• রবিবার, ১৬ মার্চ ২০২৫ | ১৬ চৈত্র ১৪৩১ | ১৬ শাওয়াল ১৪৪৬
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে

সংগৃহীত ছবি

মুক্তমত

রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে

  • প্রকাশিত ৩১ মে, ২০২১

আর কে চৌধুরী

মিয়ানমারে বসবাসকারী ১৩৫ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টিকারী ১৯৮২ সালের নাগরিক আইন দিয়ে সে দেশটি যেমন সচেতনভাবে রোহিঙ্গাদের তাড়াতে সচেষ্ট ছিল, এযাবৎ যত দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে মিয়ানমারের সঙ্গে, তার কোনোটিতে বাংলাদেশ প্রতিপক্ষের সুমতি অর্জনে সফল হয়নি। ১৯৯১-৯২ পরবর্তীকালে রোহিঙ্গাদের পুশব্যাক করে কোনোমতে ঝামেলা এড়াতে চেয়েছিল বাংলাদেশ। রয়ে যাওয়া ৩৩ হাজার ৫৪২ রোহিঙ্গাকে ‘শরণার্থী’ মর্যাদায় এ দেশে বাস করতে দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে প্রত্যাবাসিত রোহিঙ্গারা যখন মিয়ানমারে নির্যাতন সইতে না পেরে ফিরে এলো, তখন সংকট ঘোরতর হয়ে ওঠে। রিসেটেলমেন্টের উদ্যোগও একপর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায়।

২০১৬-১৭ সালে আরো কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসে। সম্প্রতি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট অনিশ্চয়তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। গণভবনে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতি ভলকান বাজকার সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এলে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন। জাতিগত নিধনের শিকার জোর করে বিতাড়িত হয়ে মিয়ানমারের ১ মিলিয়নের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমার সেনাপ্রধান বলেছেন, রোহিঙ্গারা সে দেশের নাগরিক নয়। বাংলাদেশ সরকার ১৮ হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে অস্থায়ী আবাসনের জন্য ভাসানচরে স্থান দিয়েছে। রোহিঙ্গা সংকট ছাড়াও জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের আসন্ন অধিবেশন, জলবায়ু পরিবর্তন, কোভিড-১৯ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। করোনাভাইরাস থেকে মানুষের প্রাণ বাঁচাতে এবং এর প্রভাব মোকাবিলা করে অর্থনীতি সচল রাখতে প্রণোদনা প্যাকেজ ও সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য অন্যান্য অর্থ সুবিধা দিয়েছে সরকার। রোহিঙ্গা সংকটের গ্রন্থিমোচনে তাদের প্রত্যাবর্তনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করা হোক।

মিয়ানমার থেকে জোর করে বাস্তুচ্যুত ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রায় চার বছর ধরে বাংলাদেশে অবস্থান করছে। তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি হলেও এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গারও প্রত্যাবর্তন হয়নি। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন উপযোগী পরিবেশ তৈরিতে বাস্তবে কিছুই করছে না মিয়ানমার; এমনকি জাতিসংঘকে দেওয়া প্রতিশ্রুতিও মানছে না দেশটি। এর মধ্যে মিয়ানমারে ঘটে গেছে সামরিক অভ্যুত্থান। জান্তাপ্রধান রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে সব সম্ভাবনাই উড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে চরম অনিশ্চয়তা। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী প্রত্যাবর্তন প্রসঙ্গে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এ সময় ভোলকান বোজকির এক মিলিয়নের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ যে সাহসী ভূমিকা পালন করেছে, তার প্রশংসা করেন।

প্রাকৃতিক পরিবেশের দিক থেকে সবচেয়ে সমৃদ্ধ একটি অঞ্চল ছিল কক্সবাজার। বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে দীর্ঘ সময় ধরে আশ্রয় দেওয়ায় সেই পরিবেশ আজ ধ্বংসপ্রায়। স্থানীয় জনজীবনেও নেমে এসেছে চরম দুর্দশা। এই অবস্থায় সরকার ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গাকে স্থানান্তরের উদ্যোগ নেয়, যদিও এখন পর্যন্ত মাত্র ১৮ হাজার রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় সেখানে স্থানান্তরিত হয়েছে। ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য যেসব আয়োজন করা হয়েছে এবং সেখানে ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বোজকির তারও প্রশংসা করেন। ভোলকান বোজকির বলেন, সংকটের সময়ে উদ্বাস্তুদের কিভাবে সহযোগিতা করতে হয়, ভাসানচর তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এক প্রশ্নের জবাবে বোজকির স্বীকার করেন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে মিয়ানমার প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্তি রয়েছে। একটি গ্রুপ হচ্ছে আসিয়ান গ্রুপ এবং আরেকটি কোর গ্রুপ। তিনি বলেন, কোর গ্রুপের বিপরীতে আসিয়ান গ্রুপ মনে করে, মিয়ানমার সরকারকে স্বীকৃতি না দেওয়া এবং এখনই চাপ প্রয়োগ করা ঠিক হবে না। এই অবস্থায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন আরো অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশকে অনেক বেশি সক্রিয় হতে হবে। আসিয়ান জোটের দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে।

সাম্প্রতিক সময়ে আসা ১১ লাখ রোহিঙ্গা শুধু নয়, কয়েক দশক ধরে আসা আরো অনেক রোহিঙ্গাই বাংলাদেশে অবস্থান করছে। তারা এখন বাংলাদেশের সমাজে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তাই রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে বাংলাদেশকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে এগোতে হবে। দ্রুত প্রত্যাবর্তনের চেষ্টা করতে হবে। তার আগে পর্যন্ত তাদের কোথায় রাখা হবে, কীভাবে দেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়া রোধ করা যাবে, সেসব ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে কক্সবাজারের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনমান রক্ষায় পর্যাপ্ত উদ্যোগ নিতে হবে।

প্রতিবেশী দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপে বিরত থাকা এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং কারো সঙ্গে বৈরিতা না করার যে পররাষ্ট্রনীতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিষ্ঠা করে গেছেন; আমরা তাতে পূর্ণমাত্রায় বিশ্বাসী। আমরা আশা করি, মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং সাংবিধানিক ব্যবস্থা সমুন্নত থাকবে। নিকটতম ও বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী হিসেবে মিয়ানমারে শান্তি ও স্থিতিশীলতাই আমাদের কাম্য। রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়; অতীতে আসা রোহিঙ্গাদের বড় অংশ এখনো মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারেনি। কাজেই চুক্তি অনুযায়ী রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের উদ্যোগ সুসম্পন্ন করার লক্ষ্যে আমাদের পক্ষ থেকে দ্বিপক্ষয়ি কূটনীতির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে হবে।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads