ফুয়াদ হাসান
বর্তমান যুগে তথ্য ও প্রযুক্তি আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সকালে দিনের শুরু থেকে রাতে ঘুমানো পর্যন্ত সব কাজেই আজ রয়েছে প্রযুক্তির পরশ। তথ্য ও প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে করেছে সহজ ও আনন্দময়। প্রযুক্তির ছোঁয়া পড়েছে গৃহস্থালির ক্ষুদ্র গণ্ডিতে শুরু হওয়া অর্থশাস্ত্রেও। নীরস আর গাণিতিক সমাধানের গৎবাঁধা পাঠও আজ সহজ, উপভোগ্য ও সময় উপযোগী হয়ে উঠেছে প্রযুক্তির ছোঁয়ায়। কালের বিবর্তনে পরিবর্তন হয়ে মার্কেন্টাইল, খোলাবাজারের মাধ্যমে আজ অনলাইন যুগে পৌঁছিয়েছে। অর্থশাস্ত্রে বিনিময় প্রথার মাধ্যমে শুরু হওয়া বাণিজ্য আজ ই-কমার্স যুগে রূপান্তর ঘটেছে, যা আধুনিক জীবনে এনেছে সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য। ই-কমার্স বা ইলেকট্রনিক বাণিজ্য হলো বাণিজ্যের এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে অনলাইন বা ইলেকট্রনিক সিস্টেমে (ইন্টারনেট বা অন্য ডিভাইস) পণ্য ক্রয়-বিক্রয় ও পেমেন্ট করা হয়। ই-কমার্স ধারণা বিশ্বে নবীন হলেও এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী এর ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। জার্মান ওয়েব পোর্টাল স্ট্যাটিস্টার হিসেবে বলছে, ২০২০ সালে বৈশ্বিক ই-কমার্স ব্যবসার বাজারের আকার দাঁড়াবে দুই লাখ কোটি ডলার। সবচেয়ে বড় বাজার হবে চীনের। এরপর রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, যুক্তরাজ্য ও জার্মানি। ২০২০ সালে প্রতিবেশী দেশ ভারত ৪৩৮৯, পাকিস্তান ৩৬০, মিয়ানমার ও নেপাল ৩১ কোটি ডলারের ই-কমার্সের বাজার গড়ে উঠবে। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা আঙ্কটাড জানায়, ২০১৮ সালে বিশ্বের ১৪০ কোটির বেশি মানুষ অনলাইনে কেনাকাটা করেছে, যা বিশ্বের জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ। এ কেনাকাটা আগের বছরের চেয়ে ৯ শতাংশ বেশি। সবচেয়ে বেশি অনলাইন কেনাকাটা করেছে চীনের মানুষ। যে সংখ্যা ৬১ কোটি। বিদেশি পণ্য কিনেছে বা আন্তঃসীমান্ত কেনাকাটা করছে বিশ্বের ৩৩ কোটি মানুষ, যা ২০১৮ সালের কেনাকাটার ২৩ শতাংশ। এদিক থেকে পিছিয়ে নেই দক্ষিণ এশিয়ার ধাবমান অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ। এরই মাঝে বাংলাদেশেও ই-কমার্স জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে ই-কমার্স মূলত ২০১০ সালে শুরু হলেও ২০১৬ সালে এর ব্যপক প্রসার ঘটে। শুরুতে ২০১০-১১ সালে বাংলাদেশে ই-কমার্সে মোট ব্যবসার পরিমাণ ছিল ৮০ কোটি টাকা। এর পরের বছর ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি হয়ে থাকে। বর্তমান প্রবৃদ্ধিও শতভাগের ওপর। বাংলাদেশ ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশনের নিবন্ধিত সদস্য রয়েছে ১৩০০ জন। বাংলাদেশে ইতোমধ্যে ৭ থেকে ১০ হাজার ফ্রিল্যান্সার সফটওয়্যার ডেভেলপার কর্তৃক প্রায় ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করছে। বাংলাদেশে প্রায় ৪০০টি সফটওয়্যার ফার্ম, আইসিটি কোম্পানি তাদের উৎপাদিত সফটওয়্যার এবং আইসিটি সার্ভিসেস যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের ৬০টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। বাংলাদেশে ই-কমার্স গ্রাহকদের সিংহভাগ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ই-কমার্স সেবা গ্রহণ করে। বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিওয়াইএমএনটিএস বলছে, ২০২০ সালে অনলাইন কেনাকাটার ৭২ শতাংশ হচ্ছে মোবাইল ফোনে। ২০১৯ সালে এ হার ছিল ৪৯.৬ শতাংশ। ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইক্যাব) তথ্যমতে, ই-কমার্স খাতে প্রতি মাসে এখন প্রায় ৭০০ কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। অর্থাৎ বার্ষিক লেনদেন এখন আট হাজার কোটি টাকার বেশি। সংস্থাটি আরো জানায়, গত বছর এ খাতে প্রায় এক হাজার ৮০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। চলতি বছরে লেনদেন এক বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। জানা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশের ই-কমার্সের লেনদেন ছিল প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। এর আগের বছরে এটির আকার ছিল এক হাজার ৬০০ কোটি। আঙ্কটাডের দেওয়া হিসাবমতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ই-কমার্স খাতের প্রবৃদ্ধি প্রায় ২৫ শতাংশ। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ই-কমার্স খাতে বাংলাদেশে এখনো অনেকটা পিছিয়ে। তথ্য অনুযায়ী, ভারতে গত পাঁচ বছরে অনলাইন কেনাকাটা প্রতিবছর ৫০-১০০ শতাংশ হারে বাড়ছে। ভারতে এখন মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশের মতো লোক বছরে একবার হলেও অনলাইনে কিছু না কিছু কেনে। চীনের ৫০ শতাংশ জনগণ নিয়মিত অনলাইনে কেনাকাটা করে। ভিয়েতনাম বা ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশেও ২০-২৫ শতাংশের মতো জনগোষ্ঠী অনলাইনে কেনাকাটা করে। এদিক থেকে আমরা এখন সেই পশ্চাৎপদ। সাম্প্রতিক একটি জরিপ অনুযায়ী, আমাদের দেশের মোট স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর মাত্র ১১ শতাংশ অনলাইনে কেনাকাটা করে (ভারতে যেটি ৪০ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ায় ৩০ শতাংশ আর চীনে ৮০ শতাংশ)। পশ্চাৎপদ হলেও বাংলাদেশে রয়েছে ই-কমার্সের অপার সম্ভাবনা। কারণ এখন পর্যন্ত ই-কমার্স সেবা গ্রহণকারীর সিংহভাগ গ্রাহক শহরের বাসিন্দা। গ্রামের বিশাল জনপদকে ই-কমার্সে আগ্রহী করতে পারলে এর বাজার হবে বহুল সম্ভাবনাময়। আগামী ৩-৪ বছরে ই-কমার্স খাতে লেনদেন ১০ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা সম্ভব। এখন যেখানে মাত্র ১৫ লাখের মতো অনলাইন ক্রেতা আছে, সেটি এক থেকে দেড় কোটিতে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। দেশের বয়োজ্যেষ্ঠ বাণিজ্য সংগঠন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) বলছে, আগামী ২০২১ সাল নাগাদ ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি আয় অর্জনের সুযোগ রয়েছে ই-কমার্স খাতে। এছাড়া বাংলাদেশের মতো উচ্চ বেকারত্ব হারের দেশের জন্য ই-কমার্স একটি আশীর্বাদ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশে ২৬ লাখ ৭৭ হাজার বেকার রয়েছে। এদের মধ্যে ১০ লাখ ৪৩ হাজার শিক্ষিত তরুণ-তরুণী, যারা উচ্চমাধ্যমিক অথবা স্নাতকোত্তর পাস করেছে। অর্থাৎ শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় ৪০ শতাংশ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ভাষ্যমতে, বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষিত বেকারত্বের হার ১০ দশমিক ৭ শতাংশ, যা আমাদের চলমান অর্থনীতির জন্য অশুভ বার্তা। তবে ই-কমার্স বেকারত্বের হার হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৬৫ শতাংশের বয়স ৩৫ বছরের নিচে। অন্যদিকে ই-কমার্স ব্যবহারকারীদের সিংহভাগের বয়স ১৮-৩৫ বছর। সুতরাং এ খাতে শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ গড়ে উঠেছে। ই-ক্যাবের তথ্যমতে, ই-কমার্স খাতে গত কয়েক বছরে প্রায় ২০ হাজার উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে।
জানা গেছে, ই-বাণিজ্য বা জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি বিকাশে আগামী তিন বছরের মধ্যে দেশে ৫ হাজার ই-কমার্স উদ্যোক্তা তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ই-কমার্স আমাদের এ যুগের চাহিদা। তাছাড়া আমাদের আর্থনীতির অগ্রযাত্রায় ই-কমার্সের গুরুত্ব অপরিসীম। আধুনিক যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করতে ই-কমার্সকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। এক্ষেত্রে সাইবার নিরাপত্তার কথাও বিবেচনায় নিতে হবে। সর্বোপরি আগামী দিনে ই-কমার্স হয়ে উঠুক আমাদের অর্থনীতির ধারক, বাহক ও প্রাণশক্তি এবং হাজারো বেকারের স্বপ্নের পথযাত্রী।
লেখক : শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া