মুক্তমত

আত্মহত্যা : একটি সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

  • প্রকাশিত ১৯ জুন, ২০২১

মুতাসিম বিল্লাহ মাসুম

 

আত্মহত্যা কথাটির সাথে আমরা খুব বেশি পরিচিত। সাধারণত আত্মহত্যার পরিচয় দিতে গিয়ে আমরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন কথা বলে থাকি। সবার ধারণা এমনই যে, ব্যক্তি যখন তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা নিয়ে হতাশায় থাকে তখনই এমন কাজে লিপ্ত হয়। আবার অনেকের ধারণা ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা, পারিবারিক কলহ কিংবা আর্থিক সংকটও আত্মহত্যার পেছনে দায়ী। তবে যেহেতু আত্মহত্যা সমাজের একটি অংশ, তাই অবশ্যই এর একটি সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ আছে। সমাজবিজ্ঞানীদের অনেকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আত্মহত্যা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তবে এ সংক্রান্ত ব্যাখ্যায় সবচেয়ে যৌক্তিক এবং বাস্তবসম্মত আলোচনা করেছেন এমিল ডুর্খিম। এমিল ডুর্খিম আত্মহত্যা সম্পর্কে তার Sucide গ্রন্থে বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। তিনি সমাজে ঘটে যাওয়া আত্মহত্যাকে চার ভাগে বিভক্ত করেছেন। সেগুলো হচ্ছে— আত্মকেন্দ্রিক, পরার্থপর, নৈরাজ্যমূলক এবং অদৃষ্টবাদী।

প্রথমত, আত্মকেন্দ্রিক আত্মহত্যার কারণ হলো সমাজ থেকে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতা। যখন একজন ব্যক্তি নিজেকে সমাজ থেকে আলাদা মনে করতে থাকে এবং ধারণাটা এমন যে সমাজ তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও আছে সামাজিক বন্ধনের শৈথিল্য। যখন কোনো সমাজের ব্যক্তিজীবনের বন্ধনগুলোর মাঝে শিথিলতা দেখা দেয়। এক্ষেত্রে আমরা ডুর্খিমের সামাজিক সংহতির (Social Solidarity) কথা বলতে পারি। যখন একটি সমাজ যান্ত্রিক (Mechanical) থেকে জৈবিক (Organic) সমাজে রূপান্তরিত হয়, তখন দেখা যায় সামাজিক বন্ধনগুলোর স্থানে ব্যক্তিচিন্তা (Individualism) প্রকট হয়ে দেখা দেয়। অন্য একটি কারণ হলো যৌথ সাহায্য-সহযোগিতার অনুপস্থিতি। সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় Absence of Wee-feeling অর্থাৎ যখন সমাজের মানুষের মধ্যে একতা কাজ করে না, যে যার স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সর্বশেষে তিনি বলেছেন একাকিত্ববোধ। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় আত্মকেন্দ্রিক আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। কারণ পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় সবার লক্ষ্য অর্থ সংগ্রহ করা। যার ফলে পরিবার ও নিকটাত্মীয়দের সময় দেওয়া অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না। আবার দেখা যায়, অনেক পরিবারের বাবা-মা দুজনেই চাকরি করেন। ফলে সন্তানদের খোঁজ-খবর রাখা কিংবা তাদের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য অনেক বাবা-মার পক্ষে সম্ভব হয় না। এমন একাকিত্ব থেকে হতাশা, বিষাদ আর পরিণাম হয় আত্মহত্যার।

দ্বিতীয়ত, পরার্থপর আত্মহত্যা এমন এক পরিস্থিতিতে ঘটে যখন ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে সমাজের স্বার্থ বড় হয়ে দেখা দেয়। যখন ব্যক্তি নিজেকে চিন্তা করার পরিবর্তে সমগ্র দেশে বা জাতির জন্য চিন্তা করে। উদাহরণস্বরূপ আমরা বলতে পারি দেশপ্রেমের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে আত্মহত্যা। নৈতিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে অপমানে আত্মহত্যা। স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীর স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ ইত্যাদি। এ ধরনের আত্মহত্যা আমরা প্রাচীন সমাজে বেশি লক্ষ করি।

তৃতীয়ত, সমাজে যখন উত্থান-পতন প্রবল হয়ে ওঠে এবং অর্থনৈতিক সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করে তখন এ ধরনের আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। যখন কোনো ব্যক্তি সমাজের পরিবর্তনের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে না, তখন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং ব্যক্তি নিজেকে অসহায় মনে করে। ব্যক্তি মনে করে সমাজের সাথে তার কোনো সংযোগ রইল না। এমন পরিস্থিতিতে সামাজিক অবস্থার ব্যাপক বিপর্যয় ঘটে এবং আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। বর্তমান আধুনিক সমাজে এ ধরনের আত্মহত্যার ঘটনা অহরহ। কারণ যুগের সাথে সবাই তাল মিলিয়ে চলতে চাই। কিন্তু সবার পক্ষে সময়োপযোগী সবকিছু নিয়ে চলা কঠিন। কারণ বিশ্বের সব দেশে জনসংখ্যার তুলনায় কর্মসংস্থান অপ্রতুল। তাই অনেকে চাইলেও যুগের সাথে সমান গতিতে চলতে পারেন না, যার প্রেক্ষিতে আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটে।

চতুর্থত, অদৃষ্টবাদী আত্মহত্যা ঘটে যখন ব্যক্তির ওপর গোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান প্রভাব বৃদ্ধি পায়, মাত্রাতিরিক্ত কঠোর সামাজিক নিয়ন্ত্রণ, যা ব্যক্তির কাছে দুর্বিষহ হয়ে যায়। এ ধরনের আত্মহত্যা ঘটে যখন ব্যক্তি তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চরম অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হয় এবং চিন্তা করতে থাকে তার ভবিষ্যৎ দ্বার রুদ্ধ। বর্তমানে অনেক পরিবারে সন্তানদের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণের কারণে এ ধরনের আত্মহত্যা ঘটছে।

সামগ্রিক আলোচনার পর একথা অবশ্যই বলা যায়, শুধু ব্যক্তিগত কারণে একজন ব্যক্তি আত্মহত্যা করে না। তার ওপর পারিপার্শ্বিক এবং সামাজিক প্রভাবও থাকতে পারে।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads