আকাশে ডানা মেলার অপেক্ষায় বসন্ত বাউরির দুই ছানা

ছবি: বাংলাদেশের খবর

জাতীয়

আকাশে ডানা মেলার অপেক্ষায় বসন্ত বাউরির দুই ছানা

  • এমএ বশার, বাউফল
  • প্রকাশিত ১১ জুন, ২০২০

মাথায় টকটকে লাল সিঁদুরে মুকুট। ডানা মেলার অপেক্ষায়। করোনায় মানুষের এই ঘরবন্দি দশায় ডিম ফুটে বের হবার ৫-৬ দিন পর থেকেই পথের পাশে গাছের খোলে ছোট ছোট স্বরে কুট-উ-রুক, কুট-উ-রুক শব্দ জানান দিচ্ছে পৃথিবীর নির্মল মুক্ত আলো-বাতাসে ওদেরও এক নিরঙ্কুশ অধিকারের কথা। ডিম ফোটার বয়স ১৭-১৮দিন হওয়ায় আসমানী-সবুজ পালকে ভরেছে চোখের দু’পাশ ও শরীর। ঠোঁটের গোড়ায় কয়েকটি লোমও গজিয়েছে বিড়ালের গোফের মতো। তাই এখন কেবল উড়াল দেবার পালা। হয়তো দু’এক দিনের মধ্যেই বসন্ত বাউরির বাচ্চা দু’টি ফুরুত করে ছুটবে আকাশ পানে।

পটুয়াখালীর বাউফলের ধানদী গ্রামের এই প্রতিবেদকের বাড়ি লাগোয়া ডানিডা রাস্তার পাশের খোড়লের বাসা ছেড়ে পাখির বাচ্চা দু’টি আকাশে ডানা মেললে প্রকৃতি পাবে এক নতুন দিগন্ত।

বসন্ত বাউরি মেগালাইমিদি গোত্রের পাখি। ঘন পাতার বড় গাছে বেশি বিচরণ এদের। ঘন পাতার আড়ালে থাকতেই ভালবাসে। খাবারের অভাবে কখনো কখনো বাড়ির আতা, জামরুল, কাঁঠাল, পেঁপে, সফেদা, জলপাই কিংবা গ্রামীণ মেঠোপথের পাশের খেজুর গাছে রসের হাঁড়িতেও দেখা মেলে। তবে বসন্তে বটের লাল টুকটুকেফলের সঙ্গে মাথার সিঁদুরে লাল রঙটাতে শতভাগ মানায় বৃক্ষচারি এই পাখিটি।

মানুষের নিদারুন অত্যাচারে মারত্মক ক্ষতির পর যখন করোনায় এবার মানুষের সঙ্গ নিরোধে উপকূলীয় চরাঞ্চলে দীর্ঘদিনের বৈরী হয়ে ওঠা

পরিবেশ প্রকৃতির সঙ্গে হাফ ছেড়ে ফটিকজল, মৌটুসি, দূর্গাটুনি, কসাই, কাঠশালিক, দোয়েল, ফিঙে, রামগাংরা, দুধরাজের মতো পাখপাখালিরা যত্রতত্র বাসা তৈরীর মতো জীবনাচরণে ভিন্ন সারা দিচ্ছিল ঠিক তখনই ওইসব পাখপাখালির মতো গাছের খোড়লে ডিম দিয়ে বাচ্চা ফোটাতে দেখা যায় বিলূপ্তপ্রায় বসন্ত বাউরিকেও। পাখি প্রেমিদের কাছে এ যেন এক অনন্য দারুণ ঘটনা।

দৃষ্টি নন্দন অবয়বের নরম ফলাহারী পাখি এই বসন্ত বাউরি। নিজেরা গর্ত করে না, তবে অন্যের ব্যবহৃত খোড়ল কিংবা প্রাকৃতিভাবে গড়ে ওঠা গাছের কোঠরে বা ফোকরে ফেব্রুয়ারী-এপ্রিলে এরা বাসা বানায় এবং ৩-৪টি ডিম দেয়। এ সময়ে পথের পাশের একটি রেইট্রি গাছের কেটে ফেলা মড়া ডালের গোড়ার দিকে অন্যের ব্যবহৃত এক খোড়লেই ডিম দিয়ে দুটি বাচ্চা ফুটিয়েছে এখানে। বাসায় বাচ্চা দুইটির আকাশে উড়ালের সময় সীমা ছুঁই-ছুইঁ করছে এখন। মা পাখিটির খাবার নিয়ে আসার অপেক্ষা করছে আর ঘোঙানির মতো শো-শো শব্দ করছে। একটু বড় হয়ে ওঠার পর থেকে অনবরত কিছুটা ক্ষীণ স্বরে কুট-উ-রুক, কুট-উ-রুক ডাকছে। কখনো আবার খোড়ল থেকে চাঁদিতে টকটকে সিঁদুরে লাল পালক আর বিড়ালের মতো কয়েকটি গোফ গজিয়ে ওঠা মাথা বের করে উকি দিচ্ছে।

বসন্ত বাউরি পাখিরা কিছুটা ছোট হওয়ায় দেখতে হঠাৎ টিয়ে পাখির মতো মনে হয়। ২২-২৪ সেন্টিমিটার লম্বা এ পাখিটি। কপাল ও বুক টকটকে লাল। কপাল ও মাথার টকটকে লালের মধ্যেও আছে কালো ছোপ। চোখের দু’পাশে ও গলায় আসমানি সবুজে ঘেরা। ঘাসরঙা সবুজ শরীর। মুখাবয়ব কালচে। চোখ কালচে-ধাতব। শক্ত-মজবুদ ঠোট হলুদ-কালচে। ঠোঁটের গোড়ায় বিড়ালের গোফের মতো কয়েকটি শক্ত লোম আছে। লীলাভ-সবুজ প্রান্তের খাটো লেজ। পা হলদে-বাদামি। কেউ কেউ পাখিটিকে বসন্তবৌরি নামেও চিনে। একই প্রজাতির স্ত্রী ও পুরুষ পাখির মধ্যে রঙ-রুপের তেমন কোন পার্থক্য নেই। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার পরে উভয়ে খাবার সংগ্রহ করে। বুনো ফল-ফলাদি, ফসল মৌসুমে পোকামাকড়ের মতো সহজে খাদ্য যোগান দিতে পারলে ডিম দিয়ে বাচ্চা ফোটায় এই দৃষ্টি নন্দন বসন্ত বাউরি পাখিরা।

বট-পাকুড়ের মতো বুনো ফল-ফলাদি এদের প্রধান খাদ্য। পেঁপে, পেয়ার, জাম, আতা, সফেদা, খেজুরের রসেও আসক্তি আছে। খাবারের অভাবে পোকামাকড়ও খায় এরা। বাসায় বাচ্চাদের জন্য পাকা পেঁপে, কলা, খেজুরের মতো নরম ফল-ফলাদি ও একটু বড় হয়ে উঠলে পোকামাকড় যোগাতে দেখা গেছে। কুট-উ-রুক, কুট-উ-রুক স্বরে ডাকে এরা। অনেক দূর থেকেও শোনা যায় ডাক।

স্থানীয় প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন ‘সেভ দি বার্ড এ্যান্ড বি’র পরিচালক মন্ডলির একজন সামসুন নাহার জানান, মানুষ অপর প্রাণীর আবাসস্থল কেড়ে নিয়ে, খুন আর প্রাণ-প্রকৃতি লুট করে বিষিয়ে তুলছিল উপকূলীয় পরিবেশ। মুক্ত পরিবেশ পেয়ে গাছে গাছে যত্রতত্র বাসা তৈরি করছে মৌটুসী, কাঠ শালিক, দোয়েল, ফিঙ্গে, ডাহুক, হটটিটি, কসাই, পিলুপ্ত প্রায় বসন্ত বাউরির মতো সব পাখিরাও। এ সময়ে জীব-জানোয়ার, পাখি, পতঙ্গ, লতাগুল্ম থেকে বৃক্ষ জলে-স্থলে সর্বত্র ভিন্ন সাড়ায় ফিরে আসতে শুরু করেছে উপকুলীয় নান্দনিক পরিবেশ। তিনি বলেন, ‘দূষণ মুক্ত পরিবেশ, সার-বিষসহ রাসয়নিক পদার্থের

সুশৃঙ্খল ব্যাবহার, সবুজ বেস্টনি রক্ষা, বনাঞ্চল উজার রোধ, নদী-শাসন রোধ, জলে-স্থলে প্রাণীবান্ধব পরিবেশ তৈরীসহ চিন্তা বদলে দেশি প্রজাতির গাছে পরিকল্পিত বনায়ন করে প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশ রক্ষা করা উচিৎ। নিরন্তর যাত্রায় বসন্ত বাউরিসহ যত্রতত্র পাখিদের বাসা তৈরীর মতো জীবনাচারণ পরিবর্তণের শিক্ষা নিয়ে প্রাণবান্ধব পরিবেশ তৈরীতে সবার এগিয়ে আসতে হবে।’

পাখি বিশেষজ্ঞ পটুয়াখালী সরকারি কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী অধ্যাপক পিযুষ কান্তি হরি জানান, ভারতের হিমালয়ে বেশি সংখয় ও আমাদের দেশে ৬-৭ প্রজাতির বসন্ত বাউরি দেখা যায়। অন্যের ব্যাবহৃত খোড়ল কিংবা গাছের কোঠরে ফেব্রুয়ারী-এপ্রিলে এরা বাসা বানায় এবং ৩-৪টি ডিম দেয়। ১৫-১৬ দিন পরে ডিম ফুটে এবং ২০-২২ দিনে আকাশে বাচ্চারা ডানা মেলে।

তিনি বলেন, পটুয়াখালী সদরসহ উপকূলীয় এ অঞ্চলে এদের বেশি সংখ্যায় দেখা মেলে। পেঁপে, পেয়ার, জাম, আতা, সফেদাসহ খেজুরের

রসেও আসক্তি আছে। এদের গতি স্বাভাবিক। জোড়ায় জোড়ায় থাকতে ভালবাসে। অনেক সময় ছোট দল বেঁধেও থাকে এরা। তিনি বলেন, ‘প্রকৃতিতে বসন্ত বাউরির সুন্দর দৃষ্টিনন্দন পাখিদের রক্ষায় সবার অনুকুল দৃষ্টিভগ্নি থাকা উচিত।’

বন অধিদপ্তর বাংলাদেশের পাখি বিশেষজ্ঞ আল্লামা শিবলি সাদিক বলেন, ‘বসন্ত বাউরি বিলূপ্তপ্রায় নয়, ভাল অবস্থানে আছে। সবার নজরে কম আসলেও সুন্দর দৃষ্টিনন্দন এই পাখিটি দেশের সর্বত্র কম-বেশি দেখা যায়। করোনা কালে পাখপাখালিসহ প্রাণীর জীবনাচরণে দৃশ্যমান পরিবর্তণ আসছে। পৃথিবী পাখিদেরও। সংকটের পরে এ কথা যেন ভুলে না যাই। বসন্ত বাউরির মতো অপরুপা সব সুন্দর পাখিগুলো রক্ষায় ফুল-ফসল আর ফল-ফলাদিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক প্রয়োগ না করা, বনভূমি উজাড় বন্ধ করাসহ আমাদের রূঢ় আচরণের পরিবর্তণ করতে হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads