সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকার পচেসস্ট্রুম থেকে বাংলাদেশের টেকনাফ-তেঁতুলিয়ায় একই রব- ‘শাবাশ বাংলাদেশ, শাবাশ বাংলাদেশ।’ রকিবুল হাসান, শামীম কবির, শফিকুল হক হীরাদের মাধ্যমে হাতেখড়ি আমাদের ক্রিকেটের। পরবর্তীকালে আকরাম খান, নান্নু, বুলবুলদের পর সাকিব, মুশফিক, মাশরাফিরা বাংলাদেশের
ক্রিকেটকে যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, আকবর আলী, শফিউল, ইমনরা সেটাকে পূর্ণতা দিলেন বিশ্ব শিরোপা লাভের মাধ্যমে। চারবারের অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়ন ভারতকে সহজেই বিধ্বস্ত করে জুনিয়র টাইগাররা এখন বিশ্বসেরা। এর চেয়ে ক্রিকেটে আনন্দের উপলক্ষ আর কিছুই হয়তো হতে পারে না।
আসলে অনেক সময় আনন্দ প্রকাশের কোনো সীমা-পরিধি থাকে না। স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশের ইতিহাসে যে কয়টি বড় আনন্দের উপলক্ষ সৃষ্টি হয়েছে, তার প্রায় প্রতিটিই এসেছে ক্রিকেট থেকে। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জয়ের মধ্য দিয়ে এদেশের মানুষ ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে যে উল্লাস-উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠার উপলক্ষ পায়, তার সর্বশেষটি এবার আমরা দেখলাম পচেসস্ট্রুমে। বাংলাদেশ কোনো বৈশ্বিক ক্রিকেট কিংবা যে কোনো ক্রীড়া আসরে এই প্রথম শিরোপা জিতলো। ১৯৯৯ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে হারিয়ে আরো একটি বিজয়ের সূত্রপাত ঘটান। ওয়ানডে স্ট্যাটাসের পর ২০০০ সালে বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস লাভ করে। এরপর ২০০৫ সালে প্রথম টেস্ট ম্যাচ জেতে বাংলাদেশ। এরপর থেকে হয়তো টানা ভালো খেলার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেনি; কিন্তু বড় বড় টেস্ট খেলুড়ে দলকে পরাজিত করা কিংবা ওয়ানডের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন সব দলকেই কমবেশি পরাজিত করার কৃতিত্ব দেখায় টাইগাররা। সবকিছুর পরও একটা ক্ষত আমাদের হ্রদয়ে পুঞ্জীভূত ছিল, একটা আক্ষেপ মনকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। তা হলো, বাংলাদেশ কোনো বিশ্ব শিরোপা লাভ করতে পারছিল না। সিনিয়রদের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশ চূড়ান্তপর্বে বেশ ভালো কিছু ফলাফল করে। তারা শেষআটে পৌঁছে কয়েকবার। তাও ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশকে হারিয়ে কিংবা বিদায় করে। একবার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালেও ওঠে। কিন্তু ওই পর্যন্তই ছিল আমাদের দৌড়। এবার সবকিছুকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ বিশ্বসেরার খেতাব অর্জন করলো।
এবারের আসরের আগে ১৯৮৮ সালে প্রথম যুব বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয় অস্ট্রেলিয়া। দুই বছর অন্তর চলছে বিশ্বকাপ। এরপর ১৯৯৮ সালে ইংল্যান্ড, ২০০০ সালে ভারত, ২০০২ সালে অস্ট্রেলিয়া, ২০০৪ সালে পাকিস্তান, ২০০৬ সালে পাকিস্তান, ২০০৮ সালে ভারত, ২০১০ সালে অস্ট্রেলিয়া, ২০১২ সালে ভারত, ২০১৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা, ২০১৬ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং ২০১৮ সালে ভারত শিরোপা লাভ করে। ত্রয়োদশ শিরোপা পেল বাংলাদেশ। যুব বিশ্বকাপ হোক, বিশ্বকাপ হোক কিংবা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি হোক, এই প্রথম বিশ্বসেরার খেতাব জিতলো বাংলাদেশ। অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, জিম্বাবুয়ের মতো দেশ বিশ্ব ক্রিকেটের মূল আঙিনায় বাংলাদেশের আগে বিচরণ শুরু করে। অথচ এসব দেশকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশের কিশোর-তরুণরা আমাদের মর্যাদাকে বিশ্বের এক নম্বরে নিয়ে গেল।
গতকাল শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে বিশাল স্ক্রিনে খেলা দেখে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী একসঙ্গে উদযাপন করেছে ভারতের মতো শক্তিশালী দলকে হারানোর মুহূর্তটি। সেইসঙ্গে বাংলাদেশের বিশ্বজয়ের উল্লাসে তারা মেতে থাকে গভীর রাত পর্যন্ত, যা ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফির ফাইনালে উঠে বিশ্বকাপের টিকিট অর্জনের মতোই মনে হয়েছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি- কোনো ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ যে শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয় না, তার আরো একটি প্রমাণ দিলো আকবর বাহিনী। আকবরদের উচ্ছ্বাসের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে পড়েছে গোটা বাংলাদেশ। এখানেই শেষ নয়, আকবরদের সাফল্যের সূত্র ধরে বাংলাদেশ এখন সিনিয়র লেভেলেও বিশ্ব শিরোপা জিতবে, এটাই সতেরো কোটি মানুষের স্বপ্ন।