মহানগর

অদৃশ্য ইশারায় চলছে দুদক!

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ২০ মে, ২০২১

দেশের স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। সরকারের নীতিনির্ধারকরা স্বাস্থ্য খাতকে যতই সফল বলে দাবি করুন না কেন, এর পরতে পরতে জেঁকে বসেছে দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা। একে একে থলে থেকে বেরিয়ে পড়েছে বেশ কিছু বিড়াল। তবে এ থলের মালিক কে, তা কেউ জানে না। এই দুর্নীতি বন্ধে নেওয়া হয় না কঠোর পদক্ষেপ। ফলে এ দুর্নীতি প্রভাব বিস্তার করেছে দেশের ক্ষুদ্র ওষুধের দোকান, চিকিৎসক, হাসপাতাল, অধিদপ্তর থেকে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত।

এদিকে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর মাঝে মাঝে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একটু নাড়াচড়া দিলেও কয়েকদিন পর তাও থমকে যায়। সম্প্রতি স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি নিয়ে দুদক বেশ কিছু অভিযোগের অনুসন্ধান তদন্ত কাজ শুরু করেছিল। কিন্তু রহস্যজনক কারণে বেশকিছু দিন যাবৎ তাও বন্ধ রয়েছে।

স্বাস্থ্য খাতে কী পরিমাণ দুর্নীতি হচ্ছে তা নির্ণয় করার তেমন কোনো সংস্থা নেই। মাঝেমধ্যে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে এর বাস্তাব অবস্থা কিছুটা প্রকাশ পায়। ২০১৪ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) জরিপে বেরিয়ে এসেছিল স্বাস্থ্য খাতে নিয়োগ, বদলি, পদায়ন ও পদোন্নতিতে উৎকোচ নেওয়ার তথ্য। এতে সর্বনিম্ন ১০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত উৎকোচের তথ্য পায় সংস্থাটির অসাধু কর্মকতা ও কর্মচারীরা। পরবর্তী অর্ধযুগে উৎকোচের পরিমাণ ৫ লাখ থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত পৌঁছেছে। দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছিল বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদন দেওয়া নিয়েও। এ ছাড়া গত বছর কারোনার শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠানটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকা দুর্নীতির চিত্র সামনে এসেছে। গ্রেপ্তারও হয়েছেন অনেকে। তবে কলকাঠি যারা নাড়ছেন তারা থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যারা কলকাঠি নাড়ছেন তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় লাগাম টানা যাচ্ছে না স্বাস্থ্য খাতের এসব ভায়াবহ দুর্নীতির। তারা মনে করেন, স্বাস্থ্য খাতের অব্যাহত দুর্নীতির দায় এড়াতে পারেন না স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

এদিকে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি প্রতিরোধে কঠোর কার্যক্রম নেই দুদকের। অভিযোগ রয়েছে, এসব দুর্নীতের পেছনে রয়েছে প্রভাশালীদের বড় সিন্ডিকেট। ফলে অদৃশ্য ইশারায় দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রমে চলে ধীরগতিতে।

দুর্নীতির অভিযোগ ও মামলাগুলি তদন্তকারী দুদকের একাধিক কর্মকর্তা সঙ্গে

আলাপ করে জানা গেছে, নজরদারির কার্যক্রম পরিচালনার ফলে কোভিড-সম্পর্কিত স্বাস্থ্যসেবাগুলোতে বিঘ্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই স্বাস্থ্য সেবা ধরে রাখতে অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রম ধীরে ধীরে চালানোর নির্দেশ রয়েছে। কে বা কারা তাদের এ নির্দেশনা দিয়েছে তা প্রকাশ করতে রাজি হননি দুদক কর্মকর্তারা। তবে প্রভাবশালী মহল দুর্নীতি দমন কমিশনকে আশ্বাস দিয়েছিল যে, সতর্কতার সঙ্গে এ খাতের কার্যক্রম তদারকি করা হবে। কারণ এ সময়ে দুদকের পদক্ষেপে চিকিৎসক ও সরঞ্জাম সরবরাহকারীরাসহ স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহকারীরা অতিরিক্ত চাপ মনে করলে অতিগুরুত্বপূর্ণ সেবা বা কাজগুলো স্থগিত হয়ে যেতে পারে।

দুদক সচিব আনোয়ার হোসেন হাওলাদার অবশ্য অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রমের ধীরগতির বিষয় বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন কারণে অনুসন্ধান ও তদন্তে বিলম্বের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। করোনা সংক্রমণের কারণে কমিশনের অনেক কর্মকর্তাই আক্রান্ত হয়েছেন। একজন পরিচালক সংক্রমণে মারাও গেছেন। তা ছাড়া কমিশনের কর্মকর্তাদের মাঠপর্যায়ে ঘুরে ঘুরে কাজ করতে হয়, যা বর্তমান পরিস্থিতে জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। লকডাউনের মধ্যে মাঠপর্যায়ে কাজও করা যাচ্ছে না। এ জন্যই অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রমে ধীরগতির প্রধান কারণ। তবে কমিশন শিগগিরই স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি দমন কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার পদক্ষেপ নেবে।

দুদকের কর্মকর্তাদের মতে, স্বাস্থ্য খাত নিয়ে কমিশনের সর্বশেষ দৃশ্যমান পদক্ষেপটি ফেব্রুয়ারিতে হয়েছিল, যখন অবৈধ সম্পদ সংগ্রহের অভিযোগে স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবদুল মালেক ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুটি মামলা করা হয়েছিল।

কর্মকর্তারা বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে চাকরির জন্য প্রার্থীদের একাংশ গত বছরের দ্বিতীয়ার্ধে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণের জন্য প্রত্যেকে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা দিয়েছিল বলে অভিযোগটি সংশ্লিষ্টরা অগ্রাহ্য করেছে। একটি জাতীয় দৈনিকে প্রতিবেদন হওয়ার পরে বিষয়টি কমিশনের অনুসন্ধানের আওতায় আসে। এরপর দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত শুরু করার পরিবর্তে কমিশন এপ্রিল মাসে এই তদন্তের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে একটি চিঠি পাঠিয়েছিল।

বিগত বছরের মার্চ মাস থেকে গণমাধ্যম ও অন্যান্য সূত্র দ্বারা কোভিড-সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ ও স্বাস্থ্য খাতে অন্যান্য অনিয়ম তদন্তে আলাদা কমিটি গঠন করে। এ এন-৯৫ মাস্ক কেলেঙ্কারি, কোভিড পরীক্ষা জালিয়াতি এবং বিভিন্ন তহবিলের আত্মসাৎ ঘটনাসহ বিভিন্ন তদন্ত কাজ শুরু করেছে যা এখানো চলমান। 

এ ছাড়া ২০২০ সালের জুলাইয়ে বিভিন্ন দুর্নীতির ঘটনায় জড়িত এবং স্বাস্থ্য খাতে অনিয়মের সাথে জড়িত ১০০ জনের একটি তালিকা তৈরি করেছিল। কারণ এগুলো করোনভাইরাস সংকটের শুরু থেকেই আলোচনায় ছিল। কমিশন নিজস্ব গোয়েন্দা ইউনিট এবং সরকারের অন্যান্য সংস্থার সন্ধানের ভিত্তিতে এই তালিকা তৈরি করেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানায়। তৎকালীন দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ একাধিক বক্তব্য দিয়ে বলেছিলেন যে কমিশন স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এর বাস্তব তেমন প্রতিফলন দেখা যায়নি।

দুদক সূত্র জানায়,  স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের আটজন উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা, ২০ জন সরকারি চিকিৎসক, পাঁচটি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ এবং স্বাস্থ্য সংস্থার ৭০০ জন মধ্যম স্তরের কর্মকর্তাদের দুর্নীতির প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছেন। তারা নিয়োগের অনিয়ম, টেন্ডার জালিয়াতি, ক্রয়সংক্রান্ত অন্যায় কাজ এবং ব্যবসায়ের সাথে অবৈধ সম্পৃক্ততা এবং অবৈধ সম্পদ আহরণসহ বিভিন্ন দুর্নীতির ঘটনায় জড়িত বলে অভিযোগ করেছেন দুদক কর্মকর্তারা।

বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, অসাধু মহলের স্বার্থে দুদকের তদন্তে এই ধরনের প্রভাব স্বাস্থ্য খাতকে নষ্ট করার কারণ হতে পারে। দুর্নীতিবাজদের এমনভাবে সুযোগ করে দেওয়ায় সমাজের জন্য উদ্বেগজনক। তাই দুর্নীতির সঙ্গে আপোষ না করে দুদকের তদন্ত দ্রুত শেষ করার পরামর্শ দেন তিনি।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত বলেছেন, ২০১৯ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আসে। দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, বদলি ও বিভিন্ন উপায়ে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমন ৪৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে দুদক। কোভিড-১৯ পরীক্ষা কেলেঙ্কারির হোতা সাহেদ করিমের রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তির দায়ে দুদক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালকসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। কিন্তু এ ভাবে দুয়েকটি মামলা করে বৃহৎ পরিসরের এ দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব না। এমন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যে অভিযান শুরু হয়েছে তাতে পরিস্থিতি বদলাবে না, যদি না পেছনের রাঘববোয়ালদের ধরা হয়। কারণ, মালেকের মতো একজন গাড়িচালকের পক্ষে শুধু দুর্নীতির মধ্যস্থতা করা সম্ভব, নিয়োগ বা পদোন্নতির কাজটি উচ্চপর্যায় থেকেই হয়। তার মতে কোন ধরনের প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারলেই দুর্নীতি প্রতিরোধে সফল হবে দুদক।

টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জাম বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। এটা অতি পুরানো ও প্রমাণিত। কিন্তু এটি প্রতিরোধে দুদকসহ সরকারের কোন পক্ষকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। ফলে দুর্নীতির শাখা প্রশাখা গজিয়ে গেছে। চোখের সামনে যাদের দেখা গেছে তারাই উঠেছে কাঠগড়ায় অথচ এত্তো এত্তো অভিযোগ এত দুর্নীতির পেছনে কারা সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। এক স্বাস্থ্যের সাবেক মহাপরিচালক ছাড়া এখনো মন্ত্রণালয় কিংবা অধিদফতরের কাউকেই কখনো আনা হয়নি অভিযুক্তের তালিকায়। ফলে গাছ কেটে নিলেও শেকড় রয়েছে রয়ে গেছে গভীরেই। এ দায় মন্ত্রী এড়াতে পারবেন না।

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সেনাল বলেন, দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত অথবা বা দুর্নীতির ক্রীড়নক হিসেবে যারা কাজ করে তাদেরকে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে। কিন্তু এই দুর্নীতি করার যে সুযোগগুলো তৈরি হচ্ছে, সেই সুযোগগুলো কেন তৈরি হচ্ছে, কিভাবে তৈরি হচ্ছে, কাদের দ্বারা তৈরি হচ্ছে সে জায়গাটা উদ্ঘাটন হওয়া উচিত। দায়িত্ব কেউ এড়াতে পারে না। মন্ত্রণালয়ের (স্বাস্থ্যমন্ত্রী) প্রধানকে  অবশ্যই এর দায় নিতে হবে। আর দুদকের কাজের গতি বাড়িয়ে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির শেকর খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে হবে। নইলে এদের অব্যাহত দুর্নীতি থামানো যাবে না।

সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক বলেন, এই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা খুবই পুরাতন। পুরাতন নিয়ম বদলে নতুনে আনতে হবে। যে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থাকেন তাকে দায়িত্ব নিতেই হবে।  স্বাস্থ্য খাতে স্বচ্ছতা আনতে পুরো ব্যবস্থাপনার পরিবর্তনের তাগিদ দেন তিনি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads