সম্পাদকীয়

অনিবার্য বিপ্লব ও শিক্ষাঙ্গনের ভবিষ্যৎ 

  • ''
  • প্রকাশিত ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

মুহাম্মদ তাফহীমুল ইসলাম: 

এক যুগের বেশি সময় রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন শক্তি কর্তৃক ভিন্ন মত পোষণকারী নাগরিকদের অধিকার হরণের পর সম্প্রতি বাংলাদেশে এক অনিবার্য বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। এই বিপ্লবের মাধ্যমে দেশে এক বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। এই পরিবর্তনের কথা বলতে গিয়েই এর আগে অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, নির্যাতিত, নিপীড়িত হয়েছেন। পরিবর্তনের কথা বলতে গিয়েই অসংখ্য মানুষ মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কারাগারের নির্জন চার দেয়ালে মানবেতর সময় কাটিয়েছেন।

এত ত্যাগ, বিসর্জনের পরও কোন রাজনৈতিক শক্তির নেতৃত্বে এই বিপ্লব সংঘটিত হয়নি। এই বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে দেশের জীবনবাজি রাখা কতিপয় দামাল শিক্ষার্থীর সাহসী ও দূরদর্শী নেতৃত্বের মাধ্যমে। শুধুমাত্র এই বিপ্লবে নয়, মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে এদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন, সংগ্রামে শিক্ষার্থীরা বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে বারবার। এই বিপ্লবেও পুলিশের বন্দুকের নলের সামনে রংপুরের দামাল শিক্ষার্থী আবু সাইদের বুক টানটান করে দাঁড়িয়ে যাওয়ার দৃশ্য সারা পৃথিবীর মানুষ দেখেছে। শুধু আবু সাইদ নয়, এমন অসংখ্য আবু সাইদ ভয়কে জয় করে বন্দুকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে জাতির এই আরাধ্য বিজয় অর্জিত হয়েছে।

কোন মানুষ যেমন মেরুদন্ড ছাড়া সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। একইভাবে কোন জাতিও শিক্ষা ছাড়া উন্নত হতে পারে না। তাই শিক্ষাকে জাতির মেরুদন্ড বলা হয়। বর্তমান বিশ্বে আমাদেরকে উন্নত জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে অবশ্যই শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। কোন এক বিখ্যাত মনীষী বলেছেন, যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সে জাতি তত বেশি উন্নত। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী একমাত্র বাংলাদেশী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বতীকালীন সরকার বর্তমানে দেশ পরিচালনা করছেন। নতুন সরকার দেশের বিভিন্ন সেক্টরে সংস্কার সাধনের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছেন। শিক্ষাক্ষেত্রেও সংস্কার সাধন করা হবে বলে সরকার প্রধান ঘোষণা দিয়েছেন। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি শিক্ষাঙ্গনেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংযোজন, বিয়োজন করা জরুরী হয়ে পড়েছে। আমার ধারণা, ড. মুহাম্মদ ইউনুস সাহেবের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের আমলই শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর উত্তম সময়। কারণ অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বের নামকরা সব শিক্ষায়তন এবং শিক্ষার ব্যাপারে তার বিস্তর ধারণা, অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি চাইলে শিক্ষা কমিশন গঠন করে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে একটি শক্তিশালী কাঠামোর উপর দাঁড় করাতে পারেন। 

আমাদের দেশে এতদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুষ্ঠু পরিবেশের অন্যতম অন্তরায় হিসেবে কাজ করেছে ছাত্র রাজনীতি। বিশেষ করে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্র রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা এবং ব্যানারে এতদিন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের অনেকটা জিম্মি করে রাখা হয়েছিল। যখন যেই সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে সেই সরকারের আজ্ঞাবহ ছাত্র সংগঠন এই কাজ করেছে। এমনও দেখা গেছে, ক্লাস চলাকালে ছাত্র সংগঠনের নেতারা ক্লাস স্থগিত করে শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক মিছিলে নিয়ে গেছেন। তাদের সেই হস্তক্ষেপের বিপরীতে শিক্ষকরা পর্যন্ত প্রতিবাদ করতে পারতেন না। কোন কোন শিক্ষক সাহস করে প্রতিবাদ করতে গেলেও তাদের উপর নেমে আসতো নির্যাতনের খড়গ। একদিকে পাঠদান চলছে, অন্যদিকে ক্লাসের বাইরে অনতিদূরে ছাত্র সংগঠনের নেতারা স্লোগান দিচ্ছেন। এমন অবস্থায় শিক্ষার্থীরা মারামারির ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি পাঠদানে চরমভাবে ব্যাঘাত ঘটতো। কখনও কখনও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মারামারি, এমনকি খুনের ঘটনাও ঘটেছে। এভাবে ছাত্র রাজনীতির সাইনবোর্ড ব্যবহার করে একটি চক্র দিনের পর দিন শিক্ষাঙ্গনগুলোকে অস্থিতিশীল করে রেখেছে। শিক্ষাঙ্গন থেকে ছাত্র রাজনীতি ও মুক্ত বুদ্ধি চর্চার নামে এসব কার্যকলাপের কবর রচনা করা কিংবা তা নিয়ন্ত্রণ করা এখন সময়ের দাবি। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেল, ছাত্রাবাসে ছাত্র রাজনীতির পরিচয় ব্যবহার করে সীট বাণিজ্য, শিক্ষার্থীদের হয়রানিসহ যাবতীয় অনিয়ম দূর করে হলে হলে লেখাপড়ার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে দিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। 

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস থেকে ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দের কক্ষ থেকে অস্ত্র, কিরিচ, রামদা, হকিস্টিকসহ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধারের ছবি, ভিডিও গণমাধ্যমের সহযোগিতায় দেশবাসী দেখেছে। এই ছবি, ভিডিওগুলো দেখে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরাও আতঙ্কিত হয়ে যাওয়ার কথা। এসব দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র দেখলে মনে হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন একেকটি সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য। যেন চোর ডাকাতদের ভুতুড়ে বাড়ি। অথচ সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরাই বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া সুযোগ পায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিয়মিত অধ্যায়নের পাশাপাশি লাইব্রেরীতে স্টাডি করবে, গবেষণা করবে, বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবে, উচ্চ শিক্ষার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিপরীতে কে বা কারাই তাদেরকে বিপথগামী করে ভুল পথে নিয়ে যায়। কারা তাদের হাতে খাতা, কলম বাদ দিয়ে মানুষ মারার অস্ত্র তুলে দেয়। কারা তাদের মাদক সেবনে উৎসাহিত করে। এই শিক্ষার্থীদের বিপথগামী করতে যারা নেপথ্যনায়কের ভূমিকায় থাকেন, প্রয়োজনে শিক্ষাঙ্গনে সেসব রাজনীতির নামে দুর্বৃত্তায়ন নিষিদ্ধ করা উচিত। তবুও যেন শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার সুষ্ঠু ও উপযুক্ত পরিবেশ পায়। অথবা এমন কঠোর শাস্তির বিধান  করা উচিত, শিক্ষাঙ্গনে যাতে কেউই দুর্বৃত্তায়নের দুঃসাহস না দেখায়। এমন শাস্তির বিধান থাকলে তা প্রয়োগ করা উচিত। 

আজকের শিশুরা তথা শিক্ষার্থীরা আগামীর ভবিষ্যৎ। এখন যারা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়ন করছে তারাই আগামী বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিবে, কর্ণধার হবে। সুতরাং আগামীর বাংলাদেশের ভিত্তি মজবুত ও সুদৃঢ় করতে হলে এখনকার তরুণ, যুবকদেরকে এখন থেকেই দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। খুশির কথা হচ্ছে, বর্তমান প্রজন্ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার। তারা নৈতিকতা বিরোধী সিদ্ধান্ত মানতে চায় না। সম্প্রতি সারাদেশের মানুষ দেখেছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীরা ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন, সরকারি স্থাপনা পাহারা দেওয়া, মন্দির পাহারা দেওয়া, পরিচ্ছন্নতা অভিযান থেকে শুরু করে অনেক জনসেবামূলক কাজে হাত দিয়েছে। এমনকি চলমান রাষ্ট্র সংস্কারের পরিবেশও সৃষ্টি হয়েছে এই শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বেই। তারুণ্য এবং শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হিসেবে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ আজ দেশ পরিচালনার গুরুদায়িত্বে নিয়োজিত আছেন। যা অত্যন্ত আশাজাগানিয়া খবর। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এই তরুণদের চিন্তা, চেতনা বেশ উন্নত। কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক শুধু নয়, সারাদেশেই প্রশাসন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সাথে সমন্বয় করছে। শিক্ষার্থীরাও প্রশাসনকে সহযোগিতা করছে। সাধারণ মানুষ শিক্ষার্থীদের প্রতি আস্থা রাখছে। শিক্ষার্থীরা যেন আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে। যারা বৈষম্যের বিরুদ্ধে জীবন বিলিয়ে দিতে পারে সেই দেশপ্রেমিক তরুণ, যুবকদের হাতে দেশের দায়িত্ব অর্পিত হলে, সেই দেশ পথ হারাবে না।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী 
বাঁশখালী, চট্টগ্রাম 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads