সদ্য যে মা সন্তান প্রসব করেছেন সে মায়ের জন্য প্রসব-পরবর্তী ৬-৮ সপ্তাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ সময়টাতে মায়ের বিশেষ যত্নের প্রয়োজন। প্রসবকালীন শারীরিক ধকল এবং রক্তক্ষরণ হওয়ার কারণে মা শারীরিকভাবে দুর্বল থাকে। এ সময় মায়ের খাওয়াদাওয়া, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং প্রসব-পরবর্তী ঝুঁকি এড়াতে প্রয়োজন যথাযথ যত্ন এবং দেখভাল। আমাদের দেশে অজ্ঞতার কারণে অধিকাংশই প্রসবের পরে মায়ের কোনো যত্ন নেয় না। সাধারণত প্রত্যেক মায়ের এবং তাদের পরিচিতদের উচিত প্রসবের পর যেন মা ঠিকমতো তার যত্ন নেয়, নাহলে অনেক ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে মায়ের। বাচ্চা হয়ে যাওয়ার পর পূর্বের মতো তার যত্ন নিতে হয়, যেন সে তার আগের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। প্রসবের পর প্রতিটি পরিবারের উচিত মায়ের দিকে ঠিকমতো খেয়াল রাখা, যেন মা তার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারে।
১) একজন প্রসূতি মায়ের যত্নের সবচেয়ে প্রথম ও প্রধান দিক হচ্ছে তার খাবার। তাই মায়ের খাবারের প্রতি বিশেষ যত্ন নিতে হবে। কারণ এই সময় মায়ের খাবারের চাহিদা বেড়ে যায়। গবেষণা মতে, এ সময় মায়ের খাবার চাহিদা স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে বৃদ্ধি পায়। প্রায় ১০০০ থেকে ১৫০০ ক্যালরি বেশি পুষ্টি প্রয়োজন পরে এ অবস্থায়। আর এ ক্যালরির উৎস হতে পারে প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজযুক্ত খাদ্য। প্রতিদিনের খাবারে প্রচুর পরিমাণে মাছ, বিশেষ করে কাঁটাযুক্ত ছোট মাছ, শাকসবজি, সালাদ, ফলমূল, ফলের রস রাখতে হবে। আর এই অতিরিক্ত খাবার মায়ের বুকের দুধ তৈরিতে সাহায্য করে। ফলে এই অতিরিক্ত খাবার মায়ের জন্য যেমন দরকার, তেমনি এটি তার শিশুর জন্যও খুব প্রয়োজন। পরিবারের সদস্যদের এ বিষয়েও খেয়াল রাখতে হবে যে, মা যেন প্রচুর পরিমাণ পানি পান করেন। ঘন ঘন পানি পান মায়ের দেহের জন্য খুব দরকার। কেননা প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া এবং কোষ্ঠকাঠিন্য এ সময়ের একটি সাধারণ সমস্যা, বেশি বেশি পানি পান করলে এই সমস্যা দূর হয়। এ সময় শরীরের বাড়তি ওজন কমানোর জন্য মায়েদের ডায়েট কন্ট্রোল করার কথা ভাবা একেবারেই ঠিক নয়।
২) প্রসূতি মায়ের পরিচর্যাকারীকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, মা যেন পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ পান। প্রসব-পরবর্তী ১-২ সপ্তাহ নিয়মিত প্রতিদিন ৮-১০ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। দুপুরে খাবারের পর অন্তত দুই ঘণ্টা ঘুম নিশ্চিত করতে হবে। তবে বিশ্রাম মানে একেবারে শুয়ে-বসে থাকা নয়। মায়ের স্বাভাবিক চলাফেরা করা উচিত, তবে ভারি কাজ এড়িয়ে চলতে হবে। স্বাভাবিক চলাফেরার মাধ্যমে অনেক জটিলতা দূর হয় মায়ের। মানসিকভাবে সে নিজে যেমন সুস্থ বোধ করে, রক্তস্রাব স্বাভাবিক হয়। রক্ত জমাট হয়ে যেসব রোগ হয়, সেই সব রোগ থেকে নিরাপদ থাকেন। আর এই সময় সব ধরনের শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম থেকে তাকে দূরে থাকতে হবে।
৩) প্রসবের পর মাকে প্রয়োজনীয় অনেক টিকা দিতে হয়। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী তা গ্রহণ করুন। যে সব মায়ের রুবেলা হওয়ার ঝুঁকি আছে, বাচ্চা হওয়ার ১৪ দিনের মধ্যে এমএমআর ভ্যাকসিন তাদের নিতে হবে। যেসব মায়ের রক্তের গ্রুপ ‘নেগেটিভ’, কিন্তু শিশুর রক্তের গ্রুপ ‘পজিটিভ’ সেসব মায়ের প্রসবের পরপরই ৭২ ঘণ্টার মধ্যে এন্টি-ডি ইনজেকশন নিতে হবে। কোনো কোনো মায়ের এ সময় টিটি ইনজেকশনের একটা ডোজ দেওয়ার তারিখ থাকে। তাদের এই টিকা দিতে হবে।
৪) জন্মের পর পরই যত দ্রুত সম্ভব শিশুকে বুকের দুধ পান করানো উচিত। মায়ের বুকের এই দুধ বাচ্চার জন্য খুবই উপকারী। তা ছাড়া বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর ফলে এই সময় মায়ের শরীর থেকে অক্সিটোসিন নিঃসৃত হয়। অক্সিটোসিন মায়ের জরায়ু এবং রক্তনালি সঙ্কুচিত করে তাকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। যার কারণে প্রসবের পর অতিরিক্ত রক্ত নিঃসৃত হয় না। তা ছাড়া বুকের দুধ খাওয়ালে স্তন ক্যানসার এবং জরায়ু ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়।
৫) অনেক সময় স্বাভাবিক ডেলিভারিতে পেরিনিয়াম কাটা ও সেলাইয়ের প্রয়োজন হয়। কাটা স্থান তাড়াতাড়ি ভালো হওয়ার জন্য স্থানটি শুকনো পরিষ্কার রাখা দরকার। প্রতিবার টয়লেটে যাওয়ার পর স্থানটি ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার ও শুকনো গজ অথবা কাপড় দিয়ে শুকাতে হবে। প্রসব-পরবর্তী রক্তস্রাবের জন্য ভালো স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করতে হবে এবং তা বার বার পরিবর্তন করতে হবে, যাতে সেলাইয়ের স্থানটি বেশিক্ষণ ভেজা না থাকে।
৬) ডেলিভারির পর মায়ের স্তনের সঠিক পরিচর্যা ও যত্নের অভাবে মায়েরা বিভিন্ন জটিলতায় ভুগে থাকেন। প্রতিদিন গোসলের সময় এবং বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর আগে স্তনের বোটা পরিষ্কার করতে হবে, যাতে দুধ বের হওয়ার ছিদ্রগুলো বন্ধ না হয়ে যায়। ডেলিভারির ২-৩ দিন পর স্তনে প্রচুর দুধ আসার ফলে স্তন শক্ত হতে পারে ও ব্যথা হতে পারে। এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় হচ্ছে বার বার বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো। প্রয়োজনে স্তনে হালকা গরম সেঁক দেওয়া যেতে পারে।
৭) স্বাভাবিক প্রসবের পর মায়ের কিছু কিছু হালকা ব্যায়াম করা প্রয়োজন। সিজারিয়ান ডেলিভারির ক্ষেত্রে ছয় মাস পর থেকে শুরু করা ভালো। যা একদিকে মায়ের ঢিলে হয়ে যাওয়া মাংসপেশি সঙ্কুচিত হয়ে পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসতে সাহায্য করে, অন্যদিকে মা কিছু কিছু রোগ হওয়া থেকে রক্ষা পান। যেমন-রক্ত জমাট বাঁধার রোগ, কোমরব্যথা, জরায়ু নেমে আসা ইত্যাদি। তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক নিয়মে ব্যায়াম করতে হবে।