মো. বিপ্লব আলী
বাংলার মন্বন্তর বা ১৯৪৩ সালে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের ফলে দেশের জনগণ অর্থিক সংকটে জীবন অতিবাহিত করেছিল। দেশে খাদ্যের মহাঘাটতি, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও অর্থনৈতিক মন্দার ফলে বাংলার জনজীবনও অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। তৎকালীন সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা ও জাপান কর্তৃক বাংলাদেশ আক্রমণের যে জল্পনা-কল্পনা চলছিল তাতে বাংলাদেশে ঔপনিবেশিক শাসক কর্তৃক বাংলার ধন-সম্পদ কুক্ষিগত হয় এবং তা নিজেদের স্বার্থ হাসিলে ব্যবহার করা হয়। যুদ্ধকালীন অর্থনৈতিক অবস্থায় কিছু মানুষের হাতে পয়সা জমে যায়। এরপর বাজারে পণ্যের দাম বাড়তে থাকলে একটা বিশাল জনগোষ্ঠী তখন খাবারের ব্যবস্থা করতে পারে না। এসব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চাল কেনার ক্ষমতা থাকে না জনগণের একটি বড় অংশের, আর তখন বাংলাদেশের জনগণের মধ্য দুর্ভিক্ষ নেমে আসে যা ইতিহাসে বাংলার মন্বন্তর নামে পরিচিত।
একইভাবে বাংলাদেশের জনগণ একটি মহাসংকটে জীবন অতিবাহিত করছে। বর্তমানে যে সংকট আমরা মোকাবিলা করছি তা হল করোনা ভাইরাস মহামারী। এটি শুধু বাংলাদেশেই নয় সারা বিশ্বে প্রকট আকার ধারণ করেছে যা বাংলাদেশ নেমে এসেছে অর্থনৈতিক সংকট, শিক্ষা সংকট, খাদ্য সংকট বেকারত্বর সমস্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি ক্ষেত্রে। উপরোক্ত সংকটগুলোর মধ্য বর্তমানে শিক্ষা সংকট সবচেয়ে বেশি প্রকট আকার ধারণ করেছে। প্রায় ১৫ মাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একেবারে বন্ধ থাকায় দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সংকটের মুখে। লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীর স্বপ্নভরা বুক আজ নির্মম পরিহাস। যেখানে শুধুই হতাশা আর অসহায়ত্তের স্বীকার। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষা হওয়ার কথা থাকলেও করোনা মহামারীর করণে এখন পর্যন্ত তা হয়নি। এতে করে শিক্ষার্থীরা অনিশ্চিত গন্তব্যের পথে ধাবিত হচ্ছে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা তিন স্তরবিশিষ্ট— প্রথমিক স্তর, মাধ্যমিক স্তর এবং উচ্চশিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়। দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রথমিক শিক্ষার্থীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেশে দিন দিন শিশুশ্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে ও শিশুর মানসিক বিকাশে ব্যাঘাত ঘটছে। কেননা দেশে অধিক সংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করছে এই করোনাকালে। করোনা মহামারিতে যে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার বাতাস বইছে, তা থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়। দীর্ঘদিন যাবৎ ক্লাসের বাইয়ে থাকায় অনেক শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মনোযোগ দেয়ার সামর্থ্য নেই শুধু আর্থিক সংকটের কারণে। অনেক পরিবারের রোজগারের ব্যক্তিটি হয় কর্ম হারিয়েছে, নয়তো অর্ধেক মজুরিতে কাজ করতে হচ্ছে। অনেকে ক্ষেত্রে আবার বেতন বকেয়া রয়ে গেছে মাসাধিককাল। এতে করে শিশুর মনস্তাত্ত্বিক চিন্তার ব্যাঘাত ঘটতে থাকে। মাধ্যমিক পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মেয়েরা। কেননা দেশে আগের তুলনায় বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অধিকাংশ পরিবার এই করোনাকালে শিক্ষার দিকে অগ্রসর না হয়ে মেয়ের বিয়ে দিয়ে আর্থিক সংকট থেকে নিজে ও মেয়েকে বাঁচাতে সচেষ্ট হচ্ছে। এ অবস্থায় বাল্যবিয়ে ও বিয়ে বিচ্ছেদের মতো সামাজিক সমস্যা দিন দিন করোনাকালীন সময়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
যদিও সরকার বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশকে প্রযুক্তিনির্ভর দেশে রূপান্তরিত করেছে। এতে করে অনলাইনে শিক্ষা বিস্তার ও প্রযুক্তি দক্ষতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে দেশের সব শিক্ষার্থী অনলাইনে ক্লাসের অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় শিক্ষা খাতে সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। কেননা দুর্বল নেটওয়ার্ক প্রন্তিক এলাকা ও স্মার্টফোন ক্রয়ের সক্ষমতা না থাকায় দেশের সব শিক্ষার্থী এই অনলাইন ক্লাসের আওতায় আসতে পারছে না। এদিকে দেশের উচ্চশিক্ষা সবচেয়ে বেশি বিড়ম্বনার জালে আবদ্ধ আছে। উচ্চশিক্ষার লাখ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনায় মনোযোগ না দিয়ে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত হয়েছে। এর ফলে শিক্ষার প্রতি বিষণ্নতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে বিসিএস ছাড়া সরকারি অন্যান্য চাকরির সার্কুলার প্রায় নেই বলেই চলে। সবমিলিয়ে করোনাকালে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বিড়ম্বনায় পথ হারাতে বসেছে যেন। তাই শিক্ষার মান ধরে রাখতে এবং সব স্তরের শিক্ষার্থীদের যথাযথ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন এবং তাদের প্রদর্শিত ফর্মুলা দিয়ে এই করোনা সংকটে শিক্ষাব্যবস্থা পুনরুদ্ধারে কাজ করার বিকল্প নেই।
লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী