আফ্রিকার মায়েরা তাদের সন্তানকে ইমাম হারুনের বীরত্বের গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়ায়। কিন্তু আফসোসের বিষয় হচ্ছে, মুসলিম বিশ্ব ইমাম হারুনের দুঃসাহসিকতা ও বীরত্বের গল্প খুব কমই স্মরণ রেখেছে।

 

লেখক : আলেম, প্রাবন্ধিক, শিকড় সাহিত্য মাহফিল

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads