মি. রমিজ উদ্দিন চৌধুরী ফজরের নামাজ শেষে বাগানের ফুলগাছে পানি দিচ্ছেন। নিজেকে নিয়ে ভাবতে আজকাল অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রেসার বেড়ে গেছে অসহনীয় মাত্রায়। ডাক্তার এসেছিল গতকাল। বলে দিয়েছে, যে কয়দিন বেঁচে থাকবে সতর্ক হয়ে চলতে হবে। আজ বড় দৌহিত্র কামরানের কথা মনে পড়ছে। অবসরের পরে ও ছিলো একমাত্র সুখ-দুঃখের সাথী। জাহানারা সে তো একা রেখে না ফেরার দেশে চলে গেছে আজ ১২ বছর হয়ে গেলো। তিনটি সন্তান তার। বড় ছেলে আরমান চাকরি করে সচিবালয়ের উচ্চ পদে। বারিধারায় ফ্ল্যাট কিনে স্ত্রী মোনালিসা ও দুই সন্তান কামরান ও নাদিয়াকে নিয়ে বেশ উচ্চ বিলাসী জীবনযাপন করছে। ছোট ছেলে মাহিন ও তার স্ত্রী সাবিহা দুজনেই ঢাকা মেডিকেলের ডাক্তার। ধানমন্ডিতে ফ্ল্যাট নিয়ে এক ছেলে আরমানকে নিয়ে বেশ সুখেই আছে। একমাত্র মেয়ে অরিন তার জামাই সাকিল ও একমাত্র কন্যা লিনাকে নিয়ে আমেরিকায় স্থায়ী হয়ে আছে আজ প্রায় দশ বছর। চৌধুরী সাহেবের নিজের বাসা মিরপুরে। সবাই মিলে একত্রে বেশ হাসি-খুশি পরিবার ছিল। ছেলে-মেয়েরা সুবিধার অজুহাতে তারা যে যার জায়গায় স্থান করে নিয়েছে। নিঃসঙ্গ রমিজ সাহেব দুজন কাজের লোক নিয়ে নিজ বাসায় জীবনের পড়ন্ত বেলা কাটাচ্ছিল বিমর্ষতায়। পেনশনের যে টাকা, সাথে বাড়িভাড়া— সব মিলিয়ে চলে যাচ্ছে দিনগুলি।
গত বছর হঠাৎ এক সন্ধ্যায় তিন ছেলে-মেয়ে, জামাই, পুত্রবধূ একত্রে বাসায় এসে হাজির। রমিজ উদ্দিন অনেকদিন পরে সন্তানদের কাছে পেয়ে খুব উৎফুল্ল হলেন। আজ তার সব সন্তান কাছে, আনন্দে তার চোখ অশ্রুসজল। কর্মচারীদের ধমকাচ্ছে ওদের চা-নাশতা দেয়ার জন্য। যথারীতি নাশতা হাজির হলো ডাইনিং রুমে। সবাই বসে আছে, কেমন যেন নীরবতায়, অথচ রমিজ সাহেব একাই বকবক করে যাচ্ছেন। অনেক দিনের জমানো কথাগুলো বলেই চলেছেন। বাবাকে থামিয়ে দিয়ে বড় ছেলে আরমান কাচুমাচু হয়ে বলল- বাবা, তোমার সাথে একটা জরুরি কথা ছিল আমাদের। রমিজ সাহেব সম্বিৎ ফিরে পেলেন। নিজ কথা থামিয়ে অনুমতি দিলেন বড় খোকাকে কথা বলার জন্য। আরমান যা বলল, তাতে এটা দাঁড়ালো যে, রমিজ সাহেব বৃদ্ধ মানুষ, একা বাসায় থাকেন, সে নিয়ে তারা খুবই চিন্তিত। ছেলে-মেয়েরা তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাড়িটা বিক্রি করে বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবে। ওখানে সমবয়সীদের সাথে তাদের বাবা ভালো থাকবেন। চৌধুরী সাহেব নির্বাক হয়ে সন্তানদের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তিনি বুঝে গেছেন জীবনের শেষ সম্বলটুকু হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। ওরা যখন বলেছে তা-ই করবে। অসহায় রমিজ সাহেব বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইলেন। সবাই চলে যাওয়ার পর মরহুমা স্ত্রী জাহানারার ছবির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধু বোবা কান্না কেঁদেছিলেন সেদিন, আর বললেন— পারলে ওদের ক্ষমা করে দিয়ো। আমি ক্ষমা করে দিয়েছি। যেই কথা সেই কাজ। দুদিন পরেই ছোট ছেলে মাহিন বাড়ির ক্রেতা নিয়ে হাজির।
বাড়িটা আশি লাখ টাকায় বিক্রি করে দিয়ে সব টাকা তিন ভাই-বোন সমহারে ভাগ করে নিয়েছে। সেদিন থেকেই রমিজ উদ্দিন চৌধুরী প্রায় এক বছর হলো এই আশ্রমে আছেন। ব্যস্ত সন্তানরা দেখা করতে আসার সময় পায় না। তাই তিনিও ভুলে থাকার অভিনয় করে যাচ্ছেন নিজের সঙ্গে। তার মতো অনেকেই আছেন এখানে। প্রায় সবাই চোখের জল সম্বল করে বেঁচে আছেন অতীত স্মৃতিটুকু নিয়ে। আজ সবাইর কথা খুব মনে পড়ছে, তাই বুকটা বড্ড ভারী হয়ে আছে। ভুলে থাকার জন্য সাত সকালেই ফুল বাগানে পানি দেওয়ার জন্য এসেছেন তিনি। মাঝে মাঝে চোখে একটু করে জল দিয়ে ধুয়ে ফেলছেন। বাগানের কাছেই বেঞ্চিতে বসা এক বৃদ্ধা সেটা লক্ষ করছেন অনেকক্ষণ পর্যন্ত। কৌতূহলবশত বৃদ্ধা রমিজ সাহেবের কাছে এলেন বিষয়টা বোঝার জন্য। এই আশ্রমে যারা আছেন, প্রায় সবাই সময় ও সুযোগ পেলে একাকী কাঁদেন সবার অলক্ষে। সবার অতীত স্মৃতি তাদের এই কান্নার মূল কারণ। কাছে এসেই ঝাপসা চোখে অপলক দৃষ্টিতে বৃদ্ধা তাকিয়ে রইলেন। কোনো প্রশ্ন মুখ থেকে বের হলো না। রমিজ সাহেব বৃদ্ধার দিকে তাকাতেই তিনিও থ’ হয়ে গেলেন। কয়েক মিনিট পরে দুজনে একত্রেই বলে উঠলেন তুমি! বৃদ্ধার নাম আলেয়া বেগম। বিশ্ববিদ্যালয়ে একত্রে পড়াশোনা করেছেন, শুধু তা-ই নয়— দুজন খুব কাছের বন্ধু ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ বর্ষেই আলেয়ার বিয়ে হয়ে যায় আমেরিকা প্রবাসী ইঞ্জিনিয়ার রহমতুল্লাহ সাহেবের সঙ্গে। রমিজ সাহেব আলেয়াকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। কিন্তু লাজুক স্বভাবের রমিজ সেদিন আলেয়াকে তার ভালোবাসার কথা বলতে পারেনি। আলেয়াও অপেক্ষা করেছিলেন রমিজ সাহেবের মনের কথাটি শোনার জন্যে। কিন্তু দুজনের সুপ্ত প্রেম নিজেদের মধ্যেই থেকে গেলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে আলেয়া চলে গেলো আমেরিকা আর রমিজ সাহেব ঢাকার একটি কলেজে শিক্ষকতা পেশায় ঢুকে গেলেন। সেই থেকে আজ প্রায় চল্লিশ বছর পরে দুজনের দেখা হলো— এই বৃদ্ধাশ্রমের ফুল বাগানে। বাগানের ঘাসের ওপর বসে পড়লেন দুজনে। আলেয়া তার করুণ কাহিনী বলতে শুরু করলেন। দুই ছেলে তার, আমেরিকায় তাদের জন্ম। ওখানে দুজনেই ভালো জব করে। বড় ছেলে মালয়েশিয়ান কন্যা ও ছোট ছেলে এক ভারতীয় কন্যাকে বিয়ে করে আমেরিকায় স্থায়ী বসবাস করছে। স্বামী রহমতুল্লাহ আট বছর আগেই মৃত্যুবরণ করেছেন। দুই বছর হলো এই আশ্রমে এসেছেন, কারণ স্বামী অনেক আগেই দেশের সবকিছু বিক্রি করে আমেরিকায় বাড়ি তৈরি করেছেন। ছেলে ও বউদের সঙ্গে অমিলের কারণে তারা এখানে রেখে গেছে। এই দুই বছরে ছোট ছেলে তিনবার ফোনে কথা বলেছে আর বড় ছেলে একবারের জন্যও ফোন করেনি। রমিজ সাহেব সবটা শুনে এবার দন্তশূন্য মুখে মুচকি হাসলেন। আলেয়ার রাগ হলো রমিজের এরকম হাসিতে। ‘হাসলে তুমি আমার কষ্টের কথা শুনে?’ প্রশ্ন করলেন আলেয়া। উত্তরে রমিজ বললেন, ‘আজ মনে হচ্ছে আমার বয়স ২৫ আর তোমার ২৩ বছর। মনে হয় সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের তুমি আমার সামনে বসে আছো। তাই মনের অজান্তেই ভালোলাগার হাসিটা এলো। রাগ করো না প্লিজ!’ আলেয়া রমিজ সাহেবের দিকে তাকিয়ে সেই দিনের মধুমাখা পুরনো হাসিটা হেসে বললেন, ‘আমার এখন আরো অনেকদিন বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে। শুধু তোমার জন্য।’ কিছুক্ষণ দুজনেই নীরব হয়ে রইলেন। নীরবতা ভেঙে রমিজ সাহেব আলেয়াকে বলেই ফেললেন, ‘আজো ভালোবাসি তোমায়, সেই আগেরই মতো শুভ্রতায়। বাকি জীবন তুমি কি আমার সঙ্গে থাকবে?’ লাজুক আলেয়া ধীর পায়ে নিজ কক্ষের দিকে হাঁটা শুরু করলো...।