সম্পাদকীয়

তারুণ্য ভাবনা

সংবিধান প্রণয়নের ইতিবৃত্ত ও সমকালীন প্রসঙ্গ

  • প্রকাশিত ১০ নভেম্বর, ২০২০

আবুজার গিফারী

 

 

সংবিধান একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। প্রতিটি রাষ্ট্র তার নিজস্ব কিছু আইনকানুন, রীতিনীতি দ্বারা পরিচালিত হয়। এসব নিয়ম-নীতি হলো ওইসব রাষ্ট্রের সংবিধান। ব্যাপক অর্থে সংবিধান হলো সেইসব নিয়মকানুনের সমষ্টি যা দ্বারা সরকারের ক্ষমতা, শাসিতের অধিকার এবং শাসক ও শাসিতের মাঝে সম্পর্ক নির্ধারিত হয়। সাধারণত সংবিধান একটি দেশের লিখিত দলিল, তবে কোনো কোনো দেশ এটিকে অলিখিত দলিল হিসেবে গ্রহণ করেছে। যেসব দেশ সংবিধানকে অলিখিত দলিল হিসেবে গ্রহণ করেছে তার মধ্যে যুক্তরাজ্য, স্পেন, নিউজিল্যান্ড ও সৌদি আরব উল্লেখযোগ্য। সাধারণত যে সংবিধানের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কিত মৌলিক নীতিসমূহের অধিকাংশই লিখিত তাকে লিখিত সংবিধান বলে। অন্যদিকে যে সংবিধানের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কিত মৌলিক নীতিগুলো এক বা একাধিক দলিলে লিখিত নেই বরং নীতিগুলো বিভিন্ন আচার, প্রথা, রীতিনীতি এবং বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্তের মধ্যে বিদ্যমান তাকে অলিখিত সংবিধান বলে। মূলত অধিকাংশ দেশই সংবিধানকে লিখিত দলিল হিসেবে মর্যাদা দিয়েছে। যেসব দেশ সংবিধানকে লিখিত দলিল হিসেবে মর্যাদা দিয়েছে তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ অন্যতম।

এ দেশের তরুণ সমাজ তথা শিশু, কিশোর, যুবক আজ যে রূপসী বাংলা অবলোকন করছে, সে রূপসী বাংলা একদিনে বা অতি সহজেই অর্জিত হয়নি। লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এ দেশের মানুষ পেয়েছে সবুজ ক্ষেতের ওপর স্থাপিত রক্তবর্ণের একটি ভরাট বৃত্ত তথা লাল-সবুজের পতাকা। অধিকার নিয়ে বাঙালি জাতি বরাবরই আপসহীন। যখনই তাদের ওপর আঘাত, জুলুম, নির্যাতন এসেছে তখনই এ দেশের শিশু, কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-এর ঐতিহাসিক ছয় দফা ও এগারো দফা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন ও সর্বশেষ ৭১-এ বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রাম স্বাধীনতাযুদ্ধের মাধ্যমে প্রমাণ করেছে তারা তাদের অধিকার আদায়ে কতটা সক্ষম ও চৌকস। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা সোনার বাংলা পেয়েছি। আর এই কষ্টে অর্জিত সোনার বাংলাকে পরিচালনা করার জন্য এ দেশের মানুষ সংবিধান তৈরি করেছে। এই সংবিধান প্রণয়নের পেছনে সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। বর্তমানে প্রচলিত সংবিধানের পূর্বে অর্থাৎ ১৯৭২ সালের মূল সংবিধান প্রণয়নের পূর্বে এ দেশের মানুষ দুটি অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান পেয়েছিল। প্রথমটি হলো- স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (১০ এপ্রিল, ১৯৭১-১০ জানুয়ারি, ১৯৭২)। অন্যটি হলো- অস্থায়ী সংবিধান আদেশ (১১ জানুয়ারি, ১৯৭২-১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭২)।

প্রথমটি অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান; ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এই ঘোষণাকে অনুমোদন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনা করার জন্য ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয় এবং এই সরকার ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ (চৎড়পষধসধঃরড়হ ঙভ ওহফবঢ়বহফবহপব) জারি করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে গবসনবৎ ঙভ ঞযব ঘধঃরড়হধষ অংংবসনষু (গ.ঘ.অ) ও গবসনবৎ ঙভ ঃযব চৎড়ারহপরধষ অংংবসনষু (গ.চ.অ) নির্বাচিত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে হতেই কয়েকজন মুজিবনগরে গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকার গঠন করেন। এই অস্থায়ী সরকারের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণাকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন করা হয়। এই ঘোষণাপত্রটি ১০ এপ্রিল জারি করা হলেও এটির কার্যকারিতা দেওয়া হয় ২৬ মার্চ ১৯৭১ সাল থেকে। যদিও এটি একটি ঘোষণা ছিল, তারপরও এটিকে আমরা সংবিধান বলব, কারণ এতে রাষ্ট্রের প্রকৃতি, সরকার পদ্ধতি, সরকারের বিভাগ, সরকারের রূপরেখা পাওয়া যায়। উল্লেখ্য, ঘোষাণাপত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। একই সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়।

দ্বিতীয় অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান; বাংলাদেশ চূড়ান্তভাবে স্বাধীনতা লাভ করার পর ২২ ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকার দেশে এসে দায়িত্ব গ্রহণ করল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১০ জানুয়ারি ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন এবং ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি হিসেবে ‘অস্থায়ী শাসনতন্ত্র আদেশ’ (চৎড়ারংরড়হধষ ঈড়হংঃরঃঁঃরড়হধষ ঙৎফবৎ) জারি করেন। এর পটভূমিতে বলা হয়, মুজিবনগর সরকার কর্তৃক জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ছিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জন্য একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা এবং যে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এরূপ ঘোষণাপত্র জারি করা হয়েছিল তার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে। এছাড়া তখন এ দেশের গণমানুষ সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থা প্রবর্তনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ফলে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ‘অস্থায়ী শাসনতন্ত্র/সাংবিধানিক আদেশ’ জারি করেন। এটি ছিল দ্বিতীয় অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান। মূল সংবিধান প্রণীত হওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত এটি দেশের সংবিধানের কাজ করেছে। এতে বলা হয়; (১) বাংলাদেশে একটি মন্ত্রিসভা থাকবে এবং প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার প্রধান থাকবেন। (২) রাষ্ট্রপতি তার সকল দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর সাথে পরামর্শক্রমে পালন করবেন। (৩) ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর ও ১৯৭১ সালের ১ মার্চের মধ্যবর্তী বিভিন্ন তারিখে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের আসনগুলোতে বিজয়ী বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি গণপরিষদ (সংসদ) গঠিত হবে। এই আদেশের অধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে পদত্যাগ করেন এবং বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতি হলেন এবং তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ স্থায়ী শাসনতন্ত্র (সংবিধান) রচনার উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালের ২২ মার্চ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ’ জারি করেন। এটি ছিল বর্তমান সংবিধান রচনার প্রথম পদক্ষেপ। এই আদেশে বলা হলো- ‘(১) গ.ঘ.অ ও গ.চ.অ-তে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গণপরিষদ গঠিত হবে। (২) পরিষদ প্রজাতন্ত্রের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করবেন।’ জাতীয় সংসদের ১৬৯ জন ও প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ অর্থাৎ ৪৬৯ জনকে নিয়ে গণপরিষদ গঠিত হয়। তবে এদের মধ্যে ৬৬ জন অনুপস্থিত থাকার কারণে ৪০৩ জন নিয়েই গণপরিষদের কর্মতৎপরতা চলে।

১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে। এই অধিবেশনে ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি ‘সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটি’ গঠন করা হয়। এ কমিটির সভাপতি ছিলেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন। ১৯৭২ সালের ১৭ এপ্রিল সংবিধানের ‘খসড়া প্রণয়ন কমিটি’র প্রথম অধিবেশন বসে। অধিবেশনের সিদ্ধান্ত অনুসারে সংবিধান সম্পর্কে সর্বস্তরের মানুষের নিকট হতে ৯৮টি সুপারিশ এসেছিল যার মাত্র ১টি গ্রহণ করা হয়েছিল। খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি সংবিধানের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, আলোচনার নিমিত্তে সর্বমোট ৩০০ ঘণ্টা সময় ব্যয় করে। অতঃপর ব্যাপক আলোচানার পর কমিটি ১০ জুন সংবিধামের একটি প্রাথমিক খসড়া অনুমোদন করে। ১৯৭২ সালের ১১ অক্টোবর কমিটির সর্বশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং কমিটি কর্তৃক এ দিনে সংবিধানের পূর্ণাঙ্গ খসড়া চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। একই বছরের ১২ অক্টোবর গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন বসে। এ অধিবেশনে ড. কামাল হোসেন ‘খসড়া সংবিধান’ বিল আকারে উপস্থাপন করেন। বিলের ওপর মোট ১৬৩টি সংশোধনী প্রস্তাব আনা হয় কিন্তু মাত্র ৮৪টি সংশোধনী প্রস্তাব গৃহীত হয়। এরপর ৪ নভেম্বর গণপরিষদ কর্তৃক সর্বসম্মতিক্রমে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থায়ী সংবিধান বিধিবদ্ধ ও গৃহীত হয়। তারপর ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে সম্পূর্ণভাবে বর্তমান সংবিধান কার্যকর হয়। গণপরিষদে সংবিধানের ওপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘এই সংবিধান শহীদের রক্তে লিখিত, এ সংবিধান সমগ্র জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকবে।’

সংবিধান কার্যকরের প্রায় ৫০ বছর হতে চলেছে। দীর্ঘ অর্ধ-শতাব্দীতে যদি আমরা প্রাপ্তি খুঁজতে চেষ্টা করি তবে সফলতা ও প্রাপ্তি দুটোই ঢের পাব। তবে এই সফলতার পেছনেও কিছু ব্যর্থতা দৃশ্যমান। বাংলাদেশের সংবিধান ১৭ বার সংশোধিত হয়েছে। প্রস্তাবনা থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, মৌলিক অধিকার, আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ, তফসিলে স্থান পেয়েছে রাষ্ট্র সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার সুনিপুণ মূলমন্ত্র।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads