ফিচার

আজি এ শরৎবেলা

  • খালেদ উদ-দীন
  • প্রকাশিত ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

বাংলাদেশের শরৎ স্নিগ্ধ আমেজের এবং সৌন্দর্য বিধায়ক। বর্ষার প্রকৃতিতে যে একঘেয়েমি আবির্ভূত হয়, শরতের উজ্জ্বলতায় প্রকৃতি যেন নতুনরূপে আবির্ভূত হয়। মানুষের মনকে শরতের এই অরুণ অঞ্জলি বিশেষভাবে নাড়া দেয়। মেঘ, মেঘের পরে একটু বৃষ্টি, পরে এক ঝলক হাওয়া, এরপরে সোনালি রোদ্দুর এ-ই শরতের বৈশিষ্ট্য।

ভাদ্রের প্রচণ্ড গরমে যেমন শরতের এক মাস, তেমনি আশ্বিনে যেন প্রকৃত সৌন্দর্য ধরা পড়ে। শিউলিফুল, শাপলা ফুটে খাল-বিল ভরে ওঠে। এমনও দিনে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে হারিয়ে যেতে মন চায়। সুন্দরবন কিংবা হালের আবিষ্কার রাতারগুল তখন যেমন অপরূপ তেমনি কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতেও এক ভিন্ন সৌন্দর্যের লীলা দেখা যায়।

ষড়ঋতুর রঙ্গমঞ্চ আমাদের এই দেশ। প্রতিটি ঋতুই এ দেশের প্রকৃতিকে আপন সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্যে দান করে অপরূপ এক রূপ। ফলে প্রকৃতি কখনো হয় প্রাণোচ্ছল চঞ্চলা তরুণী, কখনো হয় দীপ্ত চক্ষু শীর্ণ সন্ন্যাসিনী, কখনো বর্ষশীলা ক্রন্দনরতা অভিমানিনী, কখনো নিষ্প্রভ জরাগ্রস্ত বৃদ্ধা আবার কখনো-বা শান্তশিষ্ট স্নেহময়ী জননী।

 

২.

শরৎ হলো আকাশ ও মাটির মিলন। একদিকে নীলাকাশ, আরেকদিকে কচি ফসলের দুরন্তপনা; একদিকে সোনা রোদ, আরেকদিকে সবুজের কচি মুখ; সঙ্গে আকাশ ও মৃত্তিকার যে হূদয়াবেগ, তা আমাদের হূদয়কে নাড়া দিয়ে যায়। ভাদ্র মনকে উদ্বেলিত করে তোলে। প্রকৃতির সবুজ ছড়িয়ে পড়ে মাঠে-ঘাটে। শরতের উজ্জ্বলতায় প্রকৃতি নতুন রূপে আবির্ভূত হয়।

বাংলায় শরৎঋতুকে বলা হয়েছে ঋতুরানি। হ্যাঁ, রাজার বুদ্ধি-মেধা যেখানে এসে ছেদ পড়ে সেখানে যে তিনি রানির সহযোগিতা কামনা করেন দেশ চালনায়। তেমনি ঋতুরাজ বসন্তের অভাব পূরণে সৌন্দর্য বিলাতে আসে ঋতুরানি শরৎ। আকাশে সাদা মেঘের পালক উড়ে বেড়ায় শিমুল তুলার মতো। কবিমন আনন্দে নেচে ওঠে সৃষ্টিসুখের উল্লাসে। প্রবল আবেগ আর উৎসাহ এসে জমা হয় কবি-সাহিত্যিকের মনোজগতে। সৃষ্টি করে চলে তারা অমিয় সুধা। বিলিয়ে দেন সৃষ্টি-জগতের প্রতিটি প্রাণীর জন্য। মহাকবি কালিদাস শরৎ-বন্দনায় বলেন, ‘প্রিয়তম আমার, ঐ চেয়ে দেখ,/ নববধূর ন্যায় সুসজ্জিত শরৎকাল সমাগত।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শরৎকে ঘিরে প্রচুর কবিতা-গান লিখে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ ও সুবাসিত করে গেছেন। ‘আজি নীল আকাশে কে ভাসাল সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই লুকোচুরির খেলা’, ‘ওগো শেফালি বনের মনের কামনা,’ ‘সকল বন আকুল করে শুভ্র শেফালিকা,’ ‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ/আমরা বেঁধেছি শেফালি মালা,’ ‘শিউলি সুরভিত রাতে বিকশিত জ্যোৎস্নাতে,’ ‘শরৎপ্রাতের প্রথম শিশির প্রথম শিউলি ফুলে,’ ‘হূদয় কুঞ্জবনে মঞ্জুরিল মধুর শেফালিকা’... এমনই কত সুর কত কথা কাব্যে সাহিত্যে চিরন্তন করে রেখে গেছেন কবিগুরু শরতের ভাগ্যে।

নির্মল নীলাকাশ, গুচ্ছ গুচ্ছ শুভ্র অমল ধবল মেঘের ভেলা; দূরে দুধেল সাদা কাশের বনে পাগলা হাওয়ার মাতামাতি— এই হচ্ছে শরৎ। মিষ্টি ঘ্রাণের শিউলি চুপি চুপি বলে দেয়- আজি-এ শরৎবেলা, ‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা/নীলাকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই লুকোচুরি খেলা।’ পঙক্তিতে রবীন্দ্রনাথ শরৎকে স্বল্পায়ু বলেছেন। শরৎকে চেনা যায় প্রকৃতির মাঝে তার স্বল্প আয়োজনের জন্য। শরতের সম্ভার ওই শিশিরাশ্রু শেফালিকা, কাশমেঘ; আর আগমনী উৎসবে তার সমাপ্তি।

প্রকৃতি তার ভালোবাসা দিয়ে আপন করে নিতে চায় সকল মনকে। শরৎ সেই ভালোবাসার মনে দোলা দিয়ে যায়।

‘ঘনকালো মেঘের আঁধার একটু হাসে একটু কাঁদে/রোদের সাথে লুকোচুরি খেলাটা বেশ জমিয়ে তোলে/এই যে এখন মনটা ভালো এই যে এখন মনটা খারাপ/ইচ্ছে হলেই গালফুলিয়ে কান্না শুরু/ইচ্ছে হলেই রোদের পরে রোদের খেলা,/কখন কী হয় সবাই ভীতু এমনই যে শরৎ ঋতু’ (আলাউদ্দিন আল আজাদ)।

নদীর তীরে তীরে কাশফুলের সাদা হাসির প্লাবন, মাঠে মাঠে সবুজের মেলা; এক কথায় এত সবুজ, এত নীল আর এত সাদার একত্র সমাবেশ অন্য কোনো ঋতুতে দেখা যায় না বললেই চলে। রূপসী বাংলার রূপ বিচিত্র ঋতুচক্রে নানা বর্ণে-গন্ধে গানের সমারোহে নিত্য আবর্তিত হয়ে চলে। কিন্তু অর্থদাস শহরবাসীর অন্তর আজ আর শরতের সেই নিমন্ত্রণ অনুভব করে না। প্রতিবারই শরৎ সাজে অপরূপ সাজে। কিন্তু শহরের যান্ত্রিক জীবনে এর রূপ দেখার সময় নেই অনেকেরই। এরপরও পাড়াগাঁয়ে পড়া কিছু শহুরে মন নেচে-গেয়ে ছুটে ফেরে কেবল শরতের ওই কাশবনে...। শরতের অনুপম রূপবৈভবের মাঝে বেজে ওঠে বাঙালির প্রাণের বাঁশি। আকাশে-বাতাসে অনুরণিত হয় উদার মুক্তির আহ্বান।

 

৩.

তাই তো সমুদ্র থেকে একরাশ নীলচে তরল তুলে... নীল আকাশের বিশাল ক্যানভাসে সাদাটে মেঘের পৃষ্ঠায় চিঠি লেখা হয়। আর অচেনা নগরের পোস্টম্যান বাতাসে ভর করে। নীলচে স্বপ্নেরা জড়ো হয় আমাদের আঙিনায়, ব্যস্ত উঠোনে, খোলা জানালায়।

মালঞ্চে পুষ্পিত লতা অবনতমুখী

নিদাঘের রৌদ্রতাপে একা সে ডাহুকী

বিজন তরুর শাখে ডাকে ধীরে ধীরে

বনচ্ছায়া অন্তরালে তরল তিমিরে!

নিস্তব্ধ পল্লির পথে কুহকের সুর

বাজিয়া উঠিছে আজ ক্ষণে ক্ষণে ক্ষণে!

-জীবনানন্দ দাশ

চরজুড়ে কাশবন। নদীতে ছলছল তরঙ্গ। ছপাৎ ছপাৎ বৈঠা মেরে মাঝি গান গেয়ে যায় দূর গন্তব্যে। কৃষানি ঘাটের কাছে দাঁড়ায় বৈদেশি নাগরের আশায়। জলে ঢেউ, মনে বাতাস। অবসর আসে অফুরান কাজের পরে। হোগলা পাতার কোলে হেলান দিয়ে বধূ ফুল তোলে রুমালে, পাখায়, বিছানার কুশনে। আর রাতের উজ্জ্বল আকাশতলে কল্পআবেশে চলে তার কত না কথন...

শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রতিরূপ হয়ে শরৎকাল বাংলার ঘরে ঘরে আবির্ভূত হয়। এ ঋতুতে বাঙালি হূদয় প্রকৃতির সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়। গাছে গাছে সবুজের সমারোহে মন উদাস হয়ে ওঠে। প্রকৃতির এই শান্ত রূপটি যেন সৌন্দর্যের আকর।

শরৎকালের মধ্যেই যেন বাংলাদেশের হূদয়ের স্পর্শ পাওয়া যায়। তাই শরৎ যখন চলে যায়, তখন আমাদের হূদয় শূন্য করে দিয়ে যায়। তার বিদায়ী পথে পড়ে থাকে অশ্রুসিক্ত শিউলি ফুলের মালা এবং বিগত আনন্দের বর্ণ-বিলসিত অজস্র স্মৃতি। সাদা সাদা মেঘগুলো যেন নীলাকাশে ভেজা তুলোর ন্যায় ইতস্তত ঘুরে বেড়ায়।  ৎ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads