মার্কিন ইতিহাসে দীর্ঘতম যুদ্ধের রেকর্ড সৃষ্টিকারী আফগান যুদ্ধ থেকে যুক্তরাষ্ট্র পরিপূর্ণরূপে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে গত ১৪ এপ্রিল। এ নিয়ে শুরু হয়েছে বিশ্লেষক মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা ও হিসেবনিকেশ। ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকে মার্কিন ইতিহাসে ভিয়েতনামের পর দ্বিতীয় অবস্থান দখলকারী আফগান যুদ্ধে মার্কিন বিনিয়োগ শুরু হয় মূলত ১৯৭৯ সাল থেকেই। ১৯৭৮ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বামপন্থি সোভিয়েত মতাদর্শিক সরকার ক্ষমতায় আসার বিরুদ্ধে রক্ষণশীল গোষ্ঠীগুলো বিদ্রোহ শুরু করে। সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে ১৯৭৮-এর ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান আক্রমণ করে। পরে তারা একটি সমঝোতার মাধ্যমে বাম দলের একজন মধ্যমপন্থি নেতাকে ক্ষমতায় বসিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করতে চাইলেও রক্ষণশীলরা রুশ দখলদারিত্বমূলক উপস্থিতি মেনে না নিয়ে গেরিলা হামলা অব্যাহত রাখে। এর সুযোগে সেই রক্ষণশীল মুজাহিদিনদের পাকিস্তানের মধ্যস্থতায় সার্বিক সহযোগিতা করে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। সোভিয়েত-মুজাহিদিন যুদ্ধ এক দশক চলার পর ১৯৮৯ সালে এই সীমাহীন যুদ্ধ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সৈন্য প্রত্যাহার করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। সৈন্য প্রত্যাহারের পর মুজাহিদিনদের আক্রমণে ১৯৯২ সালে বাম সরকারের পতন হলেও শান্তির মুখ দেখেনি আফগানরা। সরকার পতনের পর মুজিহিদিনদের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ের মাধ্যমে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এর মাঝে মুজাহিদিনদের একটি গ্রুপ মৌলবাদী একটি দল গঠন করে এবং ১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানের সর্ববৃহৎ কাবুল শহর দখল করে নেয়, যাদের বর্তমানে পুরো বিশ্ব তালেবান বলে চেনে। এদেরই ১৯৭৯-৮৯ সময়ে সোভিয়েতের আফগান দখল ঠেকাতে সামরিক সহযোগিতা এবং আর্থিক সহায়তা প্রদানে যুক্তরাষ্ট্র ‘অপারেশন সাইক্লোন’ পরিচালনা করেছিল তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের নেতৃত্বে। পরে এই অপারেশনের ফল বুমেরাং হয়ে যুক্তরাষ্ট্রকেই আঘাত করে ২০০১ সালে, যার পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিনিরা আফগান আগ্রাসন শুরু করে। ‘সন্ত্রাস দমন’ স্লোগান নিয়ে ন্যাটো আফগানিস্তানে ঢুকে রাশিয়া, ইরান ও চীন সীমান্তের কাছাকাছি পাঁচটি বড় সামরিক ঘাঁটি হাজির করে ভূরাজনৈতিকভাবে সাময়িক সফলতা লাভের পর তালেবানদের হারিয়ে আফগানিস্তানের খনিজসম্পদ দখলের স্বপ্নও দেখেছিল সেসময়, যা এখন দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০২১ সালে আফগানিস্তানে অবস্থানরত মার্কিন অনেক সেনার জন্মও হয়নি যখন প্রথম আফগাস্তানে মার্কিন আগ্রাসন শুরু হয়। এজন্য দুই দশকব্যাপী চলা এই যুদ্ধকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রজন্মান্তরের যুদ্ধ’ও বলা হয়। বর্তমানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট সে লক্ষ্য অর্জিত হওয়ার নির্লজ্জ দাবি তুলে ধ্বংসপ্রায় দেশটিতে যুদ্ধাবসানের কথা বলছেন, তা পরোক্ষভাবে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করার ঘোষণা বইকি। অন্তত আফগান ইতিহাস তাই বলছে। আবার সেনা প্রত্যাহারের জন্য কেবল সময় বাড়ালেই আফগানিস্তানে একটি আদর্শ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে এমন আশায় থাকার কোনো অবকাশ নেই বলে প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন। অনিরাপদ ও ভগ্নপ্রায় দেশটিকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে গা বাঁচানোর নীতি অনুসরণ করে যুক্তরাষ্ট্র যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তা নিয়ে খোদ মার্কিন কংগ্রেসেই রয়েছে ব্যাপক মতানৈক্য। নির্মম বিষয় হলো, ২০০১ সালে আগ্রাসনের পক্ষে বুশের পেছনে থেকে, ২০০৮ থেকে ওবামা আমলের দুই মেয়াদে প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধ পরিচালনার পক্ষে মত প্রদানকারী ব্যক্তি বাইডেনই আজ আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইছেন।
সৈন্য প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানের পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে কিছু মার্কিন উদ্যোগের কথা শোনা যায়, যা এখন সম্পূর্ণ অকেজো। প্রথমত আফগানিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন প্রতিনিধি জালমেই খলিলজাদ তালেবান ও বর্তমান আফগানে সরকারের সমন্বয়ে গঠিত ‘ট্রানজিশনাল পিস গভর্নমেন্ট’ নামক একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কথা বলেছেন, যা কোনো পক্ষই মেনে নেয়নি। প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি অনির্বাচিত কোনো ব্যক্তি বা দলকে বিনা ভোটে ক্ষমতা দিতে নারাজ, বরং ছয় মাসের মধ্যে একটি নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। দ্বিতীয়ত সর্বশেষ এই মাসের শেষে তুরস্কের একটি সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রসহ রাশিয়া, চীন, পাকিস্তান, ইরান ও ভারতের উপস্থিতিতে একটি সমাধানে আসার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। দুঃখজনকভাবে তালেবান এতে অংশগ্রহণের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছে সম্প্রতি। তাদের দাবি, সকল মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের আগে কোনো আলোচনা নয়।
এদিকে গত বছর কাতারে অনুষ্ঠিত আফগান-তালেবান ও আফগান-মার্কিন আলোচনাকালীন সময়ে, এমনকি মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের চুক্তির পরেও তালেবান হামলা এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে। সর্বশেষ এই মাসেরই ৫ তারিখ গাড়ি বোমা হামলার মাধ্যমে তিন নিরাপত্তাকর্মী হত্যার পর দায় স্বীকার করে নেয় তালেবান। ফলে এর থেকে বোঝা যায়, মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার হলে তারা সরকারের সাথে আলোচনায় যাওয়ার চেয়ে পেশিশক্তি ব্যবহারকেই প্রাধান্য দেবে। ১৪ এপ্রিল প্রকাশিত জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনেও দেখা যাচ্ছে, গত বছরের প্রথম তিন মাসের তুলনায় এই বছরের প্রথম তিন মাসে বেসামরিক নাগরিক হতাহতের সংখ্যা ২৯ শতাংশ বেড়ে গেছে।
তালেবানের এই একরোখা নীতি ও দাপট দেখানোর পেছনে নিঃসন্দেহে কাজ করছে চীন-রাশিয়ার সমর্থন। উল্লেখ্য, বাইডেনের সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণার একদিন পর চীন এই সিদ্ধান্তে উদ্বেগ জানিয়ে বর্তমান আফগান পরিস্থিতির ভয়াবহতা তুলে ধরেছেন। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে দুটি বিষয় ফুটে ওঠে। প্রথমত তিনি দেখিয়েছেন মার্কিনিরা খালি হাতে এবং ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাচ্ছে; দ্বিতীয়ত এহেন পরিস্থিতিতে শান্তি আনয়ন করা জরুরি তথা বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
আফগানিস্তানে পার্শ্ববর্তী প্রতিটি রাষ্ট্রেরই স্বার্থ আছে। প্রথমত, চীন তার উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোডে (বিআরআই) আফগানিস্তানকে বাইরে রেখে প্রকল্পটি সার্থক করতে পারবে না। অন্যদিকে ইরান-তুরস্ক-পাকিস্তান তাদের ইকোনমিক কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল ও ছয় হাজার কিলোমিটারব্যাপী রেল পথে আফগানিস্তানকে যুক্ত করতে বদ্ধপরিকর। মূলত এই রেলপথটিই চীনা বিআরআই-এর সাথে যুক্ত হবে। ২০১১ সালে বরাদ্দ পাওয়া ১.৮ বিলিয়ন টন আকরিক লোহা সমৃদ্ধ হাজিজাক খনি থেকে লোহা সংগ্রহে ভারতেরও এই রেলপথ প্রয়োজন হবে। ফলে খনিজসম্পদে ভরপুর এই দেশটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রভাবশালী তালেবানকেই সমর্থন দিয়ে মার্কিনবিরোধী শক্তিগুলো সক্রিয় হচ্ছে। আর যদি তালেবান পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে ব্যর্থ হয়, তবে চীন, ভারত ও রাশিয়ার চুক্তিকৃত খনিজসম্পদ উত্তোলন কখনোই সম্ভব হবে না।
উল্লেখ্য, বর্তমানে বিশ্বে বিপ্লব সৃষ্টিকারী ইলেকট্রিক গাড়ি ও খুদে কম্পিউটারের ব্যাটারি তৈরিতে ব্যবহূত লিথিয়ামের বিশাল মজুত রয়েছে আফগানিস্তানে। এই লিথিয়ামের কারণেই ২০১০ সালে বিবিসির এক প্রতিবেদনে আফগানিস্তানকে ‘ভবিষ্যতের সৌদি আরব’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়। ২০০৬ সালে পরিচালিত মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস)-এর প্রাক্কলনে দেখা যায়, উত্তর আফগানিস্তানে গড়ে ২৯০ কোটি ব্যারেল অপরিশোধিত খনিজ তেল, ১৫.৭ ট্রিলিয়ন ঘনফুট প্রাকৃতিক গ্যাস এবং ৫৬ কোটি ব্যারেল প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে প্রাপ্ত তরল আছে।
সৈন্য প্রত্যাহার পরবর্তীসময়ে আফগানিস্তান পুনর্গঠনের একমাত্র মাধ্যম হলো এইসব খনিজসম্পদ। তবে এখনের মতো পরিস্থিতি বজায় থাকলে চুক্তি করা কোনো দেশই এসব সম্পদ আহরণ করতে পারবে না। এরা নিজেদের স্বার্থে তালেবানকে ক্ষমতায় বসালেও বর্তমান সরকারপন্থি মডারেট আফগান ও তালেবানবিরোধী হাক্কানী নেটওয়ার্ক, আল-কায়েদা, আইএস-খোরাসানসহ সব বিদ্রোহী গোষ্ঠী ক্ষমতায় নিজ হিস্যা বুঝে নিতে লড়াই শুরু করবে, যা তালেবানের নিয়ন্ত্রণে নাও থাকতে পারে।
এ ছাড়া অশিক্ষিত একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে বন্দুক সংস্কৃতি থেকে কাগজ-কলমের সংস্কৃতিতে টেনে আনার জন্য যে শিক্ষাগত ও মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রয়োজন পড়বে, তার সমাধান নিয়ে খোদ তালবানই দ্বিধাগ্রস্ত। কারণ তালেবানে এখন দুই ধারার চিন্তা গড়ে উঠেছে, একটি নারী শিক্ষা সমর্থনকারী, অপরটি কট্টরপন্থি রক্ষণশীল। ক্ষমতায় গেলে এই দ্বন্দ্বও বড় হয়ে ওঠার ভয় করেন অনেক তালেবান নেতা।
এমন পরিস্থিতিতে আসন্ন তুরস্ক সম্মেলনে তালেবান ও আফগান সরকারকে বসতে সকল শক্তিকেই চাপ প্রদান করতে হবে। এককভাবে তালেবান কিংবা ঘানি সরকারকে সমর্থন দিয়ে কোনো দেশই সুবিধা করতে পারবে না এই সংঘাতময় দেশে। মার্কিনিদের ইরাক নীতি আফগানিস্তানে ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল এটি। ইরাকে সাদ্দামের বাথপার্টি এবং সাদ্দাম বিরোধীদের আলাদাভাবে মার্জিন করে মার্কিনিরা যে দমন নীতি পরিচালনা করেছিল, তা আফগানিস্তানে মুখ থুবড়ে পড়েছে। তাই সেনা প্রত্যাহারের পূর্বেই সমঝোতার মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ বিনিয়োগ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে, যা দেশটিকে খাদের কিনার থেকে রক্ষা করবে। এ ব্যতিরেকে ‘এক রশি দুপক্ষ দুদিক থেকে টানাটানি করলে রশিটি মাঝখানে ছিঁড়ে যাবে’, যা পুনরায় হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষের মৃত্যুর কারণ হবে। আর গৃহযুদ্ধ পুনরায় শুরু হলে এর রক্তের ছিটেফোঁটা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও যাবে বইকি।
আরমান শেখ
লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়