ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৫ দফা চিরুনি অভিযানেও নিয়ন্ত্রণে আসেনি ডেঙ্গু। এসব অভিযানে প্রায় চার লাখ ভবন ও স্থাপনা পরিদর্শনের মাধ্যমে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুর প্রায় সাড়ে তিন হাজার স্থানে লার্ভার সন্ধান পেয়ে সেগুলো ধ্বংসও করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, আসছে শীত, বাড়ছে মশার উপদ্রব। দেখা দিয়েছে ডেঙ্গুর ঝুঁকি। এর মধ্যে চলছে করোনা মহামারী। এই করোনার মধ্যে যদি ডেঙ্গু জেঁকে বসে তবে তা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। যদিও মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু প্রতিরোধে বছরব্যাপী ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) কাজ করে যাচ্ছে; কিন্তু মিলছে না কোনো কার্যকরী সমাধান। নিয়মিত ওষুধ ছিটানোর পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি এবং জরিমানা করেও নিয়ন্ত্রণে আসছে না মশাবাহিত রোগ।
ডিএনসিসি সূত্রে জানা গেছে, সংস্থাটি চলতি বছরের মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৫ দফায় বিশেষ চিরুনি অভিযান পরিচালনা করেছে। এর মাধ্যমেই মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণ এবং রোগের প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে সংস্থাটি। এসব অভিযানে প্রায় চার লাখ ভবন ও স্থাপনা পরিদর্শনের মাধ্যমে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুর প্রায় সাড়ে তিন হাজার স্থানে লার্ভার সন্ধান পেয়ে সেগুলো ধ্বংসও করেছে। সেইসঙ্গে অভিযানে সচেতনতার পাশাপাশি ছিল জরিমানাও। এসব অভিযানে মশা নিয়ন্ত্রণ না হলেও জরিমানা করে ডিএনসিসির আয় হয়েছে ৭৮ লাখ টাকার বেশি।
বাসিন্দারা বলছেন, কিছুদিন পর পর অভিযান হয়, নিয়মিত ওষুধও ছিটানো হয়। তবুও কেন মশা নিয়ন্ত্রণে আসে না। দিনে রাতে এখনো মশার উপদ্রব আগের মতোই। আবার কেউ কেউ বলছেন এসব অভিযান এবং ওষুধ ছিটানো লোক দেখানো ছাড়া আর কিছুই না। তবে ডিএনসিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, একেবারেই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলেও আগের তুলনায় মশার উপদ্রব কমেছে। আর এটি সম্ভব হয়েছে বছরব্যাপী কার্যক্রমের ফলে। তাই নিয়মিত ওষুধ ছিটানোর পাশাপাশি বিশেষ অভিযানও অব্যাহত রাখা হয়েছে বলে জানান তারা।
সরেজমিনে রাজধানীর নতুনবাজার, বাড্ডা, খিলগাঁও, পল্লবী, ভাসানটেকসহ এর আশপাশের এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসব এলাকায় মশার উপদ্রব এখনো আগের মতোই। তবে নিয়মিত ওষুধও ছিটানোর দৃশ্য বাসিন্দারা দেখতে পাচ্ছেন বলেও জানাচ্ছেন। কিন্তু বাসিন্দাদের প্রশ্ন, তবুও কেন কমছে না মশা?
নতুনবাজার এলাকার বাসিন্দা তাজুল ইসলাম পাভেল বলেন, ‘গত কয়েক মাস ধরে দেখছি বিকেল বেলা এলাকায় নিয়মিত ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। কিন্তু ওষুধ ছিটিয়ে লাভ কি। রাতের বেলা মশারি ছাড়া তো ঘুমাতে পারি না। গত এক বছরে কোনোদিন মশারি ছাড়া ঘুমাতে পারিনি। এতদিন তো গরম ছিল তাই ফ্যান চলছে। এজন্য মশা একটু কম লাগত। কিন্তু সামনে তো শীতের কারণে ফ্যান বন্ধ করে রাখতে হবে। তাই মশার উপদ্রব বাড়বে বলে মনে হয়।’
একই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন কাফরুলের বাসিন্দা আশরাফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘পত্র-পত্রিকায় প্রায় সময় দেখি সিটি করপোরেশন অভিযান করছে মশার বিরুদ্ধে। কিন্তু ফল তো একই। কবে মশার যন্ত্রণা থেকে বাঁচব?’ তবে খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা কানিজ ফাতেমা জানান, আগের তুলনায় মশা কিছুটা কমেছে। তবে পুরোপুরি না কমায় কয়েল আর মশারিই তার ভরসা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১৬ থেকে ২০ মে প্রথম মশাবিরোধী বিশেষ চিরুনি অভিযান শুরু করে ডিএনসিসি। এ অভিযানে ৯ হাজার ৪৬৩টি স্থাপনা পরিদর্শন করে ১৮৭টিতে এডিসের লার্ভার সন্ধান পায় পরিদর্শন টিম। এ অভিযানে লার্ভা পাওয়ায় ৪ লাখ ৫৮ হাজার ৩০০ টাকা জরিমানা করে ডিএনসিসির ভ্রাম্যমাণ আদালত। এরপর ৬ থেকে ১৪ জুন দ্বিতীয় দফায় ফের বিশেষ চিরুনি অভিযানে নামে ডিএনসিসি। এ সময় ১ লাখ ৩৪ হাজার ১৩৫টি বাড়ি ও স্থাপনা পরিদর্শন করে ১ হাজার ৬০১টি বাড়িতে এডিসের লার্ভার সন্ধান পায় পরিদর্শন টিম। এডিসের লার্ভা পাওয়ায় সেসময় মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ২১ লাখ ৮৫ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়। তবুও নিয়ন্ত্রণে আসেনি মশার উপদ্রব। তাই ফের তৃতীয় দফায় ৪ থেকে ১৪ জুলাই ১০ দিনব্যাপী বিশেষ চিরুনি অভিযান শুরু করে ডিএনসিসি। এ অভিযানেও ১ লাখ ৩০ হাজার ৯৭৮টি বাড়ি ও স্থাপনা পরিদর্শন করে ৮৯৮টিতে এডিসের লার্ভার সন্ধান পায় পরিদয়শন টিম। এতে ২১ লাখ ৬৮ হাজার ৭১০ টাকা জরিমানা করা হয়। এ অভিযানের পরও নিয়ন্ত্রণে আসেনি মশার উপদ্রব।
তাই চতুর্থ দফায় ফের ৮ থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত ১২ দিনব্যাপী বিশেষ চিরুনি অভিযান শুরু করে ডিএনসিসি। এ অভিযানেও ১ লাখ ৩০ হাজার ৯৭৪টি বাড়ি, স্থাপনা, নির্মাণাধীন ভবন ইত্যাদি পরিদর্শন করে ৬৯১টিতে এডিসের লার্ভা পাওয়া যায়। তখন মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে মোট ১০ লাখ ৪ হাজার ৩০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত চলতি বছরে চিরুনি অভিযানের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ৪ লাখ ৫ হাজার ৫৫০টি বাড়ি ও স্থাপনা পরিদর্শন করে ২ হাজার ৬৮৬টিতে এডিসের লার্ভা পাওয়া যায়। এডিসের লার্ভা পাওয়ায় মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে মোট ৫৮ লাখ ১৬ হাজার ৮১০ টাকা জরিমানা আদায় করে ডিএনসিসি। কিন্তু তবুও নিয়ন্ত্রণে আসেনি মশার উপদ্রব। উল্টো ঝুঁকি বেড়েছে ডেঙ্গু সংক্রমণের।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সূত্র বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীর বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্কয়ার হাসপাতাল, গ্রিন লাইফ মেডিকেল হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল, আদ-দ্বীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন করে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন। তবে ডিএনসিসি এলাকায় ঠিক কত সংখ্যাক রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন সে তথ্য করপোরেশন কিংবা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কোনো সংস্থার কাছে পাওয়া যায়নি।
এদিকে চার দফায় বিশেষ অভিযান পরিচালনা করেও মশা নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে আবারও অভিযান শুরু করেছে ডিএনসিসি। গত ৩ নভেম্বর থেকে চলছে এ অভিযান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএনসিসির উপ-প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লে. কর্নেল মোস্তফা সারওয়ার বলেন, ‘আমরা আশা করছি, চলতি অভিযানের পর ডেঙ্গুর প্রবণতা কমবে। কারণ প্রথম যে পরিমাণ লার্ভা পেয়েছি শেষের দিকে এসে কিন্তু সে পরিমাণ পাচ্ছি না। এতেই স্পষ্ট যে, লার্ভা অনেকটাই কমেছে। আমরা ১০টি ভাগে অভিযান পরিচালনা করছি। কিন্তু বৃহস্পতিবার অঞ্চল-৩-এর অভিযানে কোনো লার্ভাই পাওয়া যায়নি। কোথাও কোথাও পাওয়া গেলেও তা অনেক কম। আমাদের অভিযানে কীটতত্ত্ববিদরাও থাকেন। তারা-ই বলছেন সামনে ডেঙ্গুর প্রবণতা থাকবে না। কারণ এখন আর বৃষ্টি হবে না।’
তিনি বলেন, ডেঙ্গু প্রবণতা কমলেও কিউলিক্স মশা থাকবে। এ মশার কারণে রোগ না হলেও নাগরিকরা তো বিরক্ত হয়। তাই চিরুনি অভিযান শেষে আমরা কিউলিক্স মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করব।’ অভিযানে জরিমানার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মোস্তফা সারওয়ার বলেন, ‘জরিমানা অভিযানের মূল লক্ষ্য নয়। অভিযানটি মূলত সচেতনতা সৃষ্টি এবং ডেঙ্গুর ঝুঁকি কেমন সেটি নিরূপণের জন্য। যাদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে লার্ভা সৃষ্টিতে তাদের দায় বেশি, এমন ব্যক্তিদের জরিমানা করা হয়েছে। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, নাগরিকরা আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন হয়েছে।’