আবহমান কাল থেকেই সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা রূপেই বঙ্গীয় জনপদ নিজের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করে এসেছে। এই রূপ শাশ্বত বাংলার গ্রামীণ রূপ। আষট্টি হাজার গ্রামের মানুষের সচেতন, সুচিন্তিত ও সুবুদ্ধি দীপ্ত সিদ্ধান্ত আমরা দেখেছি। এ দেশের মুক্তিযুদ্ধে তাদের আত্মত্যাগ, সক্রিয় ভূমিকা ও দেশমাতৃকার তরে জীবন বাজি রেখে সাহসী অংশগ্রহণেও অসামান্য অবদান রেখেছেন তারা। এমনকি, সাধারণ পুরুষ মানুষের পাশাপাশি সহজ-সরল গ্রামীণ নারীদের ভূমিকাও আমাদের আজকের পরিচয়ে অনন্য সাধারণ কৃতিত্বের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় এবং তা ইতিহাস স্বীকৃতও বটে।
স্বাধীনতা-উত্তর এ দেশের গ্রামবাংলার সম্মানিত কৃষক ভাইয়েরা সাড়ে সাত কোটি মানুষের পেটে ভাত তরকারি জুগিয়ে আমাদের আজকের পরম্পরায় প্রায় সতেরো কোটি মানুষের সামগ্রিক অন্নের ব্যবস্থা করে চলেছেন নিরলসভাবে। কতটুকু শিক্ষাদীক্ষা অর্জন করে ঋতু বৈচিত্র্যকে বিবেচনায় রেখে কখন কীভাবে খরিশস্য, রবিশস্য উৎপাদন করা যায় এবং কোন প্রক্রিয়ায় চাষাবাদ করে কতটুকু মাটির ব্যবহার করে শীত-গ্রীষ্ম, বসন্তের ফসল বিভাজন শিখে সেই লাঙল নিড়ানি বিভিন্ন রকম দেশীয় প্রযুক্তির ব্যবহার শিখে, সময় ও পরিবেশের প্রতিকূলতাকে সামাল দিয়ে, কতটুকু ঘাম, শ্রম আর ত্যাগ নিয়োজিত করে উপযুক্ত ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে আমাদের ক্ষুধা নিবারণ করে আসছে, তা আমরা কজনই বা জানি। খাঁটি শহুরে পরিচয়ে যারা বেড়ে উঠেছেন তাদের বেশিরভাগের পক্ষে বিষয়টি অনুধাবন করার সক্ষমতা নেই। মিছে অহংবোধের কারণে এসব বীরত্বসম্পন্ন মানুষকে বরং অশিক্ষিত, অমার্জিত নানা নেতিবাচক শব্দ প্রয়োগে একটু খাটো করে দেখার প্রবণতা শহুরে অনেকের মধ্যে লক্ষ করা যায়, যা দুঃজনক।
নদী বা বিল পার্শ্ববর্তী কৃষিজমিতে বর্ষাকালে দেখেছি হাওজা নামে কচুরিপানা বাতাসে ভেসে এসে যখন ধানের জমিতে ধানের ক্ষতি করত কিংবা ক্ষতি করার সম্ভাবনা তৈরি করত, তখন কতটা মেধা, বিদ্যা-বুদ্ধি খাটিয়ে গ্রামের প্রায় সকল মানুষ লগি ঠেলে নৌকা নিয়ে কখনো একসাথে ব্যারিকেড তৈরি করে উজান ঠেলে সেই বাধা অপসারণ করত কিংবা পানিতে পাট জাগ দিয়ে ওপরে কচুরিপানা চেপে দিয়ে কতদিন পর শরীরে কোন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে জাগ সম্পন্ন হয়েছে তা যথাযথভাবে অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সোনালি আঁশ উৎপাদন করত। যে সোনালি আঁশের পরিচয়ে আমরা বিশ্বে অনন্য পরিচিতি লাভ করেছি, যে সন্তানরা এ আর্থিক উপার্জন করে দেশের অর্থনীতিকে সচল ও স্বনির্ভর করেছে তাদের পরিচয়টা অত্যন্ত সন্মানজনক হওয়াটাই সমীচীন ছিল। বিপরীতে তাদের শুরু থেকে পরম্পরা হয়ে আজো আমরা শিক্ষাদীক্ষা সামাজিক স্বীকৃতির ক্ষেত্রে উঁচু আসন তো বিবেচনা করিই না বরং নাক সিঁটকিয়ে বিপরীতে তাদের পরিচয় কতটা অযৌক্তিকভাবে খাটো করে, হেয় করে, গেঁয়ো বলে তুলে ধরা যায় তাই করছি আমরা।
যেসব সাংস্কৃতিক নক্ষত্রমণ্ডলীর অস্তিত্বকে বলি শুধুই আমাদের, যে আলোয় সারা পৃথিবীর সাংস্কৃতিক পরিচয় থেকে পৃথক করে ভিন্ন সত্তাসম্পন্ন জ্ঞান, শিক্ষা, দীক্ষা, মানে-গুণে অনন্য প্রকাশ পেয়েছে তার বেশিরভাগই গ্রাম্য বা গ্রামীণ মানুষের সৃজনশীলতার আত্মপ্রকাশ, যা সামগ্রিক সংস্কৃতিকে করেছে ঋদ্ধ। আমাদের অস্তিত্বের জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, গম্ভীরা, পল্লিগীতি, যাত্রাপালা, কবিগান, বাউল গান আরো কতকিছু লোকজ সুর, গীতি বিশ্বদরবারে নন্দিত এবং গবেষণার আধার হিসেবে উপজীব্য তার প্রায় সবই তো গ্রামের মানুষের হাত ধরে এবং গ্রামীণ পরিবেশ প্রকৃতি থেকে উৎসারিত, যা বিবেচনার বাইরে রেখে চিন্তা করলে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সমগ্রের আর কতটুকুই বা অস্তিত্ব থাকে। আবার যতটুকুই বা থাকে তার আবার সবটুকু যে শিক্ষিত পরিমার্জিত চেহারায় উপস্থাপিত হয় আমাদের সামনে তাও কিন্তু বড়াই করে বলার উপায় নেই। হ্যাঁ, সেইসাথে আবার আধুনিকতার স্পর্শে কিছু ভালো সৃষ্টি তো অবশ্যই আছে, সেটুকুর অনন্যতাও অনস্বীকার্য এবং সম্মানজনকও বটে। তদুপরি, গ্রাম্য গীতিকার সুরকারদের হাত ধরে যেসব সৃষ্টি উপহার আমরা পেয়েছি তার মধ্যেও অগাধ জ্ঞান গরিমা, পাণ্ডিত্য, শিক্ষা-দীক্ষা সবকিছুরই গুণগতমান অত্যন্ত সন্মানজনক এবং প্রশংসনীয়। যারা অন্তত প্রকৃত জ্ঞান চর্চা করেন তাদের কাছে তো বটেই। তবুও তাতে জোর করেই যেন কিছু একটা দুরভিসন্ধি নিয়ে গেঁয়ো পরিচয়ের নেতিবাচক ভাব জড়িয়ে রেখেছেন পণ্ডিত জ্ঞানেশ্বররা।
সাহিত্য রচনা ও চর্চার ক্ষেত্রে গ্রাম্য লেখকদের পাশাপাশি অনেক আধুনিক শিক্ষিত লেখক গ্রামে বাস করে নিজেকে গ্রাম্য পরিবেশে অভিযোজিত করে কাব্য-মহাকাব্য রচনা করেছেন। সেই অর্থে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামসহ হাছন রাজা, ফকির লালন সাঁই, কবি জীবনানন্দ দাশ, পল্লিকবি জসীমউদ্দীন সকলেই অনেক বেশি গ্রাম্য আধারকে উপজীব্য করেছেন তাদের রচনাশৈলীতে। সরাসরি গ্রামে বসবাসকারী কতশত কবি-সাহিত্যিক লেখক দেশের সামগ্রিক সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন তার সঠিক পরিসংখ্যানই বা আমরা কজনে জানি। এ মৃত্তিকার সন্তান চিত্রা নদীর অববাহিকার সেই মাসুমদিয়া গ্রামের হতদরিদ্র রাজমিস্ত্রির ছেলে লালমিয়াই একদিন পরিণত হয়েছিলেন রংতুলির জাদুকর এস এম সুলতান নামে। কত গ্রামীণ চিত্রকরের চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে দেশি-বিদেশি গ্যালারিতে। হায়, তবুও গ্রাম্য মানে পিছিয়ে পড়া জনপদ আর জ্ঞান-গরিমার অভাবসম্পন্ন মানুষ মনে করা হয় তাদের। সেই কবে যে এর উৎপত্তি হয়েছে বলতে পারব না, কিন্তু এখনো যে সে চোখেই দেখা হয় এমনতর অযৌক্তিক প্রকাশ আমাকে খুব যৌক্তিকভাবেই বিস্মিত করে। আর আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে কোন শিক্ষিত মার্জিত জ্ঞানেশ্বরের চিন্তাচেতনা থেকে এমন নেতিবাচক অভিব্যক্তির জন্ম হয়েছে?
দেখুন তো, আধুনিক সময়ে এসেও বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সিংহভাগ ভূমিকা রাখছে যেসব ইস্যু তাদের মধ্যে গার্মেন্ট শিল্প ও জনবল রপ্তানি অন্যতম। এরা তাদের স্বশিক্ষার ব্যবহার করেই এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখে দেশকে সচল রেখেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ক্ষেত্রবিশেষ ঘাটতি থাকলেও, স্বকাজে তারা শিক্ষিত নয়, মার্জিত নয় নিশ্চয়ই এমনটা আমরা কোনোভাবেই বলতে পারি না। ভাবুন তো এরা কারা? এরা সেই গ্রাম জনপদের গ্রাম্য। অথচ এরাই কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন আর মুক্তিযুদ্ধের মতো কঠিন সংগ্রামের অন্যতম সারথি।
আমার অনুযোগ মূলত এখানেই। যদিও বলা দরকার পুরো রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিংবা অপেক্ষাকৃত কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ পদে এখনো যারা কর্মরত আছেন তাদের মধ্যে খুব নগণ্যসংখ্যক গ্রামের মানুষ কাজ করছেন তা বলার অবকাশ নেই মোটেই। তাহলে ‘গ্রাম্য’ শব্দটির অর্থ কি কোনোভাবেই এত বেশি নেতিবাচক হওয়ার যৌক্তিকতা রাখে? আমার মনে হয় না। জানি দ্বিমত পোষণ করার মতো অনেকেই থাকবেন। তথাপি তর্ক থেকে নিজেকে বিরত রেখে বিনয়ের সঙ্গে বলছি, যা দেখে আমার অস্তিত্বে সজোরে আঘাত লেগেছে তার সমার্থক শব্দগুলো যদি ‘গ্রাম্য’ অর্থে সেকেলে বা পুরোনো বা পুরাতন, আদি এমন হতো তাহলে এতটা আঘাত অনুভব করার প্রয়োজন পড়ত না।
একটি কবিতার নাম পছন্দকরণে শব্দ খোঁজার প্রয়াস নিয়েছিলাম বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলা অভিধানে। পৃষ্ঠা উল্টাতে গিয়ে হঠাৎ যেখানে চোখ থেমে গেল, সঙ্গে সঙ্গেই গায়ের জ্বালা অনুভব করলাম, যখন দেখলাম আভিধানিক অর্থে ‘গ্রাম্য’ মানে অশিক্ষিত, অমার্জিত এমন দুটি শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে। আমার খোলা মনে খুব জানতে ইচ্ছে করে এমন দুটি শব্দের ব্যবহার কীভাবে, কেন এবং কোন সে পণ্ডিতের হাত ধরে বাংলা অভিধানে প্রথম প্রবেশ করেছে? এবং আরো অবাক হয়েছি পরম্পরা অতিক্রম করে এখন পর্যন্ত অভিধানে শব্দ দুটির স্থান তেমনিভাবেই অক্ষত রয়েছে! আরো বেশি অবাক করেছে ‘গ্রাম্যতা’ শব্দের অর্থ ‘অশালীনতা’ লিপিবদ্ধ রয়েছে এ অভিধানে! অর্থাৎ অশিক্ষিত, অমার্জিত বলেই ক্ষান্ত হননি, আমার ভাষা, আমার মায়ের কাছে শেখা ‘মা’ ডাককেও তারা মতান্তরে অশালীন বলে অসম্মান দেখিয়েছেন। আর সেটাই আমরা শিখে যাচ্ছি যুগ যুগ ধরে। আমি গ্রামের মানুষ, আমার সন্তানের এমন আপত্তিকর প্রশ্নের উত্তরে আমি কি এটাই শেখাব? নিশ্চয়ই না। দুষ্টবুদ্ধির পণ্ডিতগণ আমার খেয়েপড়ে, আমার সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা করে, আমার পরিচয়কে অশিক্ষিত, অমার্জিত বলে আমার মায়ের ভাষাকে অমর্যাদা করে আবার আমাকেই তা পাঠ করাচ্ছে? বাহ, হায়রে পাণ্ডিত্য! কোন বিবেক বিবেচনা যুক্তিতর্কে আমার বিরুদ্ধে এমনতর অভিব্যক্তির প্রকাশ, আজ আমার সত্যিই জানার খুব সাধ জাগে। সেইসঙ্গে কেমন সুশিক্ষিত ও পরিমার্জিত পণ্ডিতের হাত ধরে এমন শব্দগুলো বাংলা অভিধানে এসেছে তা আমার জিজ্ঞাসাও বটে।
সর্বোপরি, আমার অনুযোগ যদি গ্রহণযোগ্য ও সমাদৃত হয়, যৌক্তিক ও সাধুবাদযোগ্য হয়, আমি বাংলা একাডেমির বর্তমান চেয়ারম্যান স্যারকে অনুরোধ রাখতে চাই, এই অনুযোগের যথার্থতা বিবেচনা করে ‘গ্রাম্য’ মানে অশিক্ষিত ও অমার্জিত, এ দুটি শব্দকে এবং ‘গ্রাম্যতা’ মানে অশালীনতা এ শব্দটিকেও বাংলা অভিধান থেকে চিরতরে মুছে দেওয়া যায় কি না তা বিশেষভাবে বিবেচনা করে দেখার জন্য।
লেখক : পুলিশ সুপার, গীতিকবি ও কণ্ঠশিল্পী