দেখতে দেখতে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর হতে চলল। এ সময়ে কেবল যে বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি এবং জনজীবনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে তা নয়, সারা বিশ্বেই এই পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে। গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের প্রেক্ষাপটে যখন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে তখন উন্নয়নশীল বিশ্বে সমাজতন্ত্রের আদর্শ সমুন্নত, এসব দেশের রাজনীতি গণমানুষের অধিকার আদায় ও আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রতিই দায়বদ্ধ। সমাজে, সংস্কৃতি চর্চায় তখনো আদর্শবাদের স্থান উঁচুতে। ভোগবাদ ও সবকিছুর পণ্যায়নের পুঁজিবাদী আগ্রাসন তখনো বাস্তব নয়। ত্যাগের মর্যাদা বজায় ছিল। রাজনীতি পেশা নয়, তখনো ব্রত এবং ক্ষুদ্র স্বার্থে নয় বৃহৎ আদর্শ বাস্তবায়নেরই এই ব্রত যাপন।
কুড়ি বছর পরে সমাজতন্ত্রের দুর্গ ধসে গেল, স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হলো বটে; কিন্তু বিশ্বরাজনীতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেল। তাতে পুঁজিবাদের সর্বগ্রাসী থাবা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ল। মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বিশ্বায়নের মন্ত্র জপে ধনতন্ত্রের বিজয়রথ বিশ্বপরিক্রমায় বেরিয়ে পড়ল অবাধে, শক্তিমানের যথেচ্ছাচারের সুযোগসহ। আদর্শের স্থান থাকল না রাজনীতিতে, সমাজে মূল্যবোধের পুরোনো ছকে ভাঙন ধরল। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ইচ্ছাপূরণের লাগামহীন দৌড়ে দুর্বল ও প্রান্তিক মানুষের বঞ্চনা বাড়ল, বৈষম্যের হার ঊর্ধ্বমুখী হলো এবং নারী এই বাজারের মুক্ত প্রতিযোগিতায় ব্যবহূত হতে থাকল। ভোগবাদী তাড়না তীব্রতর হতে হতে সামাজিক বন্ধন এবং পরিবারসহ সমাজ গঠনের মৌলিক ভিত নাড়া খেল।
এই সাথে সুযোগের সম্ভাবনার দ্বারও খুলল না? নিশ্চয়ই নতুন যুগের প্রযুক্তির কল্যাণে ব্যক্তির জন্য ভাগ্য পরিবর্তনের অপার সুযোগ তৈরি হলো। এই বাস্তবতা সমাজের দুর্বল প্রান্তিক মানুষের জন্যও প্রায় উচ্চ শ্রেণির সমান সম্ভাবনার পথ খুলেছে। শ্রেণিহীন সমাজ গঠনের বাস্তবতা যখন প্রায় নিঃশেষিত হচ্ছে তখন এর বিপরীত যাত্রার সুযোগ এনে দিল প্রযুক্তি, সুযোগ এলো শ্রেণি-উত্তরণের। গরিবও ধনী হতে পারে দ্রুত, প্রায় রাতারাতি, মধ্যবিত্তের ঘাট টপকে পৌঁছে যেতে পারে উচ্চবিত্তের স্তরে। সন্তানদের জন্য একই মাপের শিক্ষা ও জীবন মান ক্রয়ও সম্ভব হয়ে যায়। হয়তো সমাজে তার অভিঘাত সব সময় অনুকূল হয় না, ভাঙন ত্বরান্বিত হয়; কিন্তু একে পরিবর্তন ও উত্তরণ হিসেবে বিবেচনার কথাও সংশ্লিষ্টদের মাথায় উঁকি দিতে পারে।
ভাষা আন্দোলন থেকেই আমাদের জাতীয়তার স্ফুরণ এবং বিকাশ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এবং বাঙালি সংস্কৃতি ছিল স্বাধীনতার পথে আমাদের সকল আবেগ ও প্রেরণার কেন্দ্রে। কিন্তু পঞ্চাশ বছর পরে কী দেখছি আমরা বাস্তবে? নীরবে, কিন্তু সকলের অংশগ্রহণে, কী সহজে সবার প্রাণের ভাষা বাংলাকে ছেড়ে সন্তানদের ইংরেজি শেখানোয় উঠেপড়ে লেগেছে সমাজ। এমনকি যেসব ব্যক্তি ও পরিবার এই ভাষা-সংস্কৃতির চর্চা করেছেন, এই জাতীয়তার বিকাশে কান্ডারির ভূমিকা পালন করেছেন তাদের পরিবারেও একই বাস্তবতা। নতুন প্রজন্ম দ্বিভাষী হচ্ছে এমন কথা হলপ করে বলা মুশকিল। মাতৃভাষা বাংলা তারা জানে, এ ভাষায় কথাবার্তাও বলতে পারে। কিন্তু যেহেতু লেখাপড়া চলে ইংরেজি ভাষায় তাই তাদের চিন্তার বাহন হয়ে উঠেছে এই ভাষা, মাতৃভাষা বড়জোর আবেগ প্রকাশের ভাষা হতে পারে। এই প্রজন্ম বাংলা সাহিত্যের রস পায় না, তাই পড়ে না, বাঙালির সবচেয়ে শক্তিশালী সমৃদ্ধ সম্পদ যে গান তারও গুণগ্রাহী তারা নয়, তাদের পছন্দ হাল আমলের দ্রুত গতির ও ছন্দের পাশ্চাত্যসংগীত আর বড় জোর আধুনিক পাশ্চাত্য বাদ্যযন্ত্রের সাথে লোকসংগীত।
২.
১৯৭৫ সনের নির্মম হত্যাযজ্ঞের পরে বঙ্গবন্ধু-উত্তর বাংলাদেশে স্বাধীনতার আদর্শ ও মূল্যবোধ বিপর্যস্ত হয়েছে, সে কথা আলোচনায় বার বার উঠে এসেছে। খোন্দকার মোশতাক থেকে ১৯৯৬-এ বেগম খালেদা জিয়া পর্যন্ত প্রায় একুশ বছর বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায় ছিল যেসব শক্তি তারা ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদকে বিশ্বাস করেনি। তাদের বিশ্বাস ছিল পাকিস্তানি ধারার মুসলিম জাতীয়তাবাদে। সেই রাজনীতিই তারা ফিরিয়ে এনেছিল। তাদের সাহচর্যে পাকিস্তানপন্থি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের পথ ধরে যে রাজনীতি শক্তিশালী হয়েছে তার ছায়াতলে ধর্মান্ধ রাজনীতি, এমনকি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের দলেরও শক্তি বৃদ্ধি হয়েছে।
এই সময়ে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বেড়েছে, রাজনীতি ও বেসামরিক প্রশাসনে সামরিক হস্তক্ষেপ ও প্রভাব বেড়েছে। গণতন্ত্রের লেবাসে জবরদস্তি ক্ষমতা চর্চার জন্য অবৈধ অস্ত্র ও কালোটাকার ব্যবহারও অপ্রতিহত গতিতে চলেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। দেশে মাদরাসার সংখ্যা বেড়েছে, তাদের রাজনৈতিক প্রভাব বলয় বিস্তৃত হয়েছে এবং দখলদারির রাজনীতির সুবাদে ক্যাম্পাসে ও সমাজে উদার মানবিক ও গণতান্ত্রিক বাঙালি সংস্কৃতিচর্চার ঐতিহ্য বাধার সম্মুখীন হয়েছে। বিশ্বায়নে গা ভাসাতে তাদের আপত্তি হয়নি। অর্থনীতির উদারীকরণের নামে দেশের ও জনগণের সম্পদ লুণ্ঠনের উৎসব চলছে অবাধে। সৃষ্টি হয়েছে অনেক লুটেরা ধনীর এবং দেশে একটি লুটপাটের অর্থনীতি ও সংস্কৃতি দানা বেঁধে ওঠে। আবার জাতীয়তার শিকড় দেশ ও ঐতিহ্যের গভীরে প্রোথিত না থাকায় তাদের পক্ষে ইংরেজি মাধ্যমের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠতে বাধেনি। মাদরাসার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল বা উল্টোটাও বলা যায়। অবক্ষয় হয়েছে, বরং বলা উচিত হতে দেওয়া হয়েছে, মূল ধারার বাংলামাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর। এই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষার মানের চূড়ান্ত অবনমন ঘটতে থাকে। এ সময় অবক্ষয়ের ছাপ পড়েছে সব প্রতিষ্ঠানের ভেতরে-বাইরে।
দীর্ঘ সময় ধরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, এর নায়কদের কথা কয়েকটি প্রজন্ম জানতেই পারেনি। বিরূপ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দীক্ষাহীন মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে, তাদের কেউ কেউ ভুল রাজনীতিতে জড়িয়েছেন, প্রায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উল্টোপথেও গেছেন অনেকে। আবার জিয়াউর রহমানের সময় সামরিক ছাউনিতে অস্থিরতার সুযোগে অনেক মুক্তিযোদ্ধা অন্যায় বিচারের যূপকাষ্ঠে বলি হয়েছেন, অনেকে//// অপসৃত হয়েছেন নীরবে, অনেকে ভুল পথে অনেক দূর চলে চলে হারিয়ে গেছেন।
এই ছিল কঠিন বাস্তবতা—যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের বাস্তবতার সাথেই তুলনীয়। এ হলো আদর্শ ও চেতনার বিক্ষত বিপর্যস্ততা। এ থেকে জাতিকে তুলে আনা, সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা কঠিন কাজ। সময়ের পরিবর্তন এতটাই অকাট্য, এতটাই নির্মম বাস্তব যে তার গতিপথ সব সময় রুখে দেওয়া যায় না, যায় না পরিবর্তন করা। খুঁজতে হয় গ্রহণ-বর্জনের বিকল্প, তৈরি করতে হয় অগ্রাধিকারের এবং কোথায় কঠোর কোথায় আপস বা সমঝোতা তারও হিসেবে নিতে হয়। কাজটা কঠিন সন্দেহ নেই, সন্দেহ নেই যে আপন পক্ষের মানুষদেরও সব সময় সন্তুষ্ট করা যাবে না। সেখানেই নেতৃত্বের দূরদর্শিতা, প্রজ্ঞা এবং ধৈর্যশীল হয়ে পথ চলার চ্যালেঞ্জ।
৩.
১৯৯৭ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও তাকে অনেক হিসেব কষে বিভিন্ন প্রতিপক্ষের সম্ভাব্য বিরূপতা মাথায় রাখতে হয়েছে। এক সময় যে দল ধর্মীয় পরিচয় মুছে প্রকৃত অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলে রূপ নিয়েছিল, সেই রাজনীতির শক্তিতে আপামর মানুষের মন জয় করে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ কায়েম করেছিল তারাই আবার ধর্মকে রাজনীতিতে টেনে আনল। বৈশ্বিক পটপরিবর্তনের আগেই সমাজতন্ত্রের অঙ্গীকার থেকে সরে এসেছে আওয়ামী লীগ। আর এখন তো সে যুগের অবসান হয়ে গেছে। এ বাস্তবতায় ২০০৯ সালে—যখন আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বিপুল বিজয় অর্জন করল তখনো কিন্তু তারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি থেকে সরে আসার সাহস ক েনি। এর মূল কারণ এই যে এখানে একাত্তরে রাষ্ট্র পরিবর্তন হলেও সমাজের রূপান্তর ঘটেনি। বাঙালি মুসলিমসমাজে রেনেসাঁসের মানবতাবাদ ও বৈশ্বিক চেতনা এবং বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও শিল্পবিপ্লবের প্রেক্ষাপটে অর্জিত জাতিরাষ্ট্র ও গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েমের যে চ্যালেঞ্জ তা তাত্ত্বিকভাবে আলোচিত-পর্যালোচিত হয়নি। অথচ সময়ের দাবিতে, সমাজ পরিবর্তনের চাপে ওপরে বর্ণিত বিষয়সমূহের জ্ঞানতাত্ত্বিক উত্তরাধিকার এবং শিল্পবিপ্লবের ফসল ভোগ করার বাস্তবতা সারা বিশ্বের সব দেশ ও সমাজের জন্যই ছিল সত্য। বাংলাদেশের সমাজ বা বিশ্বের মুসলিমসমাজ তার বাইরে নয়। কিন্তু সজ্ঞানে ধর্মভিত্তিক বিশ্বাস ও চেতনালালিত সমাজ এ নিয়ে ভাবেনি, সচেতন কোনো সংস্কার ও উত্তরণের কাজ করেনি। চেতনার গোঁজামিল ও ভাবনার দৈন্য নিয়েই চলছে এই সমাজ।
এই যখন বাস্তবতা তখন সমাজে মূল্যবোধের সংকট দেখা দেয়, যা কিছু ঐতিহাসিক অর্জন তার শিকড় কখনো শক্তিশালী হয়নি, গভীরে যায়নি। সংকট ধর্মীয় বিশ্বাস ও চেতনার যেমন তেমনি রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও চেতনাতেও। বরং এমন বাস্তবতায় উচ্চাভিলাষী দুঃসাহসী ব্যক্তিরা ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলে সব রকম আপস ও অন্যায়ে জড়িয়েছে। তাদের ক্ষমতার ভাগ ছিনিয়ে নেওয়ায় কিংবা সেই ক্ষমতার অপব্যবহারে বাধা দেওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে অনেক উন্নয়ন হলেও সবচেয়ে মূল্যবান মানবসম্পদের অবক্ষয় ঠেকানো যাচ্ছে না। এর ফলে মানুষের হাতে যেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার কথা, যেসব আইন মানবকল্যাণে প্রয়োগ হওয়ার কথা, যেসব অধিকার সবার সমতার ভিত্তিতে সংরক্ষিত হওয়ার কথা তা বার বার ক্ষুণ্ন হচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে। পঞ্চাশ বছর পরে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে অনেক উন্নয়নের বিস্ময়কর সাফল্যের নিদর্শন তুলে ধরা যাবে। কিন্তু যে বাংলা ভাষার আন্দোলন থেকে এ দেশ তার দৈন্যদশা তো ঢাকা যাবে না, যে বাঙালি সংস্কৃতি ছিল জাতীয়তাবাদের ভিত্তি তার প্রতি অবহেলার ফল কে ঢাকবে? একদিন যে জাতির প্রায় সকলেই ত্যাগের উদ্দীপনায় মহৎ কাজে বীরের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত ছিল তারাই আজ ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থে জলাঞ্জলি দিচ্ছে মানবের মহত্ত্ব। একটা কি ট্র্যাজেডি ঘটতে চলল?
৪.
খুব বিশ্বাস করি, যে বাঙালি অস্ত্র ধরেছিল, যার বুকে দেশপ্রেমের অসংখ্য সংগীতের চরণ ধ্বনিত হয় তারা একদম হারিয়ে যাবে না, তারা সদলবলে হারতে পারে না। এত পিছু হটা, এত বিপর্যয়ের মধ্যেও আমরা সম্ভাবনার দুটো ক্ষেত্র দেখতে পাই—একটি হলো বঙ্গবন্ধুকন্যার ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস ও পিতার মতোই রাজনৈতিক সৃজনশীলতার ক্ষমতা এবং দ্বিতীয় হলো নতুন প্রজন্মের মধ্যে আমরা সংবেদনশীল দেশানুরাগী ঐতিহ্যের প্রতি আগ্রহী মনের সন্ধান পাচ্ছি। তারাই তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে পরাজয় ও বিস্মৃতি থেকে রক্ষা করবে। শেখ হাসিনা নিশ্চয় তাদের চিনতে পারবেন এবং তাদের জন্য রাজনীতিকে বর্তমান রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হবেন। বাংলাদেশ তারুণ্যনির্ভর এক দেশ আর সেখানেই আমাদের সম্ভাবনার দীপ ধীরে ধীরে আলো ছড়াবে। তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে—সেদিকেই আমাদের তাকাতে হবে।