মুক্তমত

আফগানিস্তান থেকে ন্যাটো সৈন্য প্রত্যাহার এবং ভবিষ্যৎ সংকট

  • প্রকাশিত ৮ জুলাই, ২০২১

জাফরুল ইসলাম

 

আফগানিস্তান পাহাড়বেষ্টিত মুসলিম প্রধান দেশ। ১৯১৯ সালে  দেশটি  যখন স্বাধীন হয় তারপর থেকেই রাজতন্ত্র কায়েম হয়। ১৯৩৩ সালে জহির শাহ ক্ষমতা গ্রহণ করে টানা ৪০ বছর রাজতন্ত্র কায়েম থাকার পর ১৯৭৩  সালে প্রজাতন্ত্র ফিরে আসে। আর এই  প্রজাতন্ত্রের জের ধরেই আফগানিস্তানে রুশ-মার্কিন প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। এই দ্বন্দ্বের জের ধরেই ১৯৭৯ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন সৈন্য আফগানিস্তানে প্রবেশ করে। সোভিয়েত সৈন্যর অনুপ্রবেশ মার্কিনরা কখনোই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। যার ফলে শুরু হয় রুশ বাহিনীকে আফগানিস্তান থেকে বিদায় করার পরিকল্পনা। এমন ভাবনা থেকেই মার্কিনরা পাকিস্তানের সহযোগিতায় আফগানিস্তানে তালেবান নামক জিহাদি সংগঠন গঠন করে। এই তালেবানদের তারা অর্থ এবং সামরিক প্রযুক্তি দিয়ে সাহায্য করতে থাকে, যদিও যুক্তরাষ্ট্র সাহায্যের বিষয়টি অস্বীকার করেছে। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়া ছিল আমেরিকার মিত্র। অর্থাৎ CIA এবং ISI এই দুই গোয়েন্দা সংস্থা মিলে তালেবান নামক সংগঠনকে শক্তিশালী করতে থাকে। তালেবানদের সাথে পেরে উঠতে না পেরে অবশেষে ১৯৮৯ সালে সেখান থেকে সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। অর্থাৎ সৈন্য প্রত্যাহার করার মাধ্যমে আমেরিকার একটা মিশন সম্পন্ন হয়, যেটা ছিল সোভিয়েতদের প্রভাব খর্ব করা যাতে আমেরিকা সফল হয়।

কিন্তু ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর শুরু হয় আমেরিকার সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, যেখানে ওসামা বিন লাদেনের আল-কায়েদার নাম ছিল। আর এই আল-কায়েদা তালেবানদের সাথে মিত্র সম্পর্ক গড়ে তোলে। এই মিত্রতাই তালেবানদের জন্য অশনিসংকেত হয়ে দেখা দেয়। এরপর শুরু হয় আমেরিকার নেতৃত্বে ন্যাটো সেনা মোতায়েন এবং আফগানিস্তানে আগ্রাসন নীতি পরিচালিত হতে থাকে। আমরা জানি ১৯৯৬ সালে তালেবানরা আফগানিস্তানে শাসন ব্যবস্থা কায়েম করে। তার আফগানিস্তানে ৬ বছর ক্ষমতায় ছিল। এই ছয় বছরের শাসনে গণতান্ত্রিক মানুষের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ৬ বছরে তালেবানরা তাদের শক্তিশালী সমর্থক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। এরপর আফগানিস্তানের শাসন ক্ষমতায় আসে হামিদ কারজাই। এই হামিদ কারজাই নির্বাচনের মাধ্যমে জয়লাভ করলেও আফগানিস্তানের জনগণের আস্থাভাজন হতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের আশীর্বাদপুষ্ট এবং হুকুম বাস্তবায়ন করার জন্যই তিনি ক্ষমতাসীন হন। আর এভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে থাকে।

২০০১ থেকে বর্তমান ২০২১ সাল পর্যন্ত আমেরিকার আফগানিস্তান থেকে কথিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু তারা তাদের দুটি মিশন সম্পন্ন করতে পেরেছে। এক লাদেনকে হত্যা, অন্যদিকে আফগানিস্তানে পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা করা। বর্তমান আফগান সরকার আশরাফ গনিও আমেরিকার মদতপুষ্ট। আমেরিকা তার সৈন্য প্রত্যাহার করা শুরু করেছে আফগানিস্তান থেকে। সৈন্য প্রত্যাহার করার মাধ্যমে আমেরিকা বলছে, আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা তারা নিজেরাই সমাধান করুক। এদিক থেকে আফগানিস্তান সরকারও বলছে, তারা নিজেরাই তালেবানদের সাথে লড়াই করে টিকে থাকতে পারবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আদৌ তারা পারবে কি না। কারণ তালেবানদের রয়েছে শক্তসমর্থ অবস্থান এবং আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত তারা।

এমতাবস্থায় আমেরিকান সৈন্য প্রত্যাহারের ফলে আফগানিস্তানে আরো একটা গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে, যা শুরু হবে আফগানিস্তান সরকার এবং তালেবানদের মধ্যে। ইতোমধ্যে আফগানিস্তানের ৪৮০টি শহরের মধ্যে ৭৮টির দখল নিয়েছে তালেবানরা। এমন দখলদারিত্ব যদি অব্যাহত থাকে তাহলে আফগানিস্তানে কথিত গণতন্ত্রের অবসান ঘটবে। তালেবানরা হয়ে উঠবে আফগানিস্তানের একমাত্র শাসক। আমেরিকা এমন একটা সময় সৈন্য প্রত্যাহার শুরু করেছে, যে সময় ইরান  এবং পাকিস্তানের সাথে তাদের টানাপোড়েন চলছে। অথচ এই দুটি দেশ আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী দেশ। এখন যদি আমেরিকা তাদের সৈন্য প্রত্যাহার অব্যাহত রাখে, তাহলে পাকিস্তানের মাধ্যমে চীন হয়তো আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। আমেরিকা সমর্থনপুষ্ট আফগান সরকার যদি আফগানিস্তানে টিকে থাকতে না পারে, তবে এই অঞ্চলে আমেরিকার প্রভাব ক্ষুণ্ন হতে পারে। অন্যদিকে আমেরিকার আফগানিস্তানে সৈন্য রাখা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ দীর্ঘ সময় অবস্থান করার পরেও তারা আশানুরূপ সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। এখন যদি এই অঞ্চলে আমেরিকার প্রভাব ক্ষুণ্ন হয়, তাহলে চীন একক ক্ষমতার অধিকারী হবে,  যা আমেরিকা কখনোই হতে দেবে না।

আবার জাতিসংঘের মাধ্যমে হয়তোবা আমেরিকা আফগানিস্তানের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন হতে পারে। এমনটা হলে আফগানিস্তানের অবস্থান যে ইরাকের মতো হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আফগানিস্তানের  বর্তমান যে অবস্থা তাতে করে এক সময় আফগানিস্তান ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে বাধ্য। আর এই ধ্বংসস্তূপের মূলে রয়েছে আফগান অধিবাসীরা। অর্থাৎ নিজেরাই নিজেদের মধ্যে লড়াই করে ক্ষতি সাধন করছে। তাই সর্বশেষ একটা কথা বলা যায়, জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে আফগানিস্তানে একটা সুষ্ঠু রাজনৈতিক সমাধান সময়ের দাবি।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads