মতামত

মুসলিম বিশ্বের নতুন অধিপতি

  • প্রকাশিত ১০ নভেম্বর, ২০২০

মো. তাসনিম হাসান আবির

 

 

 

বর্তমান বিশ্বের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। ক্রমশ ক্ষমতার পরিবর্তন হচ্ছে। মার্কিন মুলুকের একক আধিপত্য এখন আর নেই। রাশিয়া, চীন, তুরস্ক, ইরান এক নতুন এক সমীকরণ যোগ করেছে। বিশ্বে তাদের আধিপত্য এখন বাড়ছে। আর মুসলিম বিশ্বে একক সুলতান হিসেবে অধিষ্ঠিত হচ্ছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। একজন লেবু বিক্রেতা থেকে তুরস্কের সর্বোচ্চ পর্যায় পেরিয়ে তিনি এখন বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি। যার নেতৃত্বে তুরস্ক পরাশক্তি হওয়ার পথে। তার এই যাত্রাটা অবশ্য সহজ ছিল না। প্রথমে ইস্তাম্বুলের মেয়র, এরপর তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এবং তারপর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট। ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে তিনি তুরস্ককে সামরিক দিক থেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন। কারণ তার স্বপ্নটা ছিল অনেক বৃহৎ। তিনি তুরস্ককে বর্ডারের বাইরে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। খুব অল্প সময়েই তিনি কোটি কোটি মুসলিমের হূদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। তার মানবিক গুণাবলি আকর্ষণ করেছে বেশিরভাগ মুসলিমকে। তাই তো তারা এখন এরদোয়ানকে তাদের অধিপতির স্বীকৃতি দিয়েছেন। তার এই নতুন অধিপতি হওয়ার পেছনে অবশ্য অনেকগুলো কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- এমন অনেক সাহসী কাজ করেছেন, যেটা মধ্যপ্রাচ্যের অনেক মুসলিম নেতা নামক স্বৈরাচারী রাজারা করতে পারেননি।

ফিলিস্তিনকে অকুণ্ঠভাবে সমর্থন করে যাচ্ছেন। অত্যাচারিত ফিলিস্তিনের মুখের ভাষায় তিনি কথা বলছেন, যেটা মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরশাসকরা করছেন না। বরং তারা ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের মতো গুরুতর বিশ্বাসঘাতকতা করছেন। ইসরাইলের সাথে বন্ধুত্ব করে স্বৈরশাসকরা ফিলিস্তিনের পিঠে ছুরি মারছেন। কিন্তু তুর্কি সুলতান এমন না। তিনি সরাসরি ইসরাইলের বিরোধিতা করে ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ভারতের কাশ্মীরিদের অধিকার আদায়েও তিনি সোচ্চার। তিনি বরাবর ভারতের কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করেছেন। ভারত কর্তৃক নির্যাতিত কাশ্মীরিদের অধিকার আদায়ের জন্য বিশ্বের সম্মুখে কথা বলেছেন। ভারতের বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি আপসহীনভাবে কাশ্মীরের পাশে আছেন। ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার কাশ্মীরিদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ভারত সরকারকে আহ্বান জানিয়েছেন। রোহিঙ্গাদের জন্য তিনি মিয়ানমারের নিন্দা জানিয়েছেন। জাতিসংঘসহ বিশ্ব প্ল্যাটফর্মে তিনি রোহিঙ্গাদের হয়ে কথা বলেছেন। তার স্ত্রী এমিলি এরদোয়ানকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছিলেন রোহিঙ্গাদের সরাসরি দেখার জন্য। রোহিঙ্গাদের জন্য প্রতিনিয়ত তিনি মানবিক সহায়তা প্রদান করে যাচ্ছেন।

বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তিনি ইরানের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। ইরানের সাথে মিলে নতুন এক সমীকরণ তৈরি করেছেন, যেটা মধ্যপ্রাচ্যের শান্তির জন্য অনেক আশাব্যঞ্জক হয়ে উঠেছে। ইরানও তুরস্কের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রেখেছে। তুরস্কে যখন ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান হয় তখন রাশিয়া এবং ইরানই প্রথম গোয়েন্দা তথ্যের আলোকে অভ্যুত্থানের কথা তুর্কি প্রেসিডেন্টকে বলেন। সম্প্রতি ফ্রান্স যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে হজরত মোহাম্মদ (সা.)-কে ব্যঙ্গচিত্রের মাধ্যমে অবমাননা করে তখন এরদোয়ান প্রতিবাদ করেন। তিনি ফ্রান্সের পণ্য বয়কটের আহ্বান জানান। রাষ্ট্রীয়ভাবে ফ্রান্সের নিন্দা জানান, যেটা অন্য কোনো মুসলিম দেশ করেনি।

তা ছাড়া মুসলিম বিশ্বের যে কোনো সংকটে তুরস্ক সর্বপ্রথম পাশে দাঁড়ায়। তার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর সব সময় মুসলিমদের পক্ষে। সৌদিসহ উপসাগরীয় দেশগুলো যখন কাতারকে অবৈধভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তখন তুরস্ক নিয়মিত কাতারকে সহায়তা করেছে। খাদ্য, ঔষধসহ প্রয়োজনীয় জিনিস বিমানে করে পাঠিয়েছে। সম্প্রতি আজারবাইজান, আর্মেনিয়া যুদ্ধে তুরস্ক তার উপস্থিতি সারা বিশ্বকে দেখিয়েছে। আজারবাইজানের পক্ষ নিয়ে সরাসরি এই যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে এবং আর্মেনিয়া নিজেই স্বীকার করেছে এতে তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। নিজের দেশের ঐক্য ধরে রাখতেও তিনি সর্বদা সচেষ্ট। কুর্দিদের কিছু বিচ্ছিন্নবাদী তুরস্ক থেকে বের হয়ে ইরাক, সিরিয়ার কুর্দিদের নিয়ে আলাদা একটা রাষ্ট্র গঠন করতে চায়। তুরস্ক এর বিরুদ্ধেও খুব সুন্দরভাবে পরিস্থিতি সামলাচ্ছে। তার সীমানার বাইরে গিয়ে সিরিয়া-তুরস্ক বর্ডার এলাকায় বৃহৎ জায়গাজুড়ে নিজের আধিপত্য বিস্তার করেছে যাতে সেখানে তুরস্কের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র না হয়।

এশিয়া-ইউরোপ দুই মহাদেশে অবস্থিত তুরস্ক তার হারানো গৌরব ফিতে পেতে মরিয়া। কারণ এক সময় পৃথিবী শাসন করত তুরস্কের উসমানীয় সাম্রাজ্য। তখনকার সময়কে ইসলামের স্বর্ণযুগ বলা হতো। কিন্তু কালের গর্ভে সেই ঐতিহ্য হারিয়ে গিয়ে কামাল আতাতুর্ক তুরস্ককে একটি আধুনিক, প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল, যেটা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের হাতের পুতুল। কিন্তু এরদোয়ান দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সেই অপবাদ ঘুচে গেছে। ন্যাটো সদস্য হয়েও সে মুসলিমদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট। রাষ্ট্রীয়ভাবেও তিনি তুরস্ককে ইসলামী ভাবধারায় আনার চেষ্টা করছেন এবং ইতোমধ্যে অনেকটাই সফল তিনি। তুরস্কের বিভিন্ন ঐতিহাসিক মসজিদ যেগুলো আতাতুর্কের সময় জাদুঘরে পরিণত হয়েছিল, সেগুলো আস্তে আস্তে এরদোয়ান আবারো মসজিদের জন্য খুলে দিচ্ছেন। আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরকরণ যার উদাহরণ। তার ব্যক্তিত্ব আকৃষ্ট করে বেশিরভাগ মুসলিমকে। বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় এক নাম এরদোয়ান। আজকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার প্রচুর ভক্ত দেখা যাচ্ছে। কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে ইফতারি করছেন, তো কখনো নিজে কোরআন তেলাওয়াত করছেন। কখনো প্রতিবন্ধী শিশুকে স্নেহে জড়িয়ে ধরছেন, আবার কখনো প্রবীণদের ভালোবাসায় ভরে দিচ্ছেন। তুরস্কে তার জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। যার উদাহরণ, সামরিক বাহিনীর কিছু বিপথগামী সৈন্য কর্তৃক অভ্যুত্থান চেষ্টাকে জনগণের রাস্তায় নেমে প্রতিহত করা। তারা সামরিক ট্যাংকের সামনে শুয়ে পড়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। জনগণ তাদের প্রিয় নেতা এরদোয়ানের বিরুদ্ধের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করে দিয়েছেন। তারপর থেকে এরদোয়ান আরো শক্তিশালী হয়ে উঠছেন। তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা তুরস্ককে সীমানার বাইরে পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত করেছে।

এরদোয়ান একজন হাফেজও বটে। প্রায়ই তাকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কোরআন পাঠ ও মোনাজাত করতে দেখা যায়। যে মানুষটি একটু বেশি টাকার জন্য রাস্তায় লেবু বিক্রি করতেন, তিনি আজ স্বীয় যোগ্যতায় বিশ্বনেতায় পরিণত। মুসলিম বিশ্বের নতুন সুলতান যেন নির্যাতিত মুসলিমদের পাশে সব সময় দাঁড়ায় এবং তার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর যেন ইসলামের শত্রুদের হূদয়ে বজ্রাঘাত হানতে পারে সে প্রত্যাশাই এখন সকলের।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads