স্রষ্টার সৃষ্ট এই ধরণি কত বিচিত্র! যাদের মন আছে বোঝার ও উপলব্ধি করার, তারাই এই বৈচিত্র্য দেখে নিজেকে করেন আপ্লুত। আর এই প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য দোলায়িত করে মননকে। বিশেষ করে যারা শিল্পমানস। ঋতুর কালক্রমে এখন হেমন্তকাল। হালকা শীতে আমরা নবান্নের উৎসবে মেতে উঠেছি। প্রকৃতি সেজেছে নানা ঢঙে। কচুরি ফুলে নদীবুক সফেদ-নীল। কুয়াশার চাদরে মোড়ানো ভোর ও সকাল।
নিশির জ্যোৎস্না-আঁধারিতে ফোটে শেফালি। বিল-ঝিলের জলে পদ্ম ফুটে দৃষ্টিকাড়া দৃশ্যের অবতারণা করে। মল্লিকা নামক চমৎকার পুষ্পটিরও দেখা মেলে বিভিন্ন স্থানে। তরুবীথিকার পত্র-পল্লব ঝরে পড়ার জন্য ধারণ করে হলুদ রঙ। নবান্নের উৎসবে মেতে উঠেছে পল্লিগ্রাম। ধান কেটে মুক্ত জমিনে কৃষক সরিষা, সবজি, ইরির চারা করা ইত্যাদিতে ব্যস্ত। পিঠা-পুলির গন্ধে মোহিত চারপাশ। আমাদের এই ষড়ঋতুর দেশের ভিন্নস্বাদের ঋতু হেমন্ত। এই হেমন্ত নিয়ে প্রাচীনযুগ থেকে আজ অব্দি কাব্যকোবিদ মানস হয়েছে সরব ও সরস। পৃথিবী ভৌগোলিক দিক থেকে বিভিন্ন অঞ্চলকে করেছে বিশেষায়িত। আমাদের এখানে যখন হাড়কাঁপানো শীত, তখন অন্যান্য দেশ বা অঞ্চলে ঘাম ঝরানো গরম। আবার সব অঞ্চলে দেখা মেলে না ছয় ঋতুর। হয় না আমাদের ষড়ঋতুর মতো বৈচিত্র্যময়। এশিয়া, উত্তর আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের তিনটি দেশের হৈমন্তিক আবহের তিনটি কবিতার বাঙলায়ন আমাদের শিল্পমানস পাঠকদের এই শীতেও হেমন্ত উদযাপনে নতুন এক মাত্রা সংযোজন করবে নিশ্চিত।
ইরান
শিল্প-সাহিত্যের এক লীলাভূমি বলা চলে ইরান বা পারস্যকে। আর এই ইরান বা পারস্যে কিন্তু ঋতু হয় চারটি। তিন মাসে এক ঋতু। মধ্যপ্রাচ্যের পূর্বপাশঘেঁষা এই পাহাড়ি দেশটির অভ্যন্তরে তেমন নদী পরিলক্ষিত হয় না। বৃষ্টি হয় শীত মৌসুমে। বৃষ্টির ফলে শীতের প্রকোপ আরো বেড়ে যায়। বরফ এমনভাবে পতিত হয় যে গাছপালা মরেও যায়। এই আবহাওয়ার দেশে বর্ষা বা শ্রাবণকাল অনুপস্থিত। সঙ্গে আরেকটি ঋতুও সরাসরি অনুপস্থিত যার নাম হেমন্ত। তবে হেমন্ত কালের বৈশিষ্ট্যের অনেকাংশ পাওয়া যায় প’য়িঝ বা শরৎকালে। আর কিয়দংশ পাওয়া যায় ঝেমেস্তান বা শীতকালে। এ-সময় গ্রামীণ ইরানে নবান্ন বা ফসলি উৎসব পালন করা হয়। গাছের পাতাগুলো হলুদ হয়ে ঝরে যেতে শুরু করে। হালকা শীত অনুভূত হয়। এই সময়কে ইরানিরা খাজান বা শস্য মৌসুম হিসেবেও উল্লেখ করে থাকে। আর এই মৌসুমকে ফারসি ভাষার কাব্যপ্রেমীরা নানা ব্যঞ্জনায় তুলে এনেছেন তাদের কাব্যে। এরকম একটি কবিতার তরুণ কবি নাগমেহ মাক্বসুদ লো ইরানের কিশ শহরে ফারসি ১৩৬০ সালের ফারভারদিন মাসের ১৬ তারিখ জন্মগ্রহণ করেন। ৩৭ বছর বয়সের এই কবির দুটো কাব্যগ্রন্থ আছে। তিনি ঋতু ও প্রকৃতি নিয়ে কবিতা লিখতে ভালোবাসেন। হেমন্তকাল কবিতাটি কবি নাগমেহ মাক্বসুদ লো’র ‘খাজান’ নামক কবিতার বাঙলায়ন। শেরে নু ডটকম থেকে সংগৃহীত।
যুক্তরাষ্ট্র
শীতকাল দিয়ে শুরু হওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চারটি ঋতু হলো যথাক্রমে শীত, বসন্ত, গ্রীষ্ম ও হেমন্ত। তুষারপাত আর দাবানলের মার্কিনমুলুকে অক্টোবর, নভেম্বর আর ডিসেম্বর মিলে হয় হেমন্তকাল। আমেরিকার মেঘমুক্ত পরিষ্কার আকাশ জানান দেয় হেমন্ত আগমনের। বিশ্বমোড়লদের দেশে বেশিদিন স্থায়ী হয় না হৈমন্তিক আবহ। এই পাতাঝরার কাল যতদিন আমেরিকার প্রকৃতিতে থাকে ততদিন এক অপরূপ সৌন্দর্যের মিলনমেলা বসে। হেমন্ত তার নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষ করলে পাতাগুলো আবার সবুজ বর্ণ থেকে বাহারি রঙে রূপান্তরিত হয়। সাত সমুদ্রের দূরের সেই মার্কিনমুলুক আর আমাদের এই বঙ্গীয় ব-দ্বীপে হেমন্ত প্রায় একই সময়ে হয়। আমেরিকার হেমন্তকে ধারণ করে কবিতা লিখেছেন মেরিলিন ক্যালেট। তিনি আমেরিকার আলাবামা প্রদেশের মন্টগোমেরিতে ২৮ ডিসেম্বর ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তার বেড়ে ওঠা নিউইয়র্ক সিটিতে। তার এ পর্যন্ত আঠারোটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি তেনেজ্জি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক। তিনি ফ্রান্স ও পোল্যান্ডে আমেরিকান দূতাবাসের পক্ষ থেকে ‘প্যারেন্টস প্রোগ্রাম’-এ অতিথি হিসেবে কবিতা পাঠ করেন। ক্যালেটের ‘অড টু লেইট অটাম’ বা ‘হেমন্ত নিয়ে গীতিকবিতা অউভিলার’ নামক কবিতাটি Plume ম্যাগাজিনের মার্চ ২০১৬-এর ৫৬তম সংখ্যা থেকে সংগৃহীত।
অস্ট্রেলিয়া
অস্ট্রেলিয়ায় চারটি ঋতু। গ্রীষ্ম, শরৎ (হৈমন্তিক আবহ ধারণকৃত), শীত ও বসন্ত। ১ ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির শেষদিন পর্যন্ত গ্রীষ্ম। ১ মার্চ থেকে মে’র শেষদিন পর্যন্ত শরৎ বা হেমন্ত। ১ জুন থেকে গোটা আগস্ট মাস শীতকাল। অনুরূপ সেপ্টেম্বর মাসের প্রথমদিন থেকে জানুয়ারির ৩১ তারিখ পর্যন্ত বসন্তকাল। সুতরাং অনুমেয় যে আমাদের এখানে যখন হেমন্তকাল তখন পৃথিবীর সব থেকে ছোট্ট মহাদেশের প্রবালদ্বীপের রাষ্ট্রটিতে বসন্তঋতু। অস্ট্রেলিয়ায় মূলত ঠিক করে আবহাওয়াগত বিষয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না। কখন যে আবহাওয়ার পরিবর্তন হবে তা ঠাহর করা খুবই দুষ্কর। তবে মার্চ থেকে মে বা জুন পর্যন্ত প্রাকৃতি হলুদ বরণ ধারণ করে। আকাশে খণ্ড খণ্ড মেঘ উড়ে বেড়ায়। এ সময় পর্যটকদের ভিড় বেশি থাকে অস্ট্রেলিয়ায়। আসলে আমাদের এই সবুজ মাতৃকার মতো অনন্য দেশ খুঁজে পাওয়া বড্ড কষ্টসাধ্য। ‘হৈমন্তি’ কবিতাটি অস্ট্রেলীয় কবি এম এস লিমের ‘লেইট অটাম’ কবিতার বাঙলায়ন যা পোয়েট্রি ফাউন্ডেশন থেকে চয়িত।
নাগমেহ মাক্বসুদ লো
হেমন্তকাল
পল্লবের রুগ্ণ ঋতু, কিশলয়ের ভয়ের ঋতু
মাতাল হওয়ার কাল আর ফসল তোলার কাল
গলিগুলোর ভিতর
গগন তার গর্জনসমেত আসে
প্রত্যেক বয়স্ক গাছের অভ্যন্তরে ঝাঁকুনি
শীতলতার যোদ্ধা
সিংহাসনে বসে
নির্বাসিত ঋতুদের প্রেমিক হয়েছে
বিলাপের কাল, তরুবীথির নাশের কাল
আর এই হেমন্ত মৌসুমে
আমি ও এই তনু কেঁদেছি
একটি রাতুল পুষ্পের জীবনের জন্য
মনকে পাথারে ছুড়েছি
এই আমি যে পল্লবগুলির আরোগ্য
দোয়ায় বসেছি, একাকিত্বের একাকী
এই আমি যে বুলবুলির হাসির জন্য
হেমন্ত ভূতের হস্ত-পদে
আমার দু’হাত দিয়ে শিকলবন্দি করব
আমি সূর্যের প্রত্যাশায় যাব আর দ্বিতীয়বার বলব
এক আলোকোজ্জ্বল ও উষ্ণ পৃথিবীর সাথে তরুবীথিকার দিকে পা বাড়াবো...
হেমন্ত নিয়ে গীতিকবিতা, অউভিলার
মেরিলিন ক্যালেট
হলুদাভ পল্লব আর নীলিমা নদী
সঙ্গীতে কিছু যোগ করো না,
সান্ত্বনা দিও না।
কিন্তু এটা না থাকা সম্পর্কে গীত নয়
একটি কৃষ্ণপক্ষি
সোনালি পল্লবে
আর অনাবৃত মগডালগুলো
আবিররাঙ্গা ঔজ্জ্বল্য
তারপর আমার ঠোঁটের প্রসাধনী।
নীলিমা পক্ষি কিচিরমিচির করছে
গাছ থেকে গাছে।
কিছু তাদের কাছে জ্ঞাত
কী আসছে?
তারা এটিকে তুষারপাত নামকরণ করেছে
তারা খেদোক্তি করছে না
হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কে।
তাদের সম্মুখপানে উড্ডয়নের জন্য কী প্রয়োজন,
আমার মতো।
তুমি যদি আমার থাকতে,
আমরা বাড়ির দিকে দীর্ঘ পথ নেবো।
হৈমন্তি
এম এস লিম
হেমন্তের সঙ্গীত বিষাদগ্রস্ত
দমিত আর অনাড়ম্বরে তাড়িত
নিস্তব্ধ বৃক্ষলতা ও ঝরাপাতার ভিতর
বিহগেরা ঝাঁক বেঁধেছে
আর তাদের গানকে ক্ষান্ত দিয়েছে
এমনকি সন্ধে বেলায়ও
আর যখন নিশাকর ও নক্ষত্ররাজিকে
সজ্জিত মনে হয় এবং ঝলকাতে থাকে
আজ রাতে কত হূদ একাকী ও অবহেলিত
তাদের ব্যাকুল ঈপ্সায়?