সুপারি এক প্রকারের ফল-ফসল। এর ইংরেজি নাম বিটেল নাট। সংস্কৃত ভাষায় বলে গুবাক। সুপারি পাম গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। পান এবং সুপারি একে অপরের পরিপূরক। গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ নিয়মিত পান-সুপারি খান। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভোজের শেষে বিশেষ আপ্যায়নের তালিকায় এর স্থান থাকে সবার উপরে। বাঙালিদের এ রেওয়াজ বহু পুরনো। এমন বুড়াবুড়িও আছেন খাবার কম খেতে রাজি, কিন্তু প্রতিবেলা পান-সুপারি থাকতেই হবে। কেউ আছেন খাওয়া শেষে এক টুকরো সুপারি খেতে অভ্যস্ত। ফলজাতীয় ফসলের মধ্যে সুপারি চাষে সবচেয়ে কম জায়গা লাগে। প্রতিকূল পরিবেশেও এরা বেড়ে উঠতে পারে। সারিবদ্ধ গাছ বাড়ির শোভা বাড়ায়। সুপারির আদি নিবাস এদেশে না হলেও উপকূলীয় এলাকায় এর ফলন ভালো হয়।
এসব জেলাগুলো মধ্যে বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, খুলনা, বাগেরহাট, নোয়াখালী, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অন্যতম। এরা সবল কান্ডের অধিকারী এবং শাখাহীন হয়। এক বীজপত্রী এ বৃক্ষ সাধারণত ৮০-১০০ ফুট উচ্চতার হয়। এর পাতার আকার লম্বা। মধ্যশিরা বেশ শক্ত এবং দু’পাশে চিরুনির দাঁতের ন্যায় সবুজ পত্রফলক সাজানো থাকে। বড় ধরনের পত্রখোল কান্ডের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে গাছে ফুল আসে আর পাকে কার্তিক-অগ্রহায়ণে। কাঁদিতে থোকায় থোকায় অনেক ফল ধরে। কাঁচা ফল দেখতে সবুজ। পরিপক্ব হলে হলুদ বা কমলা রঙ ধারণ করে। কাঁচা ও পাকা উভয় ফল খাওয়া যায়। ফল দেখতে অকেটা গোলাকার। সুপারি গাছের শিকড় উপরেও বিস্তৃত থাকে। বাংলাদেশে এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক। আন্তর্জাতিক বাজারেও এর চাহিদা ব্যাপক। ইচ্ছে করলে আমরাও লুফে নিতে পারব বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বিরাট সুযোগ।
সুপারিতে কিছু ভেষজগুণ রয়েছে। সুপারি আগুনে ভেজে মিহি গুঁড়া করে নিয়মিত দাঁত মাজলে দাঁতের ব্যথা ভালো হয়। এ ছাড়া রক্ত আমাশয়, কৃমি ও অজীর্ণ রোগের উপকার পাওয়া যায়। সুপারি শরীরকে চাঙ্গা রাখে। বমিভাব দূর করে। দাঁতের ক্ষয় রোধ করে। কাজ করার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। হজমে সহায়তা করে। দাঁতের অ্যান্টিসেপ্টিক হিসেবে কাজ করে। এতে মুখের দুর্গন্ধ দূর হয়। পাশাপাশি ক্ষয় রোধ করে। রঙ ও ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে সুপারি ব্যবহার হয়। পানি শোধনেও কাজ করে। গাছ দিয়ে কবরের পাটাতন দেওয়া যায়। এ ছাড়া কুঁড়েঘরের বেড়া নির্মাণে কাজে লাগে। সুপারি পাতা সোয়ারি হিসেবে ব্যবহার হয়। মাটিতে পাতার খোলের ওপর একজন বসে থাকে, আরেকজন পাতার অগ্রভাগ ধরে টেনে নিয়ে যায় এবাড়ি-ওবাড়ি। এ এক ভিন্ন রকম আনন্দ। এমন দৃশ্য গ্রামাঞ্চলে আজো চোখে পড়ে।
আমরা জানি, বৃক্ষ রোপণের ক্ষেত্রে রৌদ্রোজ্জ্বল জমি উত্তম। কিন্তু সুপারির বেলায় কিছু ভিন্নতা আছে। আর তা হলো, জমি হওয়া চাই হালকা ছায়াযুক্ত এবং স্যাঁতসেতে পরিবেশ। প্রখর রোদ ও তীব্র বাতাস গাছের বাড়বাড়তি এবং কাঙ্ক্ষিত ফলনের অন্তরায়। সুনিষ্কাশিত, উঁচু, উর্বর এবং শুষ্ক মৌসুমে সেচের ব্যবস্থা আছে এমন জমি নির্বাচন করতে হবে। এদেশে এখন পর্যন্ত সুপারির উচ্চফলনশীল জাতের উদ্ভাবন হয়নি। আবাদকৃত জাতগুলো স্থানীয়। এর ফলন কম। তবে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ করলে ফলন বাড়ানো সম্ভব। চারা লাগানোর আগে বাগানে অবশ্যই ছায়া দেয় এমন গাছ রোপণ করে নিতে হবে। এজন্য মাদার গাছ হলে সবচেয়ে ভালো হয়। ছয় ফুট আকারের মাদারের ডাল ১২ ফুট পরপর লাগাতে হবে। বাগানের চারপাশে আম, কাঁঠাল, জাম, নারিকেল এসব ফল গাছ লাগালে বাতাস প্রতিরোধ করবে।
পাশাপাশি ফল বিক্রি করে পাওয়া যাবে বাড়তি আয়। চারা রোপণের এক মাস পূর্বে গর্ত তৈরি করতে হবে। গর্তের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতা হবে ২ ফুট করে। খড়কুটা পুড়িয়ে পুরো গর্তের মাটি শোধন করে নেয়া ভালো। গর্তপ্রতি ১০ কেজি জৈবসার এবং এক কেজি সরিষার খৈল মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হয়। প্রতি চারার দূরত্ব হবে ৮ দশমিক ৫ ফুট করে। জুন হতে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চারা লাগানো যায়। ভালো ফলনের জন্য প্রয়োজন সুষম সার ব্যবস্থাপনা। সেই সঙ্গে প্রয়োজন আগাছা পরিষ্কার, মালচিং, গাছের গোড়ায় মাটি তুলে দেওয়া, সেচ, নিষ্কাশন এবং রোগ-পোকা দমন। সাধারণত পাঁচ বছরে গাছে ফল ধরে। ১০-৪০ বছর পর্যন্ত সর্বোচ্চ ফলন হয়। একটি গাছে ৩-৫টি ছড়া হতে পারে। আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে হেক্টরপ্রতি ৪-৬ টন ফলন পাওয়া সম্ভব।
লেখক : টেকনিক্যাল পার্টিসিপেন্ট, কৃষি তথ্য সার্ভিস,বরিশাল