১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল পরাক্রমের সামনে পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি হানাদার ও ঘাতক বাহিনী এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে মেতেছিল। বাঙালিকে মেধা ও মননশূন্য করতে তারা বেছে বেছে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, চিকিৎসক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, প্রকৌশলী, আইনজীবী ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের অগ্রগণ্য সহস্রাধিক বরেণ্যজনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। অথচ এর দুই দিন পর ১৬ ডিসেম্বর বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বিজয়ের আগে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের এভাবে হত্যা করার দিনটি বাঙালির ইতিহাসে বেদনাবিধুর। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারানোর দুঃসহ যন্ত্রণার একদিন। দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রমের ইতিহাসের কলঙ্কিত দিন। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তগঙ্গা পেরিয়ে বাঙালি কাঙ্ক্ষিত বিজয়ের প্রতীক্ষায়, পূর্বদিগন্তে টগবগিয়ে যখন বিজয়ের লাল সূর্য উদিত হচ্ছে, ঠিক তখনই চালায় ইতিহাসের নৃশংস ও নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞ। সেদিন বধ্যভূমিতে বড় অসহায় দশায় নিঃশেষে প্রাণ দেন দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীরা, যা বিশ্বকেও হতবিহ্বল করে তুলেছিল। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রয়েছেন- অধ্যাপক মুনির চৌধুরী, ডা. আলিম চৌধুরী, অধ্যাপক মুনিরুজ্জামান, ড. ফজলে রাব্বী, সিরাজ উদ্দিন হোসেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, অধ্যাপক জিসি দেব, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক রশীদুল হাসান, ড. আবুল খায়ের, ড. মুর্তজা, সাংবাদিক খন্দকার আবু তাহের, নিজামউদ্দিন আহমেদ, এসএ মান্নান (লাডু ভাই), এ এন এম গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ নাজমুল হক, সেলিনা পারভিনসহ আরো অনেকে।
একাত্তরের সেই যুদ্ধাপরাধী ও বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকের বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে। এর মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত অনেকের বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় ঘোষিত হয়েছে। মানবতাবিরোধী হত্যা মামলায় দণ্ডিত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়েছে। জামায়াতের অপর নেতা মোঃ কামারুজ্জামান এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যতম হোতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। ২০১৬ সালের ১১ মে মুক্তিযুদ্ধকালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নীলনকশা বাস্তবায়নকারী গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর প্রধান ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়। তবে বুদ্ধিজীবী হত্যায় সরাসরি জড়িত চৌধুরী মইনুউদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান পলাতক থাকায় তাদের বিচার এখনো কার্যকর করা সম্ভব হয়নি । চৌধুরী মইনুদ্দীন যুক্তরাজ্য এবং আশরাফুজ্জামান খান যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক রয়েছেন। তাদের ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। বছর ঘুরে আজ আবার এসেছে দিনটি। প্রতিবছর জাতি গভীর শ্রদ্ধায় এদিন স্মরণ করে সেসব শহীদদের। দিবসটি উপলক্ষে জাতীয়ভাবে বিস্তারিত কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আলাদা বাণী দেবেন। কিন্তু এবার করোনাভাইরাসের মহামারীর কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বুদ্ধিজীবী দিবসের কর্মসূচি পালিত হবে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে জাতীয় ও কালো পতাকা অর্ধনমিতকরণ, মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ও রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ।
আওয়ামী লীগের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে, বঙ্গবন্ধু ভবন ও দেশব্যাপী সংগঠনের কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন এবং জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ। সকাল ৯টায় মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন।
সকাল সাড়ে ৯ টায় বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে এবং সকাল ১০ টায় রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ।
এদিকে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ মন্ত্রণালয়ের অধীন সব দপ্তর ও অফিসকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালনের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকের সিদ্ধান্তের আলোকে দিবস পালনের নির্দেশনা দেয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
গত ৬ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নির্দেশনায় বলা হয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকের সিদ্ধান্তের আলোকে ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় রেখে পালন করতে হবে।
১৪ ডিসেম্বর শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আলোচনা সভা করতে বলা হয়েছে। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করতে হবে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মেনে। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের অনুষ্ঠান করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।