হাবিবুর রহমান, মধুপুর
বেশ খানিকটা দূর থেকেই তাঁতের খুটখাট শব্দ কানে আসে। কিছুদূর হেঁটে গেলেই চোখে পড়বে কয়েকটি তাঁত বসানো ছোট গারো তাঁতবস্ত্র তৈরির কারখানা ‘মিচিকনি জুমাং’। মধুপুর গড় এলাকার শহর থেকে ১০ কিলোমিটার উত্তরে ফুলবাগচালা ইউনিয়নের পীরগাছা মিশনারিতে গড়ে উঠেছে গারো সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী পোশাক তৈরির এই কারখানা। ১৯৯৬ সালে পীরগাছা মিশনের পাল-পুরোহিত ফাদার ইউজিন হোমরিক সিএসসি গারো সম্প্রদায়ের নারীদের বেকারত্ব দূরীকরণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য মিচিকনি জুমাং বা ‘নারীর স্বপ্নে’র যাত্রা শুরু করেন। মাটির ঘরে বসানো তাঁতের মেশিনগুলোয় কাজ করেন গারো নারীরাই। তাদের হাতের নিপুণ শৈলীতেই তৈরি হয় গারোদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক দকশাড়ি, দকমান্দি, তাঁতের তৈরি গামছা, ওড়না, রুমাল, ফতুয়াসহ বিভিন্ন পোশাক। বর্তমানে কারখানাটিতে ৬টি তাঁত রয়েছে। তবে কয়েক বছর আগেও তাঁতের সংখ্যা আরো বেশি ছিল। কাপড় তৈরির পুরো প্রক্রিয়াটিতে চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন ১১ গারো নারী শ্রমিক। আর এ কারখানায় তৈরি পোশাক পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করা হয় নিজস্ব শোরুম থেকে। এ কারখানায় তৈরি পোশাক যায় বিদেশেও।
মিতি নকরেক, লেপ্টি সিমসাং, নিউলী দিব্রা, শিখা চিসিমসহ অন্যান্য নারী শ্রমিক জানায়, গারোদের অতীত ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য কাজ করেন তারা। নিজেদের জাতিগোষ্ঠীর জন্য নিজেরা তাঁতের তৈরি কাপড় বুনতে পেরে খুব আনন্দিত। যদিও মজুরি যা পান তা দিয়ে সংসার চলে না মোটেও।
পীরগাছা নারীর স্বপ্নের পরিচালক ও ডিজাইনার ফ্রান্সিলিয়া নকরেক জানান, পরিবহন খরচ, রঙ ও সুতার দাম পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধির ফলে কাপড় তৈরি করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। উৎপাদন খরচ তোলাও কঠিন হয়ে পড়েছে এখন। গারোদের ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য এখনো তৈরি করা হচ্ছে তাঁতবস্ত্র। এভাবে উৎপাদন উপকরণের দাম বৃদ্ধি পেতে থাকলে একদিন বন্ধ হয়ে যেতে পারে গারো পল্লীর এই ক্ষুদ্র তাঁতশিল্পটি। ঐতিহ্য হারাতে পারে এ কারখানার নিজেদের তৈরি পোশাক। বেকার হয়ে যাবে তাঁতশিল্পের সঙ্গে জড়িত নারী শ্রমিকরা। এভাবে তাঁত কাপড়ের উপকরণের দাম বাড়তে থাকলে গারোদের তাঁতশিল্পে পোশাক তৈরি করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে- এমনটাই জানালেন নারীর স্বপ্নের পরিচালক ফ্রান্সিলিয়া নকরেক।
লেপ্টি সিমসাং (৪০) জানান, যে হারে উপকরণের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, সে হারে কাপড়ের দাম বাড়ালে চাহিদা পড়ে যায়। ক্রেতারা ক্রয় করতে অনীহা প্রকাশ করেন। এ বিষয়ে কারখানার শোরুমের নারী কর্মকর্তা জানান, আমাদের শোরুমের ক্রেতা আছে; কিন্তু দিন দিন দাম বাড়ার কারণে সেই সংখ্যা কমে যাচ্ছে। তিনি জানান, শোরুমে তাঁতের তৈরি টি-শার্ট ১৭০ থেকে ৩৫০ টাকা, হাফ শার্ট ৩৫০ টাকা, রুমাল ২৫ থেকে ৩০ টাকা, ওড়না ২৫০ টাকা, ফতুয়া ৪৫০ টাকা, গামছা ১৫০ টাকা, দকশাড়ি ৩৫০, মান্দি ওড়না ৩০০ টাকা। এ ছাড়া তাদের শোরুমে ছোট বাচ্চা ও বড় নারী-পুরুষের আকর্ষণীয় পোশাক পাওয়া যায়।
আচিক মিচিক সোসাইটির সভানেত্রী সুলেখা ম্রং জানান, গারো নারীদের দকশাড়ি ও দকমান্দি ছাড়া মন জুড়ায় না। তাই নারীদের কথা চিন্তা করে তাঁতশিল্প বাঁচাতে সুতা ও রঙের দাম কমানোর দাবি তার। সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসবে মান্দি পোশাক অনন্য। নিজস্ব পোশাক ছাড়া তাদের সামাজিক উৎসবগুলো জমেই না। পীরগাছা সেন্ট পলস মিশনের তাঁত কারখানার শ্রমিকরা জানান, আগের চেয়ে এখন তাঁতের কাপড় তৈরিতে খরচের পরিমাণ বেড়েছে। ফলে দামও বেশি। রঙের দাম আগের চেয়ে দ্বিগুণ। সুতার দামও প্রায় দ্বিগুণ। শ্রমিকের মজুরিও বেশি। দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে তাঁত উপকরণের দাম। ফলে দামও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
স্থানীয় গারো সম্প্রদায়ের লোকদের শুধু মধুপুর নয়- সারা দেশে তাঁতবস্ত্রে ব্যবহূত রঙ ও সুতার দাম কমানোর দাবি। এ প্রক্রিয়ায় দাম কমলে গারোদের ঐতিহ্যবাহী এসব পোশাক তৈরিতে আগ্রহ বাড়বে। গারো সম্প্রদায়ের নারীরা ধরে রাখতে পারবে তাদের পরম্পরা। সমুন্নত থাকবে তাদের অতীত ঐতিহ্য।