অনুদানপ্রাপ্ত ছবি ও আমাদের চলচ্চিত্র

প্রতীকী ছবি

মুক্তমত

অনুদানপ্রাপ্ত ছবি ও আমাদের চলচ্চিত্র

  • মামুন রশীদ
  • প্রকাশিত ৯ এপ্রিল, ২০২১

করোনার সঙ্গে আমাদের পরিচয় গত বছর মার্চে। ভয়ানক সংক্রমক এই ব্যাধি যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যায়, তাই সেবার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এবার করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে চলছে লকডাউন। করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময়েই লকডাউন শব্দটির সঙ্গে আমাদের পরিচয়। সেই পরিচয়ে ঘরবন্দি অস্থির সময়গুলো কীভাবে কাটানো যাবে, ভয়ের সঙ্গে চিন্তাগ্রস্ত মানুষ তখন সবচেয়ে বেশি পেয়েছে প্রার্থনার উপদেশ। এর বাইরেও সময় কাটাতে বিভিন্ন জন দিয়েছেন নানা পরামর্শ। যেহেতু ঘরে বন্দি, বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। গ্রামাঞ্চলের মানুষের তবু খোলা আকাশ রয়েছে, কিন্তু শহরে তাও সম্ভব নয়। বড় বড় দর-দালানের অধিকাংশেরই ছাদ তালাবদ্ধ। যাদের ভাগ্য প্রসন্ন ছিল, বাড়িওয়ালা উদার হয়েছে— তারা খোলা পেয়েছে ছাদের দরজা। বড় থেকে শিশু বিভিন্ন বয়সের মানুষ তখন ছাদে ঘুড়ি ওড়ানোর মধ্যে খুঁজে নিয়েছিল শৈশব-কৈশোর ও বন্দিত্ব থেকে মুক্তির স্বাদ। যাদের এই সুযোগ ছিল না, তারা নানান উপদেশের সঙ্গে পেয়েছেন চলচ্চিত্র দেখার পরামর্শ। আবার অনেকে, যারা আগ্রহী তারা নিজেরাও খুঁজে নিয়েছেন দেশি-বিদেশি পছন্দের চলচ্চিত্র।

একসময় বিটিভিই ছিল সবার ভরসা। শুক্রবার, সাপ্তাহিক ছুটির দিন, বেলা তিনটায় শুরু হতো চলচ্চিত্র। ছোট-বড় পরিবারের সব সদস্য এক হয়ে বসে তা উপভোগ করতেন। প্রতিবেশী, যাদের বাড়িতে বোকাবাক্স নেই, তারাও আসতেন সেই দিনগুলোতে। তখনকারর দিনগুলো ছিল অপার আনন্দের। রূপকথার মতো এইদিন আজকের শিশু-কিশোরদের অবিশ্বাস্যই মনে হবে। কারো বাড়িতে টেলিভিশন নেই- এ দৃশ্য কেউ আজ কল্পনাও করতে পারবে না। কারণ, একই বাড়িতে আজ একটি তো বটেই কোথাও কোথাও দুই, তিন বা পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের ঘরেই আলাদা টেলিভিশন। ফলে পারিবারিক আবহে, সব সদস্য মিলে চলচ্চিত্র দেখার দিন শেষ। এখন নিজেই নিজের বিনোদন খুঁজে নেওয়ার পালা। দেশে আজ প্রায় দুই ডজনেরও বেশি ব্যক্তিমালিকানাধীন চ্যানেলের পাশে বিটিভির সে জৌলুস নেই। শুধু বিটিভিই বা বলি কেন, আমাদের ব্যক্তিমালিকানাধীন চ্যানেলগুলোরও দর্শকটানার ক্ষমতা কমছে, এরকম খবর তো সংবাদমাধ্যমেরই। অনুষ্ঠানের মানহীনতা, দর্শক রুচি না বোঝার কারণে আমাদের চ্যানেলগুলোর আওয়াজ যখন কমছে, তখন হাজারো সমালোচনা, আমাদের সেঁটে দেওয়া সস্তা অনুষ্ঠানের তকমা নিয়েও প্রতিবেশী দেশের চ্যানেলগুলোর আওয়াজ সন্ধ্যা হলেই প্রতি বাড়ি থেকে ভেসে আসছে।

এমনিতে টেলিভিশন দেখার সময় ও সুযোগ কম। করোনাকালে হাতে অফুরন্ত সময় নিয়ে যখনই টেলিভিশন পর্দার সামনে বসেছি, উঠতে হয়েছে একরাশ বিরক্তি নিয়ে। টিভি রিমোট চেপে চেপে যে চ্যানেলেই পৌঁছাই, প্রতিটিতেই হয় সংবাদ, নয় সংবাদ পর্যালোচনা, নয় টকশো। আর যদিওবা কোথাও নাটক, সিরিয়ালের দেখা মেলে, তাতে চোখ রাখার আগেই শুরু হয় বিজ্ঞাপন, আর শুরুর পর তা আর থামেই না, অজানা সময়ের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে হাতের টিভি রিমোটের বোতামও ঘুরতে থাকে, সেই ঘোরার সময়ে ভুলে যেতে হয় নাটক বা সিরিয়াল চলা চ্যানেলটির নাম। টিভি চ্যানেলের মতো দশা আমাদের বর্তমান চলচ্চিত্রেও। ভালো গল্প, ভালো নির্মাণশৈলী, ভালো অভিনেতার অভাবে মুখ থুবড়ে পড়ছে এই শিল্পটি। মানুষ তার হাতের টিভি রিমোটের সঙ্গে খুলে নিয়েছে অন্তর্জালের দুনিয়াও। বোকাবাক্স মন ভরাতে পারছে না? কোনো সমস্যা নেই। হাতের মুঠোয় রয়েছে ইউটিউব। মুহূর্তেই খুঁজে দেখা যেতে পারে পছন্দের চলচ্চিত্র। তাতেও মন ভরলো না, তাহলে আরো আছে নেটফ্লিক্স। এই দরজা দিয়ে যে কোনো দেশের যে কোনো ভাষার চলচ্চিত্রের অফুরন্ত ভান্ডার চলে এসেছে হাতের মুঠোয়। আর ওয়েব সিরিজ তো রয়েছেই। তার মানে বাইরের দর্শক তো বটেই, আমাদের দর্শকও টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। তার মুখ ফিরিয়েছে আমাদের নির্মিত অনুষ্ঠান ও চলচ্চিত্র থেকে। অথচ এক্ষেত্রে আমাদের সম্ভাবনার কমতি ছিল না। এখনো কমতি নেই। রয়েছে বড় বাজারও। এই বাজার ধরতে, গতি ও প্রযুক্তির এই দুনিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিতে হলে, আমাদেরও এগুতে হবে। আমাদেরও লক্ষ্য স্থির করতে হবে। আমাদের দর্শকশ্রেণি কারা, কাদের জন্য তৈরি হচ্ছে চলচ্চিত্র— নির্মাণের আগেই তা ঠিক করে নিতে হবে।

একসময় দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলাতেই ছিল সিনেমা হল বা প্রেক্ষাগৃহ। আজ অনেক জেলা-উপজেলাতেই সিনেমা হলের দেখা পাওয়া মুশকিল। কোথাও কোথাও শুধু নামটিই টিকে রয়েছে। সিনেমা হলের নামে টিকে থাকা জায়গাটিই আজ স্মৃতি। বাজার সংস্কৃতির যুগে, যখন লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বাড়ছে সবকিছুর। জমি কমতে থাকায় তার দাম তো আকাশচুম্বী হবেই। প্রতিটি সিনেমা হলের অবস্থান জেলা অথবা উপজেলার কেন্দ্রে। সেসব স্থানের মূল্য সাধারণ তো দূরের, অনেক অসাধারণেরও আজ ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর যিনি ছুঁতে পারবেন, তার ইচ্ছে থাকলেও তা ধরার সুযোগ নেই, জমির স্বল্পতাহেতু। একসময় যে সিনেমা হলগুলো ছিল ব্যবসাসফল, হল মালিকরা প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন ছবি এনে চালিয়ে মুনাফার মুখ দেখেছেন। তারা আজ সিনেমা আনছেন না, কারণ— দেখানোর মতো, হলে দর্শক টানার মতো ছবি তৈরি হচ্ছে না। আর যেগুলো তৈরি হচ্ছে, সেগুলোর জন্য ‘টার্গেট পিপল’ বলে বাজার অর্থনীতিতে যে শব্দটি রয়েছে, তা মেনে তৈরি হয়নি। ফলে এগুলো দর্শক টানতে ব্যর্থ হচ্ছে। এতে করে ক্রমাগত লোকসানের মুখে থাকা হল মালিকরা বন্ধ করে দিচ্ছেন তাদের প্রেক্ষাগৃহ। আর বর্তমানে সেসব স্থানে নির্মিত হচ্ছে বহুতল ভবন। চালু হচ্ছে শপিং কমপ্লেক্স, যা অনেক বেশি লাভজনক। যা মালিকদের হুমকির মুখে ফেলবে না, তাকে পথে বসাবে না। তাই সারা দেশে একের পর এক বন্ধ হচ্ছে সিনেমা প্রদর্শনের হল বা প্রেক্ষাগৃহগুলো। হলের মালিকরা ভবনগুলো ভেঙে ফেলে বহুতল বিপণিবিতান গড়ে তুলছেন। মানসম্মত চলচ্চিত্রের অভাবেই হলবিমুখ আজকের দর্শক, যা সিনেমা হলের ব্যবসাতেও ডেকে এনেছে মন্দা। অথচ নব্বইয়ের দশকের শুরুতেও যেখানে সারা দেশে প্রায় দেড় হাজার সিনেমা হল ছিল, এখন তা কমতে কমতে নেমে এসেছে শতকের ঘরে। এমনকি সাম্প্রতিক সময় তো বটেই, নিকট অতীতেও নতুন হল নির্মাণের খবর শোনা যায়নি। এর পেছনে হল মালিকদের অনাগ্রহ নয়, বরং হল চালানোর মতো চলচ্চিত্র না থাকাই বহুলাংশে দায়ী। একটি শো চালানোর খরচ, প্রতি মাসে একটি হলের রক্ষণাবেক্ষণ, কর্মকর্তা- কর্মচারীদের বেতনের পর হল মালিকের টিকে থাকার জন্য ন্যূনতম মুনাফার জোগান যদি প্রদর্শিত চলচ্চিত্র এনে দিতে না পারে, তাহলে হল মালিক কোন ভরসায় প্রতিদিন লোকসানের খাতা বাড়াবেন?

এই যে বলছি, হলে ছবি চলছে না, তার মানে কি দর্শক চলচ্চিত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে? তা তো নয়, যদি তা-ই হতো তাহলে সারা বিশ্বে চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের খবর আসতো না। বলিউডের মুভি আমাদের দর্শকদের টানে, ভিসিআর ভিসিপির স্বর্ণযুগের কথা যদি ভুলেও যাই, তারপরও বর্তমানে যে কোনো ব্যবসা সফল বলিউডের মুভি আমাদের দর্শকরাও দেখছেন। আবার হলিউডের নামকরা মুভি তো বটেই, অন্যান্য মুভির দর্শকও ঈর্ষা জাগানিয়া। ইরানি চলচ্চিত্র? চাইনিজ বা ইউরোপের মুভির সঙ্গে গত কয়েক বছরে সামনে চলে এসেছে কোরিয়ান চলচ্চিত্র। এমনকি শুনতে খারাপ লাগলেও হালে পাকিস্তানি চলচ্চিত্রের যে অগ্রযাত্রা, গল্প এবং নির্মাণশৈলীর দক্ষতা তাও দর্শকের আগ্রহ তৈরি করছে। 

এই যে এত কথা, এই কথাগুলো বলার পেছনের কারণ— অনেকদিন হলে বসে চলচ্চিত্র দেখা হয়নি। করোনাকালের এই সময়েও, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে, একটু সাহস করেই প্রেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্র দেখার আগ্রহ জন্ম নেয়। হল ব্যবসার মন্দা সময়েও, যারা হলের জায়গায় বহুমুখী বাণিজ্যিক ব্যবহারের পরেও, ভালোবেসে হল ব্যবসাকে টিকিয়ে রেখেছেন, তেমনই একটি প্রেক্ষাপটে অনুদানপ্রাপ্ত একটি চলচ্চিত্র দেখার আগ্রহ নিয়ে এক সন্ধ্যায় টিকিট কাটলাম। চলচ্চিত্র শুরুর আগে আগে হলে ঢুকে ভড়কেই গেলাম, শুনশান পুরো হল, মাথা গুনে পেলাম আমিসহ ছয়জন। সেই ছয়জনও প্রচণ্ড বিরক্তি এবং হতাশা নিয়ে গিলতে বাধ্য হলাম অনুদানপ্রাপ্ত সেই চলচ্চিত্র। মাঝখান থেকে হারিয়ে গেল মূল্যবান সময় ও কষ্টের টাকা। পুরো চলচ্চিত্র দেখার পরেও কোনো ধারণা জন্মালো না, কেন ও কী উদ্দেশ্যে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা হয়েছে? গল্পে কী বোঝাতে চেয়েছে? আর ছবির নির্মাণশৈলী, তাকেও কোনো মাপে ফেলার উপায় ছিল না। এত ঝাপসা প্রিন্ট, যা চলচ্চিত্র দেখার আগ্রহই কমিয়ে দেয়।

বিভিন্ন সময়ে বিখ্যাত অনেক উপন্যাস অবলম্বনেই বাংলাদেশে অনেক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তার অধিকাংশই অনুদানপ্রাপ্ত। সেগুলোর নির্মাণ তো আজো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে। গল্প এবং নির্মাণ দুই মিলে চলচ্চিত্রের যে ধারার মধ্য দিয়ে আমাদের চলচ্চিত্র এগুতে শুরু করেছিল, তা যেন আজ থমকে গেছে। প্রতিযোগিতা তো নেই-ই, মনে হয় আমরা নিজেকেও নিজে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা ছেড়ে দিয়েছি। এ অবস্থা চলতে থাকলে শুধু চলচ্চিত্র নয়, সব ক্ষেত্রেই আমাদের পিছিয়ে পড়া শুরু হবে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের মধ্যেই শুধু আটকে থাকব আমরা। মেধার দুনিয়ায় আমাদের পিছিয়ে পড়া, অতীতের স্মৃতি হাতড়ানোর বাইরে আর কোনো নতুন পথ খুলবে না।

ঘরে ঘরে স্যাটেলাইট টিভির বিস্তার আর ভিডিও পাইরেসির কারণে সিনেমা হলের কদর কমছে এমন বলার সুযোগ কিন্তু আমাদের সামনে খুব কম। কারণ, আমাদের চেয়েও উন্নত দেশগুলোতে যদি এক একটি চলচ্চিত্র মুক্তির পর মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করতে পারে, তাহলে আমাদের দর্শকরা কেন চলচ্চিত্র দেখবে না? তারা তো বিদেশি চলচ্চিত্র ঠিকই দেখছে, তাদের পছন্দ তালিকা বিবেচনা করেই তো সংবাদপত্রগুলো এখনো বিদেশি চলচ্চিত্রের খবর, চলচ্চিত্র জগতের নায়ক-নায়িকাই শুধু নয়, নামি পরিচালকদের খবরও পরিবেশন করে। দর্শক আগ্রহ না থাকলে, কোন পাঠকের জন্য সংবাদপত্রগুলো এসব পরিবেশন করে? বড়পর্দায় চলচ্চিত্র দেখার আগ্রহ মানুষের কমবে না, কমেওনি। পার্শ্ববর্তী দুই তিনটি দেশে যাওয়ার সুবাদে সেসব স্থানের প্রেক্ষাগৃহে যাওয়ারও সুযোগ হয়েছে। সেখানে বড়পর্দায় চলচ্চিত্র দেখার অভিজ্ঞতা থেকেই মনে করি, আমাদের দর্শকও হলবিমুখ নয়। আমাদের সম্ভাবনারও কমতি ছিল না, এখনো কমতি নেই। রয়েছে বড় বাজারও। প্রয়োজন শুধু ভালো গল্প ও নির্মাণ, যা এই শিল্পের ধস ঠেকাবে। এজন্য প্রয়োজন উদ্যোগ এবং সঠিক মানুষ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads