মুহাম্মদ হাবীব আনওয়ার
আমরা মানুষ। আশরাফুল মাখলুকাত। সৃষ্টির সেরা জীব। অসংখ্য অগণিত নিয়ামতে ভরপুর আমাদের চারপাশ। সবুজ-শ্যামল ফসল, গোলাভরা ধান। গোয়ালভর্তি গরু। উপরে সুবিশাল আসমান। নিচে বিস্তৃত ময়দান। গাছে ফুল-ফল। নদীভরা জল ইত্যাদি। এসবই আল্লাহ আমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন। আর আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তার ইবাদতের জন্য! আর সেই কথাই বিবৃত হয়েছে পবিত্র কোরআনে ‘আমি মানুষ এবং জ্বীন জাতিকে সৃষ্টি করেছি আমার দাসত্ব করার জন্য।’ (সুরা জারিয়াত, আয়াত-৫৬)
কিন্তু হিংসুক ইবলিস আমাদেও পেছনে লেগেই আছে ছায়ার মতো। যার ফলে আলোকিত, সুন্দর-স্বচ্ছ জীবনে নেমে আসে নিকষ কালো অন্ধকার। অপরাধের কারণে, ধ্রুব সাদা দিলটি হয়ে যায় কলুষিত! তখন মানুষ আর মানুষ থাকে না। নেমে যায় পশুত্বে। নন্দিত ব্যক্তিটিও হয়ে উঠে নিন্দিত। সবার চক্ষুশুল। কারণ, আমাদের কিছু কিছু অপরাধ মনুষ্যত্বের গণ্ডি থেকে আমাদের বের করে পৌঁছে দেয় পশুত্বের কাতারে। আমাদের অপরাধগুলো দেখে খোদ ইবলিসও লজ্জা পায়। সারা পৃথিবী আজ যেন অপরাধের অভয়ারণ্য। চারদিক শুধু অন্যায় আর অবিচার। নির্বিচারে চলছে মানুষ হত্যা। গুম-খুন, ধর্ষণ, হত্যা, চুরি ডাকাতি তথা এমন কোনো অপরাধ নেই যার সাথে মানুষ জড়িত নেই।
ধর্ষণ এখন মহামারী আকার ধারণ করেছে। দুধের শিশু হতে যৌবনে ভাটাপরা বৃদ্ধাও আজ ধর্ষণের শিকার। ১২ বছরের বালক থেকে শুরু করে সব শ্রেণিপেশার মানুষ হয়ে উঠেছে ধর্ষক! প্রেমিক প্রেমিকাকে, শিক্ষক ছাত্রীকে, এমনকী ভাই বোনকে, বাবা মেয়েকে ধর্ষণের করার মতো নিকৃষ্ট খবরও আমাদের শুনতে হয়। পত্রিকার পাতা উল্টালেই চোখে পরে ধর্ষণের মহা উৎসব! বাংলাদেশের মতো একটি সভ্য দেশেও ধর্ষণের সেঞ্চুরি উপলক্ষে মিষ্টি বিতরণের দৃশ্যও দেখতে হয়েছে! তো একজন মানুষ কতটুকু নিচে নামলে এমন জঘন্য নীতিবিবর্জিত কাজ করতে পারে! চরিত্র কত নিচে নেমে গেছে সেটাই চিন্তার বিষয়। সেই সাথে সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজ বলৎকার বেড়ে গেছে মাত্রাতিরিক্তভাবে!
আল্লাহতায়ালা মানুষকে সত্য ও সুন্দরপথে পরিচালিত করতে বিভিন্ন মাধ্যমে মানুষকে আহ্বান করেছেন। নবী-রাসুলগণের মাধ্যমে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালিত করেছেন। তাঁদের অনুপস্থিতিতে উম্মাহকে এই দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, আল্লাহতায়ালা বলেন, তোমাদের মধ্যে একটি দল থাকা আবশ্যক, যারা (মানুষকে) কল্যাণের পথে আহ্বান করবে, আর সৎকাজের আদেশ দেবে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে। আর তারাই পূর্ণ সফলকাম।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত-১০৪) অপরাধ দমনে ইসলামের এই পদ্ধতি খুবই কার্যকরী। ভালো মানুষগুলো অপরাধীদের নিকট গিয়ে আল্লাহতায়ালার ভয় ও অপরাধের ক্ষতিসমূহ বুঝিয়ে সত্যের পথে ফিরিয়ে আনবেন। আল্লাহতায়ালা যে মানুষকে সর্বশ্রেষ্ঠ করে সৃষ্টি করেছেন এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি কখনো অপরাধের সাথে জড়িত হতে পারে না এটা অপরাধীকে বুঝাতে পারলে আশা করা সে অপরাধ জগৎ থেকে আলোর পথে ফিরে আসবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা সর্বকৃষ্ট উম্মত, তোমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্য, তোমরা (মানুষকে) সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে, আর আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে।’ (সুরা আল ইমরান, আয়াত-১১০)
আমাদের সমাজের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, ছোটখাটো মতানৈক্য ও ঠুনকো বিষয় নিয়ে বেঁধে যায় তুমুল হাঙ্গামা। ভাই হয়ে আঘাত করে ভাইয়ের মাথায়। মুমিনের পবিত্র খুনে লাল করে জমিন। মানুষ হয়ে সর্বসময় কষ্ট দিই মানুষকে। অথচ হুজুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানকে কষ্ট দিল সে আমাকে কষ্ট দিল! আর যে ব্যক্তি আমাকে কষ্ট দিল, সে নিশ্চিতভাবে আল্লাহকে কষ্ট দিল!’ অন্য হাদিসে আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত, হুজুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের ক্ষতি করল অথবা ধোঁকা দিল সে অভিশপ্ত!’ (তিরমিযি)
চুরি-ডাকাতি, কিডন্যাপ (অপহরণ) লুটপাট, চাঁদাবাজি, ইভটিজিং, মাদকসহ প্রতিনিয়ত অপরাধের তালিকা শুধু দীর্ঘায়িত হচ্ছে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বিরামহীন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, পুলিশ-প্রশাসন, সুশীলসমাজ, মানবধিকার সংগঠনসহ সমাজের সব সচেতন নাগরিক! গ্রহণ করা হচ্ছে বিভিন্ন কৌশল। নেওয়া হচ্ছে নানা ধরনের উদ্যোগ। করা হচ্ছে সভা সেমিনারসহ কত সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড। তারপরও প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে নিত্যনতুন অপরাধ! অপরাধ বন্ধ না হওয়ার কারণ হলো অপরাধ নির্মূলের জন্য আল্লাহর দেওয়া ফর্মূলা মানা হচ্ছে না। কোরআনে বর্ণিত বিধান কার্যকর করা হচ্ছে না। আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমারা তাকওয়া অর্জন কর।’ অর্থাৎ আল্লাহর ভয় অন্তরে প্রবেশ কর। কারণ, যার দিলে আল্লাহর ভয় থাকবে তার পক্ষে অপরাধ করা অসম্ভব! আল্লাহ বলেছেন, চুরি করলে হাত কেটে দাও! যিনা করলে দররা (বেত্রাঘাত) মারো! (এই শাস্তি একমাত্র ন্যায়পরায়ণ কাজি দিতে পারবে) অথচ আমরা টাকার (ঘুষ) বদলে আসামিদের সযত্নে ছেড়ে দিচ্ছি।
দুনিয়ার মোহ আর অর্থের লোভ আমাদের পাগল বানিয়ে ফেলেছে। দুনিয়া যে অস্থায়ী এটা আমরা ভুলেই গেছি। অথচ হুজুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুনিয়াতে মুসাফিরের মতো জীবন অতিবাহিত করার তাগিদ দিয়েছেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার আমার দু’কাঁধ ধরে বললেন, ‘তুমি দুনিয়াতে থাক যেন তুমি একজন প্রবাসী অথবা পথচারী।’ আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা.) বলতেন, তুমি সন্ধ্যায় উপনীত হলে সকালের অপেক্ষা করো না এবং সকালে উপনীত হলে সন্ধ্যার অপেক্ষা করো না। তোমার সুস্থতার সময় তোমার পীড়িত অবস্থার জন্য প্রস্তুতি নাও। আর তোমার জীবিত অবস্থায় তোমার মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নাও। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৬৪১৬) কিন্তু আমরা আল্লাহ ও তার রাসূলের কথাকে অগ্রাহ্য করে কুফরী মতবাদের দিকে ধাবিত হচ্ছি। যার ফলে চক্রহারে বেড়েই চলছে নানা ধরনের অপরাধ। তাই আসুন! কোরআন সুন্নাহর দেখানো পথে চলি। সুন্দর ও আদর্শময় জীবন ও দেশ গড়ি! মাদক, চোরাকারবারি, সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলি।
লেখক : শিক্ষার্থী, হাটহাজারী মাদরাসা চট্টগ্রাম