সৌন্দর্য হারাচ্ছে কুয়াকাটা

কুয়াকাটা সৈকত

সংগৃহীত ছবি

ফিচার

সৌন্দর্য হারাচ্ছে কুয়াকাটা

  • প্রকাশিত ২৭ অক্টোবর, ২০১৮

মিলন কর্মকার রাজু, কুয়াকাটা থেকে

পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সৈকতে প্রকৃতির শেষ সৌন্দর্যও এখন ঝরে পড়ছে। সাগরের উত্তাল ঢেউ এক এক করে গিলে খাচ্ছে সব সৌন্দর্য। তাই দিনের আলোতে একসময় শোভা ছড়ানো সৌন্দর্যমণ্ডিত মনোমুগ্ধকর পর্যটন স্পটগুলো এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

বর্তমান কুয়াকাটা বলতে ৩-৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং কয়েকশ মিটার প্রস্থ সৈকত অবশিষ্ট। বর্ষায় মূল সৈকত দিনের আলোতে কয়েক ঘণ্টা জেগে ওঠে সাগরের ভাটায়। আর জোয়ার এলেই গোটা সৈকত তলিয়ে থাকে ৫-৭ ফুট সাগরের পানিতে। এরপরই শুরু হয় প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর স্পটগুলো ছিন্নভিন্ন করে দিতে রাক্ষুসে সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের তাণ্ডব। মুহূর্তের মধ্যেই যেন সবকিছু গিলে নিচ্ছে। এ যেন প্রকৃতি ধ্বংসের প্রতিযোগিতা। গত বর্ষা মৌসুম ধরেই ছিল সৈকত ধ্বংসের তাণ্ডব।

কুয়াকাটা সৈকতে বগুড়া থেকে ভ্রমণে আসা পর্যটক ষাটোর্ধ্ব শিক্ষক নিয়ামত খান বলেন, ঠিক স্বর্গের মতোই ছিল কুয়াকাটা। যেখানে প্রকৃতি তার সব সৌন্দর্য এখানে ঢেলে সাজিয়েছিল। কী ছিল না এখানে। ’৯০-এর দশকে প্রথম যখন তিনি কুয়াকাটা আসেন, তখন সাগরের তীরও যেন প্রকৃতিতে আচ্ছন্ন ছিল। প্রায় তিন কিলোমিটার প্রস্থ ছিল সৈকতের। আর দৈর্ঘ্য কত ছিল তা যারা না দেখেছেন বোঝানো যাবে না।

পর্যটক অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা কিরন কুমার রায় জানালেন, কুয়াকাটায় যখন প্রথম রাস পূর্ণিমা উৎসবে এসেছিলেন তখন অনেক দূর হেঁটে সাগরে স্নান করতে হতো। আর এখন তো এই রাস্তায়ও সাগরের জোয়ারের ঢেউ আঁচড়ে পড়ছে। তিনি বলেন, এখন কুয়াকাটাকে কেন্দ্র করে রাস্তাঘাট, হোটেল-মোটেল সব কিছুই হয়েছে। সময়ের পরিক্রমায় অব্যবস্থাপনা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে শুধু বিলীন হচ্ছে সৈকতকে কেন্দ্র করে আজকের কুয়াকাটা।

কুয়াকাটা বলতে ফয়েজ মিয়ার নারিকেল বাগান। যে বাগানে ছিল শত শত বিভিন্ন বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির গাছ। বাগানে দিনের আলোতেও বন্য শিয়াল, বানর ও অন্যান্য পশুর ভয়ে হাঁটতে ভয় করত। ছিল পাখির অভয়াশ্রম। কিন্তু আজ সেই বাগানটিই বিলীন হয়ে গেছে। হাতেগোনা কয়েকটি নারিকেল গাছ কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ এ বাগানটি নারিকেলকুঞ্জ নামে পরিচিত ছিল।

শৌখিন ফটোগ্রাফার আনিস তালুকদার বলেন, ২০০০ সালের কথা। তখন সবেমাত্র মাটির রাস্তায় ইট পড়েছে। এরপর পিচ ঢালাই রাস্তা হয়েছিল কুয়াকাটার চৌমাথা থেকে জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত। দীর্ঘ রাস্তা ভ্যানে করে পর্যটকরা সৈকতে আসত। এখন সাগরের ভাঙনে সেই পিচঢালা রাস্তার কয়েকশ মিটারই কেবল অবশিষ্ট রয়েছে। এখন চৌমাথায় দাঁড়িয়েই দেখা যায় সাগরের ঢেউ, শোনা যায় গর্জন। তিনি বলেন, দুই হাজার সালে তিনি কুয়াকাটা ঘুরে গেছেন আর এবার এলেন। কিন্তু কিছুই মেলাতে পারছেন না। তাঁর ভাষায় এ যেন এক ধ্বংসপুরী।

কুয়াকাটার ইতিহাস-ঐতিহ্য ক্রমশ ফিকে হয়ে যাচ্ছে। সাগরের ভাঙনে প্রাকৃতিক শোভা বাড়ানো জাতীয় উদ্যান এখন বিলীনের পথে। ব্যক্তি উদ্যোগে হয়েছে অনেক শোভাবর্ধন পার্ক, স্থাপনা। কিন্তু সরকারি উদ্যোগে সৈকতে কী হয়েছে- এ প্রশ্ন এখানকার প্রবীণদের।

কুয়াকাটার একাধিক স্থায়ী বাসিন্দা ও হোটেল মালিক বলেন, কুয়াকাটা একটি অর্থনৈতিক জোন। অথচ সেই কুয়াকাটার সৈকতের উন্নয়নে নেওয়া হচ্ছে না কোনো পদক্ষেপ। এ বছর সৈকত ভাঙার আতঙ্কে শুধু জিরো পয়েন্টে কিছু বালুভর্তি ব্যাগ ফেলে ভাঙন ঠেকানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ শীত মৌসুম শুরুর সঙ্গে সঙ্গে যদি কুয়াকাটার ভাঙন প্রতিরোধে ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে আগামী বর্ষা মৌসুমে হুমকির মুখে পড়বে মূল বেড়িবাঁধ।

স্থানীয়দের মতে, কুয়াকাটা সৈকতের উন্নয়নে কাজ করছে পর্যটন করপোরেশন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও তদারকির অভাবে সব টাকাই ভেসে গেছে সাগরে। তাই একাধিক পর্যটকের অভিমত, ‘যত কোটি টাকা খরচ করে বাঁধ মেরামত হয়েছে পুরোটাই জলে ফেলে দেওয়ার মতো অবস্থা।’

বন্ধুদের নিয়ে কুয়াকাটা ভ্রমণে এসে হতাশ বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র মো. হাসান ও তার বন্ধুরা জানায়, আধুনিক পর্যটনকেন্দ্রের মূল বৈশিষ্ট্য পরিকল্পিত সৈকত। কিন্তু কুয়াকাটা সৈকত শুধু নামে, এখন প্রায় পুরোটাই সাগরগর্ভে। অমাবস্যা-পূর্ণিমার জো ও সাগরের জোয়ার হলেই কুয়াকাটা সৈকত বিলীন হয়। যে পর্যটন কেন্দ্রে সৈকত নেই, সেখানে পর্যটকরা এসে সূর্যোদয়-সূর্যাস্তসহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করবে কীভাবে?

কুয়াকাটাকে আধুনিক পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে উপস্থাপন করতে সবার আগে সৈকতের ভাঙন প্রতিরোধ করতে হবে। তাই কুয়াকাটার উন্নয়নে একটি বিশেষজ্ঞ দল গঠন করে জরুরি ভিত্তিতে সরকারের কুয়াকাটার সৈকত রক্ষায় পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads