আগেভাগে সক্রিয় সিন্ডিকেট

প্রতীকী ছবি

পণ্যবাজার

আগেভাগে সক্রিয় সিন্ডিকেট

  • নাজমুল হুসাইন
  • প্রকাশিত ১ মার্চ, ২০২০

রোজার সময় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলো বেশির ভাগই আমদানিনির্ভর। এতে স্বাভাবিকভাবেই রোজার কেনাবেচা যখন শুরু হবে, তখন আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব অভ্যন্তরীণ বাজারেও থাকবে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক দরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশের বাজারে পণ্যের দাম নির্ধারণ হবে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই সেটা হচ্ছে না। বরং আগেভাগেই কারসাজি করে বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে পণ্যের দাম।

এ বছরও সেটাই হচ্ছে। রোজায় বাড়তি চাহিদাকে পুঁজি করে আগেভাগেই দাম বাড়ানোর হচ্ছে নিত্যপণ্যের। দেড় মাসেরও বেশি সময় বাকি থাকলেও ইতোমধ্যে বাজারে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে চিনি, তেল, ডাল, মসলাসহ বেশ কিছু পণ্য। বাজারে প্রতি কেজি চিনির দাম ইতোমধ্যে ৭০ টাকা ছুঁইছুঁই করছে, যা সারা বছর ৫৫ থেকে ৬০ টাকা ছিল। এছাড়া ডাল ও ছোলার দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ন্যূনতম ১০ টাকা। আর মসলার দাম যেন আকাশছোঁয়া।

তার পরও প্রতিবছরের ন্যায় একই ধরনের তদারকি কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে সরকার। ব্যবসায়ীদের ডেকে ডেকে বৈঠক হচ্ছে; আর ব্যবসায়ীরা প্রতি বছরের ন্যায় বলে যাচ্ছেন- ‘নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুত ও সরবরাহ পরিস্থিতি চাহিদার তুলনায় বেশি আছে। আগামী রমজানে তাই দাম বাড়ানো হবে না’। আর প্রতি বছরের ন্যায় ব্যবায়ীদের এমন আশ্বাসে বিশ্বাস রাখছে বাণিজ্যমন্ত্রীসহ মন্ত্রণালয় ও সকল সংশ্লিষ্ট সংস্থা।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশে এখনো কোনো পণ্যের আমদানিতেই ঘাটতি নেই। বরং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমদানি বেশি হয়েছে। তারপরও কেন বাড়ছে দাম তার কোনো সদুত্তর নেই সরকার সংশ্লিষ্টদের কাছে। তবে ক্রেতারা বলছেন, রোজা আসার অনেক আগেই বাজারে তার আঁচ পড়তে শুরু করেছে। গতবারের মতো এবারো রোজার আগেই বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়ানো হচ্ছে।

এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, রোজায় নিত্যপণ্যের বাজার যাতে অস্থির হতে না পারে সেজন্য কৌশল নির্ধারণ করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ জন্য বাজার মনিটরিংসহ চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় করে পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে পূর্বগঠিত বাজার মনিটরিং কমিটিগুলোকে পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত কর্মকর্তারা যারা বদলি হয়ে গেছেন তাদের বাদ দিয়ে নতুন কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে মনিটরিং কমিটিগুলোয় অন্তর্ভুক্ত করতে অন্য মন্ত্রণালয় ও সংস্থার কাছেও কর্মকর্তাদের নামের তালিকা চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

আসন্ন রোজায় ১৯টি মনিটরিং টিম বাজারে থাকবে। এর সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের নেতৃত্বেও বাজার মনিটরিং চলবে। এ ছাড়া এ অধিদপ্তর ইতোমধ্যে বিভিন্ন আমদানিকারক উৎপাদক ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। একই সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে অপর সংস্থা-বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের উদ্যোগেও মনিটরিং চলবে।

তবে প্রতি বছরের এসব কার্যক্রমে সন্তুষ্ট নয় বাজার বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ব্যবসায়ীরা অতি প্রয়োজনীয় পণ্য টার্গেট করে দামে কারসাজি করেন। তারা এর জন্য প্রতি বছর রোজার আগের সময় বেছে নেয়। আগেভাগে দাম বাড়িয়ে রোজায় সময় বাজার স্থিতিশীল রেখে কৌশলে মুনাফা হাতিয়ে নেয়। আর সরকারের মনিটরিং শুধু রোজায় দাম বাড়ল কি না সেটা নিয়ে মাথা ঘামায়।

এ প্রসঙ্গে ভোক্তা সংগঠন কনজ্যুমার আসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, এসব অপকর্মের যেহেতু শাস্তি হয় না, তাই তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সরকার বাজারে গিয়ে শুধু খুচরা ব্যবসায়ীদের শাস্তি দিতে পারে। কিন্তু দাম বাড়ায় উৎপাদক ও আমদানিকারক। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো নজির নেই।

খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরাও এ সময় সুযোগসন্ধানী হয়ে ওঠে এমনটি মনে করেন সাবেক এ বাণিজ্য সচিব। তিনি বলেন, তারা সব সময় ওত পেতে থাকে, সুযোগ পেলেই বাজার অস্থির করে তোলে। আগামী রমজানকে কেন্দ্র করে সবাই মিলেই ভোক্তাদেরকে জিম্মি করতে শুরু করেছে।

এদিকে গত মাসের শুরুর দিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে দেওয়া এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে তথ্য দেওয়া হয়েছিল, তেল চিনির মতো পণ্যের গুদামজাত পরিস্থিতি ও বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা পরিকল্পিত ও সমন্বিতভাবে তদারকি না করলে রিফাইনারি ও মিল মালিকরা সিন্ডিকেট তৈরি করে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সংকট সৃষ্টি এবং অনৈতিক মুনাফা লাভের চেষ্টা করবে।

অন্যদিকে সিন্ডিকেট ভাঙতে ও নিত্যপণ্যের দাম ভোক্তা সহনীয় রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। মন্ত্রণালয় বলছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর খোলা বাজারে ভর্তুকি মূল্যে সর্বোচ্চ ২০ গুণ বেশি রমজাননির্ভর এ ছয় পণ্য বিক্রি করবে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। যা বাজার নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা রাখবে।

কর্মপরিকল্পনায় বলা হচ্ছে, গত বছর টিসিবি দুই থেকে আড়াই হাজার টন সয়াবিন তেল বিক্রি করলেও এবার ৫০ হাজার টন তেল বিক্রির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে এবার ২০ গুণ বেশি সয়াবিন তেল বিক্রি করা হবে। একইভাবে এ বছর ১৫ গুণ বাড়িয়ে ৩০ হাজার টন চিনি ৫ গুণ বেশি ৮ হাজার টন ছোল, তিন গুণ বাড়িয়ে ৩ হাজার টন মসুর ডাল ও ৫০০ টন খেজুর টিসিবির মাধ্যমে বিক্রি করা হবে। পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় এ পণ্যটির দাম রমজানে যাতে সহনীয় থাকে এজন্য বাড়তি প্রস্তুতি হিসেবে টিসিবির মাধ্যমে ৩০ হাজার টন পেঁয়াজ বিক্রির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

সামগ্রিক বিষয়ে জানতে বাণিজ্যসচিব জাফর আহমেদকে ফোন দেওয়া হলে তিনি পারিবারিক অনুষ্ঠান আয়োজনের ব্যস্ততায় কথা বলতে পারেননি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads