শাহীন চৌধুরী ডলি
বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে সংঘটিত হয়েছিল এক রক্তস্নাত অধ্যায়ের। সেদিন সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার প্রমুখ ভাষাশহীদের প্রাণের বিনিময়ে এবং নারী-পুরুষের সম্মিলিত আন্দোলনে পূর্ববাংলার রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা পায়। ১৯৬১ সালের ১৯ মে ভাষা আন্দোলনের আরো একটি গৌরবোজ্জ্বল দিন। একজন নারীসহ ১১ জন শহীদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে ভারতের আসামে বাংলা ভাষা সরকারি ভাষার মর্যাদা লাভ করেছিল। ১৯৬১ সালের ১৯ মে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে যে ১১ জন পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন তারা হলেন-১. শহীদ কমলা ভট্টাচার্য, ২. শহীদ শচীন্দ্র পাল, ৩.শহীদ সুকুমার পুরকায়স্থ, ৪.শহীদ বীরেন্দ্র সূত্রধর, ৫. শহীদ সুনীল সরকার, ৬. শহীদ তারিণী দেবনাথ, ৭. শহীদ কানাইলাল নিয়োগী, ৮. শহীদ সত্যেন্দ্র দেব, ৯. শহীদ কুমুদরঞ্জন দাস, ১০. শহীদ চণ্ডীচরণ সূত্রধর, ১১. শহীদ হিতেশ বিশ্বাস।
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্তির মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় দুটি পৃথক রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের। স্বাধীন পাকিস্তানের দাবি ছিল বেঙ্গল ও আসাম; কিন্তু নির্ধারণ হলো ভিন্নভাবে। ঠিক হলো, পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হবে মুসলিম অধ্যুষিত পাঞ্জাব প্রদেশ। আসামকে স্বাধীন ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে অখণ্ড বেঙ্গলকে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে যুক্ত না করে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিল। এটাই সিদ্ধান্ত হলো, আসামের বৃহত্তর সিলেট জেলায় গণভোটের আয়োজন করা হবে। গণভোটের ফলাফলে এলাকার ভৌগোলিক ভাগ্য নির্ধারণ করা হবে। ১৯৪৭ সালের ৭ জুলাই বৃহত্তর সিলেটে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। ৫৫,৫৭৮ ভোটের ব্যবধানে সিলেট পাকিস্তানে থাকার সিদ্ধান্ত হয়। এই গণভোটের রায় না মেনে মানচিত্রের বুকে দাগ কেটে বৃহত্তর সিলেটের তিন-চতুর্থাংশ ভারতকে দিয়ে দেওয়া হলে সিলেটের মানুষের কাছে চির বিতর্কিত হয়ে থাকে এই ঘটনা। এর ফলে বাঙালি অধ্যুষিত তিনটি জেলা নিয়ে গঠিত হয় বরাক উপত্যকা, যা আসামের অন্তর্ভুক্ত হয়। জেলাগুলো হলো-করিমগঞ্জ, শিলচর ও হালিয়াকান্দি।
দেশ বিভাগের পর থেকে পশ্চিমবঙ্গে বাঙালিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। আসামের শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দিতে গড়ে ওঠে বাঙালি জনপদ। আসাম সরকারের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী প্রচার করেছিলেন ‘আসাম শুধু অসমিয়ার’। অসমিয়ারা বাঙালিদের চিরশত্রু মনে করত। আসামকে বাঙালিশূন্য করার জন্য বার বার সরকারি প্রশ্রয়ে দাঙ্গা বাধানো হয়েছে। ১৯৪৮ সালের মে মাসে গুয়াহাটি শহরে বাঙালিদের ওপর আগ্রাসন চালানো হয়। গুয়াহাটি শহরের দাঙ্গায় বহু বাঙালি সর্বস্বান্ত হয়েছে। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত আসামের বিধানসভায় বাংলার প্রচলন ছিল। ১৯৫০ সালে আসামের উগ্রবাদী অসমিয়া সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ‘বাঙাল খেদা’ আন্দোলন। ১৯৬০ সালের ৩ মার্চ আসামের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চালিহা বিধান সভায় অসমিয়া ভাষাকে আসামের সরকারি ভাষা ঘোষণা করা হবে বলে জানান। এই ঘোষণার প্রতিবাদে ১৯৬০ সালের ১৬ এপ্রিল শিলচরে বাংলাভাষী বাঙালিরা এক সভা আহ্বান করে ভাষা প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলার জন্য প্রস্তুতি কমিটি গঠন করেন। অধ্যাপক শরৎচন্দ্রনাথকে ওই কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচন করা হয়। শিলচরে ২ ও ৩ জুলাই চপলাকান্তের সভাপতিত্বে ‘নিখিল আসাম বাঙ্গালা ভাষা সম্মেলন’ নামে ভাষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সন্মেলনে বাংলাকে আসামের সরকারি ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার দাবি জানানো হয়।
১৯৬০ সালের ১০ অক্টোবর কংগ্রেসের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আসাম বিধান সভায় নতুন আইন ‘রাজ্য ভাষা বিল’ উত্থাপন করেন। ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত বিধানসভায় পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা চলে। ২৪ অক্টোবর সকল সংশোধনী প্রস্তাব, অনুরোধ, আর্জি উপেক্ষা করে রাজ্যের রাজ্যভাষা বিল চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। উপেক্ষা করা হয় রাজ্যের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর বাংলা ভাষাকে। প্রতিবাদস্বরূপ অনেক সংসদ সদস্য সভাকক্ষ ত্যাগ করেন। আইনের মাধ্যমে বাংলা ভাষা নয় বরং অসমিয়াকে রাজ্যের সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হলে বাঙালিরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং ক্রমেই তা আন্দোলনে রূপ নেয়। প্রথমে সত্যাগ্রহ, পরে সহিংস। এই আইনের প্রতিবাদে পণ্ডিত রাজমোহননাথের সভাপতিত্বে ১৮, ১৯ ও ২০ নভেম্বর শিলচরে এক বিশাল সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে গৃহীত এক সিদ্ধান্তে বলা হয়, ‘যদি এই আইন করে বাংলা ভাষাকে অসমিয়া ভাষার সমমর্যাদা না দেওয়া হয় তবে বাঙালি সমাজের মৌলিক অধিকার ও মাতৃভাষা রক্ষার্থে আসামের বাংলা ভাষা অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো বৃহত্তর আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া অপরিহার্য হয়ে পড়বে।’
১৯৬১ সালের ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষের দিনটি ছিল সত্যাগ্রহ আন্দোলনের একটি উল্লেখযোগ্য দিন। সেদিন শিলচরের কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদের উদ্যেগে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার শপথ গ্রহণ করা হয়। উদ্যাপিত হয় ‘সংকল্প দিবস’। এই সংকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯ এপ্রিল থেকে পদযাত্রা শুরু হয়। গ্রামে গ্রামে বাংলা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে প্রচার চালান শত শত স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণকারী। আন্দোলনকারীরা দুই সপ্তাহে ২২৫ মাইল অতিক্রম করে বাংলা ভাষার পক্ষে প্রচার চালান। ২ মে তারা করিমগঞ্জ এসে পৌঁছালে তাদের স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনা দেওয়া হয়। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৬১ সালের ১৮ মে রাত ১২টার পর থেকে প্রায় ১০ হাজার তরুণ-তরুণী, বিভিন্ন বয়সের মানুষ শিলচর রেল স্টেশনে অহিংস অবস্থান ধর্মঘট করার জন্য সমবেত হতে থাকে।
পরদিন ১৯ মে বরাক উপত্যকায় হরতাল আহ্বান করা হয়। হরতালের আগের রাতে করিমগঞ্জে পুলিশ ব্যাপক ধরপাকড় চালায়, তারা গণপরিষদ কার্যালয়ে হামলা চালায়। পুলিশের এই মারমুখী আচরণ মেনে নেয়নি করিমগঞ্জবাসী। তারা পুলিশি অত্যাচারের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে এবং রুখে দাঁড়ায়। জনতা রাস্তায় বেরিয়ে আসে। ১৯ মে সকাল থেকে সর্বত্র ধর্মঘট পালিত হচ্ছিল। শিলচর রেল স্টেশনে সেদিন ভোর থেকে থেকেই আন্দোলন গড়ে তোলা হয়। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানায়। দোকানপাট, যান চলাচল বন্ধ থাকে। দুপুরের দিকে আন্দোলনের তীব্রতা ছড়িয়ে পড়লে দিশেহারা হয়ে পড়ে রাজ্য সরকার। সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের অনেককে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। পুলিশ বিভিন্ন দফায় লাঠিচার্জ করে ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। অনেক রেল কর্মচারী পুলিশের সাহায্যে যোগ দেয়। বেলা আড়াইটার দিকে রেল স্টেশনে কর্মরত বিএসএফ সদস্যরা হঠাৎ গেরিলার ভঙ্গিতে গুলিবর্ষণ শুরু করলে তৎক্ষণাৎ শহীদ হন—কমলা ভট্টাচার্য, সুনীল সরকার, কানাই নিয়োগী, সুকোমল পুরকায়স্থ, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, কুমুদ দাস, হিতেশ বিশ্বাস, তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্র পাল। পরদিন স্টেশনের পুকুর থেকে সত্যেন্দ্রকুমার দেবের বুলেটবিদ্ধ দেহ উদ্ধার করা হয়। রাতে হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন বীরেন্দ্র সূত্রধর। আহত হন অর্ধশতাধিক। বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সেখানেই শহীদ হওয়া ১৬ বছরের কিশোরী কমলা ভট্টাচার্য বিশ্বের প্রথম নারী যিনি বাংলা ভাষার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। এই ঘটনার পর আসাম সরকার বরাক উপত্যকায় বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। ১৯৬১ সালের ১৯ মে বরাক উপত্যকায় মাতৃভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করতে যে ১১ জন বীর জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের অন্যতম একজন ১৬ বছরের কিশোরী কমলা ভট্টাচার্য। তিনিই বিশ্বের একমাত্র নারী ভাষাশহীদ।
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১৯৬১ সালের ১৯ মে একটি স্মরণীয় অধ্যায়। প্রতি বছর বরাক উপত্যকাসহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ১৯ মে বাংলা ভাষা শহীদ দিবস হিসেবে পালিত হয়। শিলচর রেল স্টেশনে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘ভাষা শহীদ স্টেশন’। শিলচর রেল স্টেশনে ভাষাশহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। এরপর ১৯৭২ সালের ১৭ আগষ্ট একজন এবং ১৯৮৬ সালের ২১ জুলাই দুজন মাতৃভাষার জন্য আত্মদান করেন।
২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় বাংলাদেশি হিসেবে আমরা গর্বিত। একুশ আমাদের অহংকার। বিশ্বের সকল দেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে মাতৃভাষা দিবস ২১ ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মতন আসামের ভাষা আন্দোলনও ঐতিহাসিক বাস্তবতা। পাকিস্তানের কায়েদে আজম জিন্নাহ যেমন দম্ভভরে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা,’ ঠিক তেমনি তৎকালীন আসাম সরকারের প্রদত্ত সার্কুলারেও বলা হয়েছিল-‘আসামবাসীর রাষ্ট্রভাষা হবে একমাত্র অহমিয়া।’
১৯৫২ সালের তীব্র আন্দোলনে শত নির্যাতন সহ্য করে বাংলাদেশের সালাম, রফিক, বরকত, শফিক, জব্বার বুকের তাজা রক্ত ঢেলে ১৯৫৬-তে এসে সব বাধা ভেঙেচুরে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি আদায় করে নিয়েছিল ঠিক তেমনিভাবে আসাম সরকারের অহমিকাপূর্ণ সার্কুলারকে আসামের বীর বাঙালি সন্তানরা আন্দোলন, নির্যাতন, গ্রেপ্তার, লাঠিচার্জ এবং ১১ জনের বুকের রক্তে শিলচর রাঙিয়ে বরাক উপত্যকায় বাংলাকে অহমিয়া ভাষার সাথে রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বীকৃতি অর্জন করে নিয়েছিল।
বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন আসামের আন্দোলনের চেয়ে বেশ পুরনো। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন এবং বিজয় হয়তো আসামের বাঙালিদের মাতৃভাষা রক্ষার তাগিদে উৎসাহিত করেছে। বাংলাদেশ এবং আসামের বাংলা ভাষার মর্যাদা আদায়ে সকল শহীদ এবং আন্দোলনের সকল ভাষাসৈনিকদের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। তাদের সকলের অবদান কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি। আজ অবধি বাংলাদেশে সরকারি উদ্যোগে ভাষাসংগ্রামীদের কোনো তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। তাদের নামের তালিকাও গেজেট আকারে প্রকাশ হয়নি। কেবল ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষার জন্য মায়াকান্না করলে হবে না। বাংলা জন্মগতভাবেই আমাদের মাতৃভাষা। ভাষাকে শুধু রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করে ক্ষান্ত দিলেই হবে না বরং বাংলা ভাষাকে রক্ষা করতে হলে এর সঠিক ব্যবহার, সংরক্ষণ ও শিক্ষণের প্রয়োজন। এজন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক। গোটা বাঙালি জাতিকে অন্তর থেকে ভালোবেসে বাংলা ভাষাকে সঠিকভাবে ব্যবহার ও রক্ষার জন্য কাজ করতে হবে। ভুল বানান ও ভুল উচ্চারণের দূষণ রোধ করতে হবে। ২১ ফেব্রুয়ারি এবং ১৯ মে বাংলাদেশ ও আসামের তথা বাঙালি জাতির গর্বের এবং অহংকারের দিন।
লেখক : নারী অধিকারকর্মী ও লেখক