আহতদের পুনর্বাসন প্রয়োজন

ফাইল ছবি

মুক্তমত

প্রাকৃতিক দুর্যোগ বজ্রপাত

আহতদের পুনর্বাসন প্রয়োজন

  • প্রকাশিত ১৭ নভেম্বর, ২০২০

ইদানিং বজ্রপাত আমাদের দেশে খুব বেড়েছে। প্রাকৃতিক এ দুর্যোগ দেশে আগেও ছিল, কিন্তু এ দুর্যোগের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০১৬ সালের ১৬ মে বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং এরপর থেকে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা চালু হয়। কিন্তু বজ্রপাতে আহত ব্যক্তিদের জন্য কোনো প্রকার বরাদ্দ বা সহায়তার ব্যবস্থা নেই। নিহত ব্যক্তির পরিজনের আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে। আর্থিক অবস্থা বিবেচনার বিষয়টি উপজেলা চেয়ারম্যান অথবা জেলা প্রশাসকের দপ্তরের সুপারিশক্রমে বিবেচিত হয়। গত সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী ৩০ এপ্রিল ২০১৮ এক সংবাদ সম্মেলনে কৃষিক্ষেত্রে কাজ করার সময় বজ্রপাতে কেউ মারা গেলে তার পরিবারকে দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা দেন। এই টাকা তৎকালীন গঠিত ওয়ার্কার্স ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন থেকে দেওয়ার কথা তিনি উল্লেখ করেন।

বজ্রপাতে আহতদের অনেককেই সারা জীবন নানা ধরনের বিপর্যয় নিয়ে দিন কাটাতে হয়। বেশিরভাগের শ্রবণ ক্ষমতা পুরোপুরি চলে যায় এবং বধিরতাই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রকট এবং দৃশ্যমান সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। তাছাড়া স্মৃতিভ্রষ্টতা, মনোযোগ দিয়ে কোনো কাজ করার ক্ষমতা লোপ পাওয়া, প্রচণ্ড মাথাব্যাথা, অনিদ্রা ইত্যাদি সমস্যাসমূহ বজ্রপাতে আহত ব্যক্তিদের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়। বজ্রপাত নিয়ে বহুদিন ধরে গবেষণা করে মার্কিন চিকিৎসক ও গবেষক মেরি অ্যান কুপার দেখেছেন, বজ্রপাতে আহত ব্যক্তিরা অন্যসব স্বাভাবিক মানুষের মতো মাথা খাটিয়ে কাজ করতে পারেন না। কানে কম শোনা, পেশি আটকে যাওয়া এবং মাঝারি থেকে বড় রকমের স্নায়ুবিক বিপর্যয় বজ্রপাতে আহত ব্যক্তিদের জন্য খুবই সাধারণ ঘটনা। ফলে বজ্রপাতে আহত ব্যক্তিরা জীবনযাপনের জন্য স্বাভাবিক কাজ করার ক্ষমতা হারান এবং পরিবার পরিজন নিয়ে বিশাল বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েন। এজন্য এদের পুনর্বাসন এবং আর্থিক সহায়তা খুব প্রয়োজন। গবেষকদের মতে, বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মস্তিষ্কের অনুকোষগুলো। বজ্রের সঙ্গে তৈরি হওয়া বৈদ্যুতিক তরঙ্গ অনুকোষগুলোকে মুহূর্তের মধ্যে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। আহত ব্যক্তিদের শরীর পরীক্ষা করে দেখা গেছে, বজ্রাঘাত অনেকটা বুলেটের আঘাতের মতো। শরীরে ঢোকা আর বের হয়ে যাওয়ার সময় দুটি চিহ্ন রেখে যায়।

বজ্রপাতে নিহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের নিয়ম চালু হওয়ার পর থেকে বজ্রপাতে নিহতদের হিসাব রাখা হলেও বজ্রপাতে আহত ব্যক্তিদের হিসাব রাখা হচ্ছে না। যে কোনো দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির চেয়ে আহত ব্যক্তির সংখ্যা বেশি থাকে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, যেসব দেশে এ সংক্রান্ত হিসাব রাখা হয়, সেসব দেশে বজ্রপাতে নিহত ব্যক্তির চেয়ে আহত ব্যক্তির সংখ্যা দশগুণ। আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, বজ্রপাতে আহত প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজন মারা যায়; বেঁচে যায় নয় জন। তাই নয় জনেরই কম-বেশি চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।

দেশে বজ্রপাতে মৃত্যু ও আহতের ঘটনা বাড়ছে। এপ্রিল থেকে প্রায় প্রতিদিনই বজ্র দুর্যোগে মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে পাওয়া যায়। বজ্রপাতে অধিকাংশ মৃত্যুই হয় এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে। এ বছর প্রায় ৩ শত মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে এপ্রিলে ৭০ জন ও মে মাসে ৬০ জন। প্রতি একটি মৃত্যুর সঙ্গে অন্তত ১০ জন আহত হয়ে থাকে বলে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। বজ্রপাতে আহতরা স্থায়ীভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবীতে বজ্রপাতে যত মানুষ মারা যায়, তার এক-চতুর্থাংশই বাংলাদেশে। হাওর, বাঁওড় ও বিল এলাকার জেলাগুলোয় বজ্রপাতে মৃত্যু বেশি। ঝড়-বৃষ্টির সময় খোলা মাঠ, নৌকা ও পথঘাটে যারা চলাচল করে তারাই এর শিকার। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে বজ্রপাতের ঘটনা ১৫ শতাংশ বেড়েছে।

বাংলাদেশে ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার মানুষ বজ্রপাতে নিহত হয়েছে। বজ্রপাতে আহত লোকেরা এক সময় কর্মক্ষম ছিল, মাঠে-ঘাটে কাজ করত। আহত হয়ে সেসব কর্মক্ষম লোকেরাই এখন নির্জীব হয়ে পড়ে আছে। কারো কারো চিকিৎসা নেওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্যও নেই। ব্যক্তি থেকে সামষ্টিক হয়ে দাঁড়াচ্ছে আমাদের সমস্যা। এভাবে শারীরিক সমস্যা সামাজিক সমস্যায় রূপ নিচ্ছে। ক্ষতিপূরণের ঘোষণা থেকে সহজেই অনুমেয় সরকারের পক্ষ থেকে অর্থ কোনো সমস্যা নয়। এ অর্থ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার গঠনমূলক কাজে ব্যবহার করতে পারে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার উপকৃত হয়। উপকৃত হয় সমাজ, দেশ। ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রাপ্ত অর্থ ঠিকমতো কাজে লাগাতে গঠনমূলক সুদূরপ্রসারী টেকসই কিছু করা প্রয়োজন। আমাদের দেশে বজ্রপাতে আহত রোগীদের চিকিৎসার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রটোকল নেই, যা তৈরি করা প্রয়োজন। আগুনে পুড়ে যাওয়া রোগীর সঙ্গে বজ্রপাতে পোড়া রোগীর পার্থক্য রয়েছে—এবিষয়ে সুনির্দিষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। দেশের মেডিকেল কলেজগুলোতে বিশেষ করে বজ্রপাতপ্রবণ এলাকার সংশ্লিষ্ট গবেষণা এবং চিকিৎসা প্রটোকল তৈরি করা ও সময়ের সঙ্গে তা হালনাগাদ করার ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।

আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলায়। উন্নত দেশগুলোর মতো আমাদের দেশেও বজ্রপাতে আহত ব্যক্তিদের সংখ্যা, ধরন এবং চিকিৎসার ওপর ধারাবাহিক গবেষণা প্রয়োজন। গবেষণার মাধ্যমে বজ্রপাতে আহত ব্যক্তিদের একটি নবায়নযোগ্য চিকিৎসা প্রটোকল তৈরি করা সম্ভব, যা বর্তমানে খুব প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আহত ব্যক্তিরা যাতে হতাশায় না থাকে, সে বিষয়ে সামাজিক পুনর্বাসনসংক্রান্ত কর্মসূচি হাতে নেওয়া দরকার। ব্যক্তি হতাশা এক সময় সামষ্টিক হয়ে দাঁড়ায়। এ ক্ষেত্রে সমাজ ও দেশের বোঝা যাতে তৈরি না হয়; সে বিষয়ে শুরু থেকেই টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণ করা আবশ্যক। গণমাধ্যমগুলো বজ্রপাত এবং বজ্রপাতের সময় করণীয়সহ বজ্রপাতে আহত ব্যক্তিদের প্রাথমিক চিকিৎসা ও পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে এবিষয়ের ওপর বৈঠক এবং আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগের মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টির কর্মসূচি হাতে নেওয়া যায়। স্কুল-কলেজগুলোর পাঠ্যপুস্তকে জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ সংরক্ষণের অধীনে বজ্রপাত বিষয়ক চ্যাপ্টার সংযুক্ত করা জরুরি। শিক্ষকগণ এবিষয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের সচেতনতা সৃষ্টি ও বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারেন। বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্ধ করা না গেলেও সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এর ক্ষতিকর প্রভাব কমানো সম্ভব।

বাংলাদেশে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যু কমানোর জন্য দেশব্যাপী দশ লাখ তালগাছ লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বজ্রপাত যেহেতু উঁচু কোনো কিছুতে আঘাত করে, সেজন্য উঁচু গাছ হিসেবে তালগাছই বজ্রপাত ঠেকানোর জন্য প্রধান হাতিয়ার হতে পারে। বজ্রপাতে মৃত্যু হার কমাতে এটাই সবচেয়ে কার্যকর স্থানীয় প্রযুক্তি। এর পাশাপাশি সরকার হাওর অঞ্চলে টাওয়ার নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।

বজ্রপাত একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এ দুর্যোগ প্রতিরোধে ব্যক্তি সচেতনতা অত্যন্ত প্রয়োজন। যেমন—আকাশে ঘন কালো মেঘ দেখলে ঘরের বাইরে না যাওয়া, বজ্রপাতের সময় ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ রাখা, বাইরে থাকলে বজ্রপাতের সময় হাঁটু গেড়ে মাথা নিচু করে বসে পড়া ইত্যাদি। এছাড়া বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে সরকার দুর্গত জেলাসমূহে তালজাতীয় গাছ লাগাতে উদ্বুদ্ধ করছে। এবছর মুজিববর্ষ উপলক্ষে সরকার এক কোটি গাছের চারা রোপণের উদ্যোগ নিয়েছে। গাছ প্রকৃতির বন্ধু, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে। তাই এ প্রাকৃতিক দুর্যোগ রোধে বেশি করে গাছ লাগাতে হবে। প্রকৃতির যত্ন নিতে হবে। হতে হবে সচেতন। আর এ দায়িত্ব শুধু সরকারের একার নয়, আমাদের সবার।

শেগুফতা শারমিন

পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম ফিচার

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads