তথ্যই জ্ঞান। জ্ঞানই শক্তি। গণমাধ্যম জনগণকে শিক্ষিত করে এবং সর্বশেষ তথ্য সংগ্রহ ও প্রচারের মাধ্যমে তাদের বুদ্ধিমান করে। গণমাধ্যম জনগণকে স্থানীয় ও বিশ্বব্যাপী জানায় এবং তাদের ক্ষমতা প্রদান করে। এ কারণে গণমাধ্যমকে বিশ্বের জনগণের ক্ষমতার উৎস বলা হয়। মুদ্রণ ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের দ্বারা সর্বশেষ খবর পাওয়ার মাধ্যমে মানুষ রাষ্ট্রের ক্ষমতার উৎস হয়ে ওঠে। দেশের সমস্যা ও সমাধান, জনগণের চাহিদা ও দাবি পূরণ, গণতন্ত্র ও সুশাসন কীভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারা যায়, তা গণমাধ্যম সরকারকে জানাতে সাহায্য করে। এরই পাশাপাশি এই একুশ শতকে এগিয়ে চলেছে অনলাইন গণমাধ্যম। কিন্তু গণমাধ্যমের মূল উদ্দেশ্য পূরণে এটি কতটুকু সমর্থ?
গণমাধ্যমের দ্বারা উঠে আসছে প্রান্তিক কৃষকের সফলতার খবর থেকে উচ্চপদস্থ কর্মকতার অনিয়ম, দুর্নীতি কিংবা রাজনৈতিক নেতাদের দুঃশাসন, প্রশাসনের স্বেচ্ছারিতাসহ সব কিছুই। এই সংবাদ পাঠের মধ্য দিয়েই কি তার মূল্য শেষ হয়ে যাচ্ছে? কখনোই নয়। বরং গণমাধ্যম কাজ করছে হাতিয়ার হিসেবে। যখনই একটি ইস্যু গণমাধ্যমে আসছে, তা সমাধান ও উত্তরণের বিষয়ে সুযোগ তৈরি হচ্ছে। যার ফলে গণমাধ্যমকে অতি গুরুত্বপূর্ণ আনুষঙ্গিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যারা গণমাধ্যমে কাজ করেন, তাদেরও বিশেষ সম্মানের চোখে দেখা হয়। যেসব গণমাধ্যম সত্য, নিরপেক্ষ সংবাদ সংগ্রহ, প্রচার ও পরিবেশন করে থাকে, নিঃসন্দেহে তারা শুধু আয় নয়, বরং সমাজ বিপ্লবের অংশীদার হতেই কাজ করে।
মূলধারার গণমাধ্যম যেমন টেলিভিশন, রেডিও ও প্রিন্ট পত্রিকার পাশাপাশি বর্তমানে অনলাইন গণমাধ্যম বেশ অগ্রগামী। অনলাইন পোর্টাল হলেও কিছু কিছু অনলাইন গণমাধ্যম মূলধারার গণমাধ্যমকেও ছাপিয়ে গেছে। জনপ্রিয়তা, সংবাদ পরিবেশনে সূক্ষ্মতা কিংবা দায়িত্বশীলতার দিক দিয়ে সকলের ঊর্ধ্বে। এসব অনলাইন গণমাধ্যমকে প্রতিষ্ঠিত করতে বাংলাদেশ সরকার নবম ওয়েজ বোর্ডের মাধ্যমে অনলাইন গণমাধ্যমকে নিবন্ধনের আওতায় এনেছেন। নিঃসন্দেহ এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। সব অনলাইন গণমাধ্যম এই সুযোগ হয়তো পাবে না; কিন্তু সুযোগের জন্য যে মানদণ্ড দরকার তার জন্য হয়তো অনেকেই অনলাইন গণমাধ্যমকে বিচ্ছিন্নভাবে পরিচালনা করবেন না। কৈফিয়তের জায়গা তৈরি করতে পারলে অনলাইন গণমাধ্যমও সঠিক, সত্য ও তথ্যবহুল সংবাদ পরিবেশনের দিকে নজর বাড়াবে।
অনলাইন গণমাধ্যমে যারা কাজ করেন, তারা কি সাংবাদিক? কিছু জনপ্রিয় অনলাইন গণমাধ্যমকে নিবন্ধন দেওয়ার পর এরকম প্রশ্ন উঠেছিল। নিবন্ধনের মাপকাঠিতে অনলাইন গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা তাদের বৈধ পরিচয়পত্র পাচ্ছে। সে হিসেবে অবশ্যই তারা সাংবাদিক। বাকি যারা অনিবন্ধিত রয়েছে, তাদের সাথে যেসব সংবাদকর্মী কাজ করছেন, তারা ওই অর্থে সাংবাদিক না হলেও সাংবাদিকতা চর্চার মধ্যদিয়ে এগোচ্ছে যা তাদের সাংবাদিকতা শেখাকে উৎসাহিত করছে। তাই বলা যেতেই পারে, সাংবাদিকতা শেখার অনবদ্য প্ল্যাটফর্ম ‘অনলাইন গণমাধ্যম’।
যোগ্যতার ঘাটতি ও অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে অনেকেই মূলধারার গণমাধ্যমে কাজের সুযোগ পাচ্ছে না। তারা ঝুঁকছে অনলাইন গণমাধ্যমে। এটির অনেক ইতিবাচক দিক রয়েছে। প্রথম কথা হচ্ছে, তারা শিখতে পারছে যে কীভাবে সংবাদ সংগ্রহ করতে হয়, কীভাবে সংবাদ লিখতে হয়, কীভাবে তা পরিবেশন করতে হয়। অনলাইন গণমাধ্যমের দ্বারা শেখার মাধ্যমে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মূলধারার গণমাধ্যমে কাজের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। এজন্য পড়তে হচ্ছে না সাংবাদিকতা বিষয় নিয়ে। নতুন কিছু শেখার ইচ্ছে, সাংবাদিকতার আগ্রহবোধ ও দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে কাজ করলে অনলাইন গণমাধ্যমের দ্বারাও প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব। একজন আগ্রহী ব্যক্তিকে সাংবাদিক হিসেবে কাজের সুযোগ করে দেওয়ার মাধ্যমে যে শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করছে অনলাইন গণমাধ্যম তা সত্যই প্রশংসনীয়।
দেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে অনলাইন গণমাধ্যম। কিন্তু কজন মানদণ্ডের ভিত্তিতে কাজ করছেন? এমনও অভিযোগ আছে, অনলাইন গণমাধ্যম চালু করে প্রতিনিধি নিয়োগের নামে আয় করছে হাজার হাজার টাকা। সারা দেশ থেকে প্রতিনিধি নিয়োগবাবদ পাঁচশ, একহাজার, দুহাজার টাকার বিনিময়ে আইডি কার্ড দেওয়া হচ্ছে। আবার সময়মতো উধাও হয়ে যাচ্ছে তারা। খুঁজে ফিরছে অন্য গ্রাহককে। শুধু অনলাইন গণমাধ্যমের মালিকরা যে এসব করছে, তাও নয়। টাকা দিয়ে কার্ড নিয়ে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে চাঁদাবাজিতেও লিপ্ত কতিপয় সাংবাদিক। সংবাদ প্রকাশের নাম করে হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা। একজন ব্যক্তির অপরাধ সংশ্লিষ্টতা দেখে পত্রিকায় প্রকাশের ভয় দেখিয়ে টাকা নিয়ে সে বিষয় ধামাচাপা দিচ্ছে। এই ধরনের অপসাংবাদিকতার কারণে অনলাইন গণমাধ্যমসহ মূলধারার গণমাধ্যম হুমকির মুখে। এটির নিয়ন্ত্রণে নজর দিতে পারলে এ ক্ষেত্রটা আরো পরিশীলিত হবে।
মূলধারার গণমাধ্যমগুলোর আয়ের সুযোগ আছে। তারা বিভিন্ন কোম্পানির অন্তর্ভুক্ত। বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে তারা এই গণমাধ্যম ব্যবসাকে পরিচালিত করে। বিপরীতে অনলাইন গণমাধ্যমগুলো ব্যক্তিমালিকানায় তৈরি হয়ে থাকে। এদের আয়ের একমাত্র পথ ‘গুগল অ্যাডসেন্স’। যারা মানদণ্ড বজায় রাখতে পারে, তারা ‘গুগল অ্যাডসেন্স’ থেকে আয় করার মাধ্যমে বিনিয়োগকৃত পরিশ্রমের পারিশ্রমিক হাসিল করতে পারেন। কিন্তু যারা এ বিষয়ে অনভিজ্ঞ, তারা অনলাইন গণমাধ্যমকে পুঁজি করে চাঁদাবাজি, ভাঁওতাবাজিসহ অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ে। যার কারণে বেড়ে চলেছে হলুদ সাংবাদিকতা। ব্যক্তিবিশেষের এজেন্ডা বাস্তবায়নেও গড়ে উঠছে ভুঁইফোঁড় অনলাইন পোর্টাল। শুধু নিজের গুণকীর্তন প্রচারের জন্য করছে এই অনলাইন পোর্টাল। এটি গণমাধ্যমের জন্য হুমকিস্বরূপ।
দেশের অনলাইন গণমাধ্যমকে শুধু নিবন্ধনের আওয়াভুক্তকরণ নয়, বরং মনিটরিংয়ের আওতাভুক্ত করা সময়ের দাবি। তবে হস্তক্ষেপ করে তা কুক্ষিগত করার মতো পরিবেশ তৈরি করা যাবে না। বরং উৎসাহ দিতে হবে যাতে তারা সেসব সংবাদকে গুরুত্ব দেয় যা মূলধারার গণমাধ্যমে জায়গা পায় না অথচ গুরুত্বপূর্ণ। সেই লক্ষ্যে এক বা একাধিক মানদণ্ড নির্ধারণ করে দেওয়া যেতে পারে এবং কে বা কারা অনলাইন গণমাধ্যম চালু করতে পারবে, তারও একটি সিস্টেম তৈরি করতে হবে। অনুমোদনের মাধ্যমে অনলাইন গণমাধ্যমের যাত্রা শুরু হলে এর দ্বারা সংঘটিত অনৈতিক কাজগুলো বন্ধ হবে।
অনলাইন গণমাধ্যমের দ্বারা অনেকের সাংবাদিকতার হাতেখড়ি ঘটছে। মূলধারার গণমাধ্যমে প্রবেশের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। তাই এটির পরিচর্যা করতে হবে। একটি গাইডলাইনের মাধ্যমে অনলাইন গণমাধ্যমগুলো পরিচালনা করা সম্ভব হলে এ বিষয়ে অগ্রসর হওয়া সম্ভব। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক এবং গণমাধ্যম ব্যবস্থাপনা ও অর্থনীতির কথা বিবেচনায় রেখে আর কোনো খণ্ড খণ্ড নীতিমালা প্রণয়ন না করে একটি সমন্বিত গণমাধ্যম নীতিমালা প্রণয়ন একান্ত আবশ্যক। এ নীতিমালার অধীনে সরকারি, বেসরকারি ও কমিউনিটি মালিকাধীন সব খাতের মাধ্যম পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা থাকতে হবে। তাহলেই তো প্রকৃত গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মী সৃষ্টির পথ উন্মুক্ত হবে।
মোহাম্মদ অংকন
লেখক : প্রাবন্ধিক
md.angkon12@gmail.com