সৌরবিদ্যুৎ বাংলাদেশে অমিত সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। সৌরশক্তি উৎপাদন ও ব্যবহারের উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে প্রয়োজনীয় প্রধান উপাদান সূর্য এবং সহযোগী আরো পাঁচটি উপাদান যথাক্রমে আলো, বাতাস, রোদ, গাছ-পালা এবং পানির উৎস বাংলাদেশে অফুরান। গৃহস্থালী চাহিদার পাশাপাশি ছোট ছোট কারখানাও সৌরশক্তি দিয়ে চলতে পারে। কৃষিক্ষেত্রে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার উন্নয়ন সহায়ক হবে। পাহাড়ি ও হাওর এলাকায় সৌরবিদ্যুৎ নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলছে। সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থায় প্রচুর দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গ্রামাঞ্চলভিত্তিক যে সৌরবিদ্যুৎ কার্যক্রম চলছে তাতে বছরে এই খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে আড়াই হাজার কোটি টাকারও বেশি। ৬০% বিনিয়োগ হয় সৌর প্যানেলে যার সবটাই আমদানিনির্ভর। ২৫% বিনিয়োগ হয় ব্যাটারিতে আর ১৫% আনুষঙ্গিক খুচরা যন্ত্রাংশে। ব্যাটারি ও খুচরা যন্ত্রাংশ দেশেই তৈরি হয়। প্যানেল এখন দেশে তৈরি হচ্ছে। দেশীয় চাহিদা পূরণ করতে পারলে পুরো বিনিয়োগটাই দেশীয় নির্ভরতায় প্রতিষ্ঠিত হবে। সাশ্রয় হবে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা।
সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে বিশেষ নজর দিচ্ছে। এতে পরিবেশ সংরক্ষিত হবে। দেশে এখন প্রতি মাসে প্রায় ৬৫ হাজার নতুন সোলার হোম সিস্টেম বসানো হচ্ছে। আর এর সুবিধা পাচ্ছে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ। প্রায় ১৩ লাখ ৪০ হাজার ডিজেল সেচ পাম্পকে পর্যায়ক্রমে ‘সৌর পাম্পে’ রূপান্তরিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সেচ মৌসুমে প্রায় ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের বিকল্প উৎস মিলবে। ২০২১ সালের মধ্যে দেশে যে মোট ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তার ১০ শতাংশ উৎপাদন করা হবে সৌরবিদ্যুৎ ও অন্যান্য নবায়নযোগ্য উৎস থেকে এমন লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে তেল ও কয়লার ব্যবহার ২০ শতাংশ কমিয়ে আনতে চায় সরকার। যার ফলে বছরে অন্তত ৯৫ মিলিয়ন টন তেলের সমপরিমাণ জ্বালানি সাশ্রয় হবে। বছরে আর্থিক সাশ্রয় হবে পাঁচ হাজার একশ কোটি টাকা।
বাসাবাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয়
বাসাবাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। দেশের মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ মানুষ বাসাবাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করায় বৈশ্বিক নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্টে (জিএসআর) বাংলাদেশ মঙ্গোলিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। নেপাল এ তালিকায় প্রথম অবস্থানে। ২০২০ সালের বৈশ্বিক নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে জিএসআর প্রকাশ করেছে আরইএনএ ২১। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সেচের কাজেও সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহূত হচ্ছে। দেশটির ১ হাজার ৫০০ সেচপাম্প সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে চালু রয়েছে।
সৌরবিদ্যুৎ সম্প্রসারণে এগিয়ে বাংলাদেশ
বিশ্বব্যাংক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, সৌরবিদ্যুৎ সম্প্রসারণে বিশ্বে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। এখানে এ প্রযুক্তিটির প্রসার ঘটছে অবিশ্বাস্যভাবে। এর ফলে সহজ হচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলের পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক মুক্তির প্রক্রিয়া। এ ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকসহ একাধিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা, গ্রামীণ শক্তি ও ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। সৌরবিদ্যুৎ সম্প্রসারণ অর্থায়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রচেষ্টাও প্রশংসার দাবিদার। দেশে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থা স্থাপনের প্রবৃদ্ধি প্রায় ৫০ শতাংশ। এ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য হারে সৌরবিদ্যুৎ স্থাপন করা হয়েছে-সুনামগঞ্জ, পটুয়াখালী, শরীয়তপুর, বরগুনা, বরিশাল, সাতক্ষীরা, চাঁদপুর, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, খুলনা, নেত্রকোনা।
ছাদে সৌর প্যানেলে ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব
ঢাকা বিশ্ব্যিবদালয়ের নবায়নযোগ্য জ্বালানি গবেষণা কেন্দ্র এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানায়, দেশের মোট আয়তনের ১ ভাগ জায়গা ব্যবহার করে ৪০ হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। আরো ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হতে পারে শুধু বায়ুশক্তির ব্যবহার করে। সেনা কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ডিজেল প্লান্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কর্নেল মোহাম্মদ আলীর এক গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়, ঢাকা মহানগরের ভবনগুলোর ছাদে সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল বসিয়ে অন্তত ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। ভবন মালিকেরা ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করে ২৫ বছর পর্যন্ত মাসিক পাঁচ হাজার টাকা আয় করতে পারবেন। যা আগে বিদ্যুতের বিল হিসেবে দিতে হতো।
জানা গেছে, ঢাকা শহরে ৩ লাখ ইউনিট বাড়ি থাকলেও সৌর প্যানেল স্থাপনের মতো রয়েছে ১ লাখ ৭৮ হাজার বাড়ি। এখান থেকে মোট ১ হাজার ৪৬৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। পদ্ধতিগত লসের পরও কমপক্ষে ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। বাংলাদেশে ব্যবহার উপযোগী এবং ঘরে ঘরে বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো গ্রিড সংযোগ দেওয়ার মতো এমন একটি সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেছে আমাদের দেশীয় গবেষকরা। বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিজ্ঞান, ইলেক্ট্রনিকস এবং যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের একদল গবেষক সৌরবিদুৎকে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার ‘রুফটপ গ্রিড কানেন্টেড সোলার ফটোভল্টেইক সিস্টেম’ নামে এই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে। উদ্ভাবকেরা ১ দশমিক ১ কিলোওয়াট ক্ষমতার এই সৌরবিদুৎ ব্যবস্থাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপান্তরিত শক্তি গবেষণা কেন্দ্রে স্থাপন করা হয়। ভারত ইতোমধ্যে এক গিগাওয়াট (১ হাজার মেগাওয়াট) ক্ষমতার রুফটপ সৌরবিদ্যুৎ কাঠামো স্থাপন করেছে এবং ২০২২ সালে ৪০ গিগাওয়াট রুফটপ সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কেপিএমজি আশা করছে, ২০২৫ সাল নাগাদ ভারতে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের সাড়ে ১২ শতাংশ আসবে সৌরবিদ্যুৎ থেকে (বর্তমানে ১ শতাংশ)। দুবাই ইলেকট্রিসিটি অ্যান্ড ওয়াটার অথরিটি ও ডিপি ওয়ার্ল্ড নামের দুটি প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি ঘোষণা করেছে, তারা যৌথ উদ্যোগে দুবাইয়ের প্রতিটি বাড়ির ছাদে সৌরবিদ্যুৎ স্থাপনা বসাবে। পৃথিবীর বৃহত্তম সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশ চীনের মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ৩ শতাংশ আসে সৌরবিদ্যুৎ থেকে এবং এতে রুফটপ সৌরবিদ্যুতের অংশটি গুরুত্বপূর্ণ। জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ রাজপ্রাসাদ ও মসজিদের ছাদে সোলার প্যানেল বসানোর নির্দেশ দিয়েছেন। জর্ডান ইতোমধ্যে ১৬০ মেগাওয়াটের সৌরবিদ্যুৎ পার্ক নির্মাণ করেছে।
আলোকিত হচ্ছে গ্রামীণ জনপদ
সৌরবিদ্যুতের আলোয় উন্নয়ন ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় কর্মপ্রেরণা ও প্রাণচাঞ্চল্যতা লক্ষ্য করা গেছে নিভৃত গ্রামীণ জনপদে। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, যোগাযোগ, বিনোদন সব ক্ষেত্রে সৌরবিদ্যুতের আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে গ্রামাঞ্চল। টেলিভিশন, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন এমনকী ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ার ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছেলে-মেয়েদের একদিকে যেমন বিনোদন ব্যবস্থার সুযোগ বাড়ছে অন্যদিকে মেধার বিকাশ ঘটছে। সৌরবিদ্যুৎ আসায় তাদের শিক্ষার্থীরা আগের তুলনায় অনেক বেশি লেখাপড়া করছে। গ্রামের যেসব বাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ রয়েছে তারা মোবাইল ফোনও ব্যবহার করতে পারছে। ফলে গ্রামের যেসব লোক দেশ-বিদেশে থাকে তারা সহজেই যোগাযোগ করতে পারছে। তাছাড়া ২০ভাগ সৌরবিদ্যুৎ ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহার করায় কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ফিরে এসেছে। এ ব্যবস্থাকে আরো বিকশিত করা গেলে গ্রামের মানুষকে শহরমুখী হওয়ার প্রবণতা থেকে বিরত রাখা যাবে।
ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ স্থাপনের উদ্যোগ
হাওর-বিল-নদীবেষ্টিত বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকা আলোকিত করতে এবার সারাদেশে ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সরকার। এ ধরনের উদ্যোগের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে কাপ্তাই লেক ও তিস্তা বাঁধসংশ্লিষ্ট খালকে বেছে নেওয়া হয়েছে। জানা গেছে, কাপ্তাই লেকের পাশে সৌরশক্তি ব্যবহার করে ৭ দশমিক ৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার হবে ২২ একর জমি। এ ছাড়া উত্তরবঙ্গের তিস্তা বাঁধ এলাকাসংলগ্ন জলাভূমিতে ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে আরো ২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সিলেট ও সুনামগঞ্জের হাওরবেষ্টিত ভাটি অঞ্চলেও এ ধরনের ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এছাড়া সমুদ্রবেষ্টিত উপকূলীয় এলাকায়ও ভাসমান সোলার প্যানেল নির্মাণ করা হবে। ফেনীর মুহুরী ড্যামে ২৫ মেগাওয়াট ও চাঁদপুরের মেঘনা-ধনাগোদা ড্যামেও ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের ভাসমান সৌরশক্তি উৎপাদন কেন্দ্রের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এর জন্য কোনো জমি অধিগ্রহণ করতে হয় না। সরকারি জলাশয়ে নির্বিঘ্নে এ ধরনের প্লান্ট স্থাপন করা সম্ভব।
বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের জাতিসংঘ পুরস্কার
শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার সেনেরচর সাকিমআলী মাদবরকান্দি গ্রামে সৌরবিদ্যুতের সঞ্চালন লাইনে প্রিপেইড মিটার চালু করে উপকূলীয় বিদ্যুতায়ন ও মহিলা সমিতি ‘জাতিসংঘ জলবায়ু পুরস্কার’ পেয়েছে। জার্মানিভিত্তিক সংস্থা সোল সেয়ারের প্রকল্প এটি। মিটারে সফটওয়্যার নিয়ন্ত্রিত এসডিকার্ড স্থাপন করা হয়েছে। ওই কার্ড মোবাইলে ভরে মিটার রিচার্জ করা হয়। আমাদের একটি ১০০ ওয়াটের প্যানেল তাদের (আটজন গ্রাহকের) বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যাকআপ হিসেবে কাজ করছে।’
ব্যাটারিবিহীন সোলার সিস্টেম উদ্ভাবন
ব্যয়বহুল ব্যাটারির বিকল্প থিন ফিল্ম সোলার সেল উদ্ভাবনে সক্ষম হয়েছেন বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর)এর গবেষকরা, যার মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব। এ থিন ফিল্ম সেলের আয়ুষ্কাল প্যানেলের সমান হবে। পাশাপাশি এর খরচও কম। তাই দেশের সব সোলার হোম সিস্টেমে এ পদ্ধতিতে উন্নীত করা গেলে সৌরবিদ্যুৎ আরো সহজলভ্য হবে বলে মনে করছেন গবেষকরা। এ পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় কমবে প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে প্রায় ৭৫ শতাংশ।
দেশে বৃহৎ পরিসরে এ পদ্ধতিতে সৌরবিদ্যুতের সম্ভাব্যতা যাচাই ও সমস্যা নিরূপণে ৬৪ কিলোওয়াট পিক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যাটারিবিহীন একটি সৌরবিদ্যুৎ প্লান্ট বিসিএসআইআরের অভ্যন্তরীণ গ্রিডের সঙ্গে স্থাপন করেন বিজ্ঞানীরা। তাতে দেখা যায়, স্থাপিত সৌরবিদ্যুৎ প্লান্ট (ব্যাটারিবিহীন) থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ইউনিটপ্রতি মাত্র ৭ টাকা ৩৭ পয়সা, প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে যা অনেক কম। শুধু তা-ই নয়, অধিকতর গবেষণার মাধ্যমে এ খরচ আরো কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
আছে সুবিধা এবং সাশ্রয়
সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার সহজ, নিরাপদ এবং কম খরচে দীর্ঘস্থায়ী ব্যবহারযোগ্য। একবার বিনিয়োগ করলেই কমপক্ষে ১০ বছর নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা পাওয়া যাবে। সৌরবিদ্যুৎ পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি। লোডশেডিং নেই। বিল দেওয়ার ঝামেলা নেই। সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের ফলে গ্রামীণ জনপদে হাটবাজার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজের সময় বৃদ্ধির ফলে আয় রোজগার বেড়েছে। যেকোনো স্থানে স্থাপন করা যায়। সাধারণ বিদ্যুতের মতোই ব্যবহার করা যায়-কম্পিউটার টেলিভিশন, রেডিও, ক্যাসেট প্লেয়ার, ভিসিপি, ভিসিআর, ছোট বৈদ্যুতিক পাখা চালানো সম্ভব। মোবাইল ফোনের ব্যাটারি চার্জ করা যায়। সোলার প্যানেল কার্যকর থাকতে পারে টানা ২৫ বছর পর্যন্ত। ব্যাটারি পরিবর্তনযোগ্য। আকাশে মেঘ থাকুক বা টানা বৃষ্টি থাকুন কোনো সমস্যা নেই। দিনের স্বাভাবিক আলো থেকেই সোলারে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। তবে সূর্যের আলোর তুলনায় তা কম হবে। বাংলাদেশে বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে গড়ে ৩৪০ দিন সুর্যের আলো থাকে। ২৫ দিন আলো না থাকলেও দিনের যে আলো বিদ্যমান থাকে তাতেই প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। সৌরবিদ্যুৎ স্বল্পমূল্যে স্থাপন করা যায়, বিক্রয়োত্তর সেবা ও প্রয়োজনীয় ঋণ সহায়তা পাওয়া যায়। কেরোসিনের প্রায় সমান খরচে গ্রামীণ জনগণ সৌর প্লান্টের মালিক হতে পারেন।
বর্তমানে দেশের দুই কোটিরও বেশি মানুষ সৌর বিদ্যুতের আওতায় এসেছে। ৪৭টি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ইডকল গ্রামীণ জনপদে সৌরবিদ্যুতের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থা স্থাপনের মাধ্যমে ব্যাটারি, কেবল্, সোলার সংক্রান্ত সরঞ্জামের কারখানা গড়ে ওঠেছে। কেরোসিনের ব্যবহার হ্রাস পেয়েছে। সৌরবিদ্যুতের ব্যবহারের কারণে বার্ষিক এক লাখ ৪০ হাজার টন কেরোসিন আমদানি কম হচ্ছে। যার আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য প্রায় ১২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আবার কেরোসিনের ব্যবহার হ্রাসের ফলে পরিবেশ উল্লেখ্যযোগ্য পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিগর্মন হ্রাস পাচ্ছে। যা পরিবেশ রক্ষায় সহায়ক ভূমিকা রাখছে।
সোলার নিয়ে আমাদের ভাবনা
সৌরশক্তি পৃথিবীর প্রাচীন শক্তির অন্যতম উৎস। গতানুগতিক শক্তির বাইরে বিকল্প শক্তির উৎস হিসেবে প্রথমেই আসে সৌরবিদ্যুতের নাম। গ্রাম পর্যায়ে সৌরবিদ্যুতের প্রতি জনগণকে আগ্রহী করে তুললে সে বিদ্যুৎ শহরে শিল্প জীবনের সাথে যোগ করলে বেশি লাভবান হওয়া যাবে। চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের কম মূল্যে সোলার প্যানেল বৃত্তি হিসেবে দেওয়া যেতে পারে। গ্রামীণ জনপদে সৌরবিদ্যুৎ সম্পর্কিত তথ্য প্রচরণা জরুরি। সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন, প্রয়োগ ক্ষেত্র, ব্যবহার, যন্ত্রপাতি ও সার্ভিসিং, ঋণ সহায়তা, কৃষি ও সেচের ক্ষেত্রে এর ব্যবহার, কিস্তিতে ক্রয় সুবিধাসহ সব সুবিধার বিষয়ে সরকারি বেসরকারিভাবে প্রচারণার মাধ্যমে গণজাগরণ সৃষ্টি করতে হবে। গ্রামীণ বাড়িঘর, ছোট-বড় ব্যবসা, হাট-বাজার, হাস-মুরগি বা গরু-ছাগলের খামার, মৎস্য খামার, হ্যাচারি, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসা, ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুতের পরিবর্তে সৌরবিদুতের ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
একই উপায়ে শহর ও উপশহরের বাসাবাড়ি, অফিস-আদালত এমনকী শিল্পকারখানাতে সৌরবিদুৎ প্লান্ট স্থাপনে ভর্তুকি নিশ্চিত করলে এর জনপ্রিয়তা ও ব্যবহার বাড়বে। কয়েক দশক ধরে কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার উৎপাদন বাড়াতে ব্যাপক ফলপ্রসূ ভূমিকা রেখেছে। সেচকাজে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে কৃষিক্ষেত্রে আশাতীত সুফল পাওয়া যাবে। বিদ্যুৎ সংকটের দীর্ঘস্থায়ী ও ভবিষ্যতমুখী সমাধানে সৌরবিদ্যুৎ হতে পারে একমাত্র দাওয়াই। এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য সরকার এবং বেসরকারি সংগঠনগুলোকে টার্গেটভিত্তিক দীর্ঘমেয়াদি (কমপক্ষে ২০ বছরের) মহাপরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। সেই সাথে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি সৌরবিদ্যুতের জন্য পৃথক একটি মন্ত্রণালয় গঠন খুব জরুরি। সবার আগে করণীয় গ্রামীণ এলাকায় সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার ব্যাপকহারে সম্প্রসারণ সম্ভব হলে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুতের চাপ কমে আসবে। গ্রামীণ জনপদে বিদ্যুতের ব্যবহার যে পরিমাণ কমবে তার পরিমাণ উল্লেখযোগ্য। এই বাড়তি বিদ্যুৎ দেশের শিল্প বাণিজ্যে ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করবে। তাই জাতীয় স্বার্থে দেশের অর্থনীতি দ্রুততর বিকাশের জন্য গ্রামীণ জনপদে সৌরবিদ্যুতের ব্যাপক ব্যবহার নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই।
উন্নয়ন গবেষক ও বিশ্লেষক