আগুন লাগার আসল কারণ জানা যায়নি

ছবি : সংগৃহীত

দুর্ঘটনা

চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডি

আগুন লাগার আসল কারণ জানা যায়নি

  • রেজাউল করিম হীরা
  • প্রকাশিত ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির ছয় দিনেও আগুন লাগার আসল কারণ জানা যায়নি। এ সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটিগুলোর সংশ্লিষ্টরা। যদিও স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, আগুনের সূত্রপাত কেমিক্যাল থেকে। তাদের এই দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত দলের এক সদস্য। বুয়েটের প্রতিনিধি দলেরও ধারণা একই। কিন্তু কেমিক্যাল ব্যবসায়ীরা গ্যাস সিলিন্ডার থেকেই এই আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বলে দাবি করে আসছেন।

গত বুধবার রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। গতকাল পর্যন্ত এ ঘটনায় ৬৯ জনের প্রাণহানি হয়েছে। আহত হয়েছেন আরো অর্ধশত। কেমিক্যালের গোডাউনের কারণে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেখানকার পাঁচটি ভবন। অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১১ সদস্য বিশিষ্ট এবং বিস্ফোরক পরিদফতরের ৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি এখনো আগুনের সূত্রপাত কোথা থেকে, কীভাবে তা নিশ্চিত করে বলতে পারছে না।

ঘটনার পর পরই আগুন লাগার কারণ নিয়ে সৃষ্টি হয় ধোঁয়াশা। আগুনের পর ঘটনাস্থলে পরফিউমের ক্যান পাওয়া গেলেও, কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী, মেলেনি বিস্ফোরিত সিলিন্ডারের টুকরা। অবিস্ফোরিত আছে পুড়ে যাওয়া একটি প্রাইভেটকারের সিলিন্ডারও। তবে অগ্নিকাণ্ডের সূত্র পেতে প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য ও ঘটনাস্থল থেকে সংগৃহীত আলামত বিশ্লেষণ করছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত দলসহ অন্য তদন্ত কমিটিগুলোও।

স্থানীয়রা বলছেন, ওয়াহেদ ম্যানশনই আগুন ছড়িয়ে পড়ার মূল কারণ। ভবনের দোতলার পুরোটা জুড়ে সুগন্ধি ও বাল্বের গুদাম। তিনতলার তিনটি ফ্ল্যাটে ভাড়াটে থাকলেও, চতুর্থ ফ্ল্যাটে গুদাম রয়েছে। চতুর্থ তলার দুটি ফ্ল্যাটই গুদাম হিসেবে ব্যবহার করা হতো। ভবনের নিচতলায় ১৫টি দোকান। এর মধ্যে কমপক্ষে ছয়টি দোকানে রাসায়নিকের ছোট ছোট ড্রাম ছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, আগুন লাগার পর সুগন্ধির ছোট ছোট বোতল ‘গুলির মতো’ ছুটেছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে একমত পোষণ করেন ফায়ার সার্ভিসের স্বেচ্ছাসেবক হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, ওই ভবনের চার, পাঁচ ও ছয়তলায় গুদাম ছিল। এগুলোতে আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা হাফিজুর রহমান জানিয়েছেন, চু‌ড়িহাট্টা মস‌জি‌দের সামনে থাকা একটি প্রাইভেটকা‌রের গ্যাস সি‌লিন্ডার বি‌স্ফোর‌ণে আগুনের সূত্রপাত হয়। তি‌নি বলেন, বিকট শ‌ব্দে বিস্ফোর‌ণে ভেবেছিলাম বোমা ফে‌টে‌ছে। দৌ‌ড়ে এ‌সে দে‌খি প্রাই‌ভেটকা‌রে আগুন জ্বলছে। মুহূর্তের ম‌ধ্যে আগুন পাশের হো‌টেল ও কে‌মিক্যালের গোডাউনে ছ‌ড়ি‌য়ে প‌ড়ে। শত শত মানুষ দিগবিদিক ছুটতে থাকে। ঘটনার সামনে তি‌নি ১৫-২০ জন‌কে আহত অবস্থায় দেখ‌তে পান বলে জানান।

গতকাল মঙ্গলবার চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশন পরিদর্শন শেষে বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এমএএ শওকত চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান, সিলিন্ডার নয়, ওয়াহেদ ম্যানশনের ২য় তলার বারান্দা থেকে আগুনের সূত্রপাত। সেখানে কেমিক্যাল মজুত থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। দোতলার বারান্দায় দেখা যাচ্ছে ওয়ালটা পড়ে গেছে, ক্ষয়ক্ষতি থেকে বোঝা যাচ্ছে যে এটা কেমিক্যাল থেকে লাগা আগুন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য ও সেখান থেকে সংগ্রহ করা আলামত বিশ্লেষণ করছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত দল। তবে আগুনের কারণ সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না তারা। যদিও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির এক সদস্য জানান, দোতলায় অগ্নিদাহ্য পদার্থ ছিল। সেখানকার বিস্ফোরণেই আগুনের সূত্রপাত। মুহূর্তেই আগুন ৩-৪টি বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর গাড়িগুলোর সিলিন্ডারের বিস্ফোরণ ঘটে।

তবে এ ঘটনায় একে অপরকে দোষারোপ না করে এর প্রতিকার খুঁজে রেব করা দরকার বলে মনে করেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী আহমদ খান। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে আমার মনে হয়, ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলায় উচ্চমাত্রার দাহ্য পদার্থের বিস্ফোরণ থেকেই আগুনের সূত্রপাত। ভিডিও ফুটেজে আমরা মানুষকে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখেছি। যদি নিচ থেকে বিস্ফোরণ হতো তাহলে মানুষ এত দৌড়াদৌড়ি করতে পারত না। বুয়েটের বিশেষজ্ঞরাও আমার সঙ্গে একই মতামত ব্যক্ত করেছেন। আর এলপিজি অত সহজে বিস্ফোরিত হয় না। আগুনে পড়ে থাকলেও তা সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরিত হয় না। কারণ এর মুখ শক্ত করে লাগানো থাকে এবং গার্ড থাকে। এলপিজির বিস্ফোরণগুলো সাধারণত অসাবধানতার কারণে হয়ে থাকে। চুড়িহাট্টার ওই অগ্নিকাণ্ডে ঘটনাস্থলে থাকা হোটেলের এলপিজিগুলো ঠিক ছিল।

তিনি আরো বলেন, ঘটনাস্থলের আশপাশে থিনারের দোকান ছিল। থিনার থাকার কারণে একের পর এক বিস্ফোরণ হয়। দোতলায় স্পিরিট, বিউটেন, দাহ্য কেমিক্যাল ছিল। ওখানে এগুলো রিফিল করা হতো। রিফিলের সময় স্পার্ক (স্ফুলিঙ্গ) থেকে বা অন্য কোনো কারণে আগুন লাগে। বিস্তারিত তদন্তের পর বলা যাবে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, তিনটা কারণে আগুন তীব্র হয় এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। হিট (গরম ভাব/তাপ) থাকলে, সোর্স (দাহ্য পদার্থ) থাকলে এবং অক্সিজেন থাকলে। এ তিনটার যেকোনো একটা যদি বিচ্ছিন্ন করা যায় তাহলে আগুন বাড়তে পারে না। যেমন- কার্বন ডাইঅক্সাইড দিয়ে আমরা অক্সিজেনকে দমাতে পারলে আগুন বন্ধ হয়ে যেত। কিন্তু এখানে অতিরিক্ত দাহ্য পদার্থ থাকায় কোনোটাই দমানো যাচ্ছিল না।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের প্রফেসর আফতাব আলী শেখ জানান, শুধু গ্যাস সিলিন্ডার নয়, অন্য কোনো দাহ্য পদার্থ এবং গ্যাসের সংঘর্ষের ফলেই এই ঘটনা ঘটেছে। ক্ষতিকারক কেমিক্যাল থেকে যে গ্যাস তৈরি হয়, এই গ্যাসের কারণেই মানুষ যায়। এর জন্য আগুন লাগে না। চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডে এটি ঘটেছে বলে আমার মনে হয়।

‘তবে চকবাজারের চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কেমিক্যাল বা কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কারণেই এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা’ ঘটে বলে দাবি করেন বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য এমএসআই হাবিব।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads