মাওলানা মাহাথির মোবারক
একজন আলেম দেশ ও জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ। মূল্যবান সম্পদ হারিয়ে গেলে মানুষ যেমনি দিশেহারা হয়ে যায় ঠিক তেমনি কোনো আলেম চলে গেলে পুরো দেশ ও সমাজ দিশেহারা হয়ে যায়। এসব আলেম-ওলামা না থাকলে পৃথিবী ঠিক থাকবে না। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। পৃথিবীর সব মানুষ মনুষ্যত্ব ভুলে গিয়ে চতুষ্পদ জন্তুতে পরিণত হয়ে যাবে। তাই আলেম-ওলামাদের মর্যাদা সর্বোচ্চ। ওলামায়ে কেরাম হলেন মাথার তাজ সমতুল্য। তাদেরকে সম্মান করা ঈমানি দায়িত্ব। তাদেরকে সম্মান করা মানে দীন ইসলাম আর ধর্মকে সম্মান করা। আর ধর্মের সম্মান করা মানেই মহান আল্লাহতায়ালাকে সম্মান করা। আর আলেমদের সাথে কোনো খারাপ আচরণ মানেই ধর্মবিদ্বেষীর পরিচয়। না জানার কারণে আলেমদের অনেক সময় অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যের চোখে দেখা হয়। অথচ আলেমদের সম্মান আল্লাহর কাছে এতো বেশি যে, আসমান ও দুনিয়ার সব মাখলুক আলেমদের জন্য দোয়া-মাগফেরাত কামনা করতে থাকে। নবীজি হজরত মোহাম্মদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘আলেমদের ওপর স্বয়ং আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ এবং আসমান ও জমিনের সব মাখলুক এমনকি পিঁপড়া আপন গর্ত থেকে এবং মাছ পানির ভেতর নিজ নিজ পদ্ধতিতে রহমতের জন্য সর্বদা দোয়া করতে থাকে।’ (তিরমিযি, হাদিস নং- ২৬৮৫)
আমরা অনেক সময় না বুঝে জাতির সঠিক পথ প্রদর্শনকারী আলেম-ওলামাকে যা ইচ্ছে তা-ই বলে থাকি। কখনো বা তাঁদেরকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করি। এমনকি কোনো কোনো সময় তাদের সাথে আমরা বেয়াদবিমূলক আচরণ করতেও কুণ্ঠাবোধ করি না। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমরা যদি এসব গর্হিত কাজের পরিণাম ও পরিণতি সম্পর্কে সম্যক অবহিত হতাম তাহলে কখনোই আমাদের দ্বারা এমন ভয়ানক কাজ করা সম্ভব হতো না। পবিত্র কোরআনে সুরা জুমারের ৯ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যারা আলেম এবং যারা আলেম না; তারা কী সমান হতে পারে?’ কোরআনের অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘অন্ধ আর চক্ষুষ্মান কী সমান হতে পারে?’ (সুরা রাদ, আয়াত-১৬)
অন্যত্র আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার এবং যারা জ্ঞানপ্রাপ্ত, আল্লাহ তাদের উচ্চ মর্যাদা প্রদান করেন।’ (সুরা মুজাদালা, আয়াত-১১) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, ‘আল্লাহ যার কল্যাণ করতে চান, তাকে দীনের ব্যাপারে ফকিহ (প্রশস্ত ও গভীর ইলমধারী বিজ্ঞ) বানিয়ে দেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৭১)
আলেমরাই হচ্ছেন পৃথিবীর সর্বোত্তম মানুষ। এ সম্পর্কে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি সর্বোত্তম যে নিজে কোরআন শিখে এবং অন্যকে তা শিখায়।’ (তিরমিযি, হাদিস নং- ২৯০৭) ওলামায়ে কেরাম হচ্ছেন পৃথিবীর বুকে হেদায়েতের বাতিস্বরূপ। এই হেদায়েতের বাতি যে দিন বন্ধ হয়ে যাবে, সেদিন পৃথিবী অজ্ঞতার আঁধারে নিমজ্জিত হয়ে যাবে। এ সম্পর্কে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আলেমদের দৃষ্টান্ত ওইসব তারকার মতো যাদের দ্বারা স্থলে ও জলের অন্ধকারে পথের দিশা পাওয়া যায়। আর যখন তারকাসমূহ আলোহীন হয়ে যায় তখন পথচারীর পথ হারাবার সম্ভবনা থাকে।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং-৩/১৫৭) অর্থাৎ ওলামায়ে কেরাম পৃথিবীতে না থাকলে মানুষের পথভ্রষ্ট হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। সুতরাং আলেমরা হচ্ছেন উম্মতের হেদায়েতের আলোকবর্তিকা। একজন আলেমের মৃত্যু উম্মতের জন্য ধ্বংসের কারণ। কেননা একজন আলেমের মৃত্যুতে উম্মতের জন্য যতোটা দীনি ব্যাপারে ক্ষতি হয় একটি গোত্রের সব মানুষ মৃত্যুবরণ করলেও সেই ক্ষতি হয় না। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আলেমদের মৃত্যু এমন মুসিবত যার প্রতিকার নেই এবং এমন ক্ষতি যা পূরণ হয় না। আর আলেম এমন এক তারকা যে (তার মৃত্যুর কারণে যেন পৃথিবী) আলোহীন হয়ে যায়। একজন আলেমের মৃত্যু অপেক্ষা একটি গোত্রের মৃত্যু অতি নগণ্য।’ (বায়হাকি, হাদিস নং- ২/২৬৪)
আলেমরা দুনিয়াতে না থাকলে ইলমও দুনিয়াতে থাকবে না। কেননা আলেমদের দুনিয়া থেকে উঠিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা দুনিয়া থেকে ইলেম উঠিয়ে নেবেন। আর ইলেম যদি দুনিয়াতে না থাকে তাহলে মানুষ হেদায়েতের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে গোমরাহের দিকে ধাবিত হবে। প্রিয়নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা (শেষ জামানায়) ইলেমকে এভাবে উঠিয়ে নেবেন না যে, লোকদের অন্তর থেকে সম্পূর্ণ বের করে নেবেন বরং তিনি ইলমকে এভাবে উঠিয়ে নেবেন যে, এক এক করে ওলামায়ে কেরামকে উঠিয়ে নেবেন। আর যখন কোনো আলেম দুনিয়াতে অবশিষ্ট থাকবে না তখন লোকেরা ওলামাদের পরিবর্তে অজ্ঞ ও মূর্খ ব্যক্তিদের নেতা বানিয়ে নেবে।’ (বুখারি, হাদিস নং-১০০)
ওলামায়ে কেরামের সমালোচনার পরিণতি : ইমাম হাফেজ আবুল কাসেম ইবনে আসাকির (র.) বলেন, হে ভাই জেনে রাখো, ওলামায়ে কেরামের দোষ চর্চা করা বিষাক্ত জিনিস। আল্লাহতায়ালার অভ্যাস হলো ওলামায়ে কেরামের কুৎসা রটনাকারীকে তিনি লজ্জিত করেন (এটা কারো অজানা নয়)। যে ব্যক্তি ওলামায়ে কেরামের সমালোচনা করবে আল্লাহ তার মৃত্যুর আগে তার অন্তরকে মৃত বানিয়ে দেবেন। (আত-তিবয়ান ফি আদাবে হামালাতিল কোরআন : ২৭-২৯) হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি (র.) বর্ণনা করেছেন, ইয়েমেনের বিখ্যাত মুহাদ্দিস কাজি ফকিহ মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ জাবিদি আশ-শাফেঈ (৭১০-৭৯২ হিজরি), যিনি ২৪ খণ্ডবিশিষ্ট ফিকহে শাফেঈর ‘আত-তাফকিহ ফি শরহিত তানবিহ’ নামক বিশাল ব্যাখ্যাগ্রন্থের রচয়িতা। মৃত্যুর সময় তাঁর চেহারা বিকৃত হয়ে যায়। এমন কী তাঁর জিহ্বা কালো হয়ে থুতনি পর্যন্ত বেরিয়ে যায়। উপস্থিত সবাই ধারণা করে তিনি জীবদ্দশায় ইমাম মুহিউদ্দীন নববী (র.)-এর অধিক সমালোচনা করার কারণে আজ তাঁর এ দুরবস্থা বরণ করতে হলো। (আদ্দুরারুল কামেনা : ৪/১০৬)
ওলামায়ে কেরামের প্রতি অবজ্ঞা করা এবং তাঁদের সঙ্গে উপহাস ও তাঁদের শানে বেআদবি করার প্রথম ফল হলো অন্তর মরে যাওয়া এবং এর সর্বশেষ পরিণাম অনেক ভয়াবহ। কেননা অভিজ্ঞতার আলোকে এ কথা প্রমাণিত যে যারা কোরআন-সুন্নাহ ও ইসলামের বিধি-বিধানকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখে তাদের বেশিরভাগের সূচনা হয়েছে কোরআন-সুন্নাহর ধারক-বাহক ওলামায়ে কেরামের সমালোচনা করা ও অবজ্ঞা দিয়ে। কেননা কোরআন-সুন্নাহর ধারক-বাহকদের নিয়ে হাসি-ঠাট্টা ও অবজ্ঞা করতে করতে তাদের অন্তর থেকে মূল কোরআন-সুন্নাহ ও ইসলামের প্রতি প্রকৃত মূল্যবোধ দূর হয়ে যায়। এভাবেই তারা ধীরে ধীরে সিরাতে মুস্তাকিম ও আবার কেউ একেবারে ইসলাম থেকেই সটকে পড়ে। যে কোনো মুসলমানকে গালি দেওয়া, বিদ্বেষী মনোভাব, ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা নাজায়েজ ও ফাসেকি কাজ। সুতরাং উম্মতের শ্রেষ্ঠ সমপ্রদায় উলামায়ে কেরামকে গালি দেওয়া, ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা যে কত বড় জঘন্যতম কাজ তা বলাইবাহুল্য। আলেমের সঙ্গে দুশমনি ও গালি দেওয়ার কারণ দুটি হতে পারে। ১. ব্যক্তিগত কোনো কারণে। ২. আলেম হওয়ার কারণে। কোনো আলেমকে আলেম হওয়ার কারণে গালি দেওয়া, তাঁর সঙ্গে শত্রুতা বা বিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করা একটি কুফরি সমতুল্য। এটি খুবই ভয়াবহ মানসিকতা। এমন মানসিকতা লালনকারী ব্যক্তি তাওবা না করলে ঈমানের সঙ্গে তার মৃত্যু হবে কি-না ঘোর সন্দেহ আছে। আল্লামা জাইনুদ্দিন ইবনে নুজাইম মিসরি (র.) বলেন, যদি কেউ কোনো আলেম বা ফকিহকে ব্যক্তিগত কোনো কারণ ছাড়া (আলেম হওয়ার কারণে) যদি গালি দেয়, তাহলে সে কাফির হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।’ (আল-বাহরুর রায়েক : ৫/১৩২)
ওলামায়ে কেরাম হলেন আম্বিয়া কেরামের ওয়ারিশ ও তাঁদের প্রতিনিধি। আল্লাহতায়ালা তাঁদের মনোনীত করেছেন দীনের জন্য। হজরত আবু দারদা (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘আবেদের ওপর আলেমের ফজিলত এরূপ, যেরূপ পূর্ণিমার রাতে চাঁদের ফজিলত সব তারকারাজির ওপর। আর আলেমরা হলেন নবীদের ওয়ারিশ। আর নবীরা দিনার-দিরহাম মিরাস হিসেবে রেখে যান না; বরং তাঁরা রেখে যান ইলম। কাজেই যে ব্যক্তি ইলম হাসিল করল, সে প্রচুর সম্পদের মালিক হলো।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং-৩৬৪২)
লেখক : খতিব মসজিদে বায়তুন নূর, মাওনা, গাজীপুর