মাহমুদুল হক বাবুল, উখিয়া (কক্সবাজার)
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের বেপরোয়া আচরণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে তারা উখিয়া ও টেকনাফের ৩০টি ক্যাম্পে অবস্থান করছে। সরকার ও বিভিন্ন দাতা সংস্থার ত্রাণসামগ্রীসহ সব ধরনের মানবিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করলেও তাদের আচরণের পরিবর্তন হয়নি। তাদের বেপরোয়া জীবন-যাপন, অনৈতিক কর্মকাণ্ড আর অস্বাভাবিক আচরণে স্থানীয়রা নাখোশ। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত সংলগ্ন গ্রামবাসীর অভিযোগ, তারা যে কোনো বিষয়ে অনৈতিক আবদার ও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করতে গিয়ে গ্রামবাসীর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে আশঙ্কা করে স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণিপেশার নেতারা বিষয়টিকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে আরো সম্প্রসারণ করার দাবি জানিয়েছেন।
উখিয়ার স্থানীয় পল্লী চিকিৎসক মো. ইসমাঈল জানান, আমি দীর্ঘদিন চিকিৎসা পেশায় জড়িত। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর রোহিঙ্গারা উখিয়ায় আশ্রয় নেওয়ায় মধুরছড়ায় একটি ফার্মেসি দিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছি। কিন্তু এখন শত শত রোহিঙ্গা চিকিৎসক ওষুধের দোকান খুলে বসেছে। তারা এখন আমাদের মারধরও করতে চাইছে। ফলে এখানে আমি আর থাকতে পারছি না। কয়েকদিন ধরে রোহিঙ্গারা আমাকে মালামাল নিয়ে মধুরছড়া ক্যাম্প ত্যাগ করতে বলছে। অন্যথায় তাকে অপহরণ করার হুমকি দিচ্ছে।
লেদা বাজারের ব্যবসায়ী নাছির আলম বলেন, রোহিঙ্গারা বাজারে বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় ব্যবসা করে। তারা ক্যাম্প থেকে বিভিন্ন জিনিসপত্র এনে বিক্রি করে। মাঝে মধ্যে ব্যবসায়িক কারণে কথা কাটাকাটি হলে রোহিঙ্গারা দল-বল নিয়ে এসে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মারধর করে। স্থানীয়রা কারো কাছে বিচারও দিতে পারে না। নীরবে মার খেয়ে বাড়িতে চলে যেতে হয়।
মধুরছড়া গ্রামের কৃষক আবুল শামা জানান, আমার এক একর পাহাড়ি জমিতে আম, লিচু, কলা, পেয়ারা, লেবুসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফলজ গাছের বাগান করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলাম। রোহিঙ্গারা মধুরছড়া এলাকায় আশ্রয় নেওয়ায় তার বাগানটি অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। এমনকি বাগানের জায়গাও রোহিঙ্গারা জবর দখলের অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
লম্বাবিল এলাকার স্থানীয় চা দোকানদার কাশেম আলী বলেন, রোহিঙ্গারা প্রতিনিয়ত ক্যাম্প থেকে বের হয়ে নানা ঝামেলায় জড়াচ্ছে, এমনকি দোকানে বাকি খেয়েও টাকা দিতে চাইছে না। এখন সমস্যা হচ্ছে, তাদের গায়ে হাত দিলে উল্টো পুলিশ আমাদের হয়রানি করে।
সরেজমিনে মধুরছড়া, লম্বাশিয়া ক্যাম্প ঘুরে সাধারণ রোহিঙ্গা ও মাঝি নামের তাদের এক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবিকতা দেখিয়ে আমাদের আশ্রয় দিয়ে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এবং আমরা এখনো যে বেঁচে থাকতে পারছি, এর জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। আমরা তার এই মানবিকতাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে চাই না। রোহিঙ্গা মাঝি মো. শফি জানান, সেদিন যদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের আশ্রয় না দিতেন, তাহলে বেঁচে থাকা আর না থাকা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। তাই রোহিঙ্গারা এমন কোনো কাজ করবে না, যাতে স্থানীয়রা তাদের প্রতি আস্থা হারায়। কুতুপালং ক্যাম্পের মো. নূর (সাবেক বস্তি ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতি) জানান, তারা একসঙ্গে প্রায় ৫ হাজার রোহিঙ্গা নাফ নদী পার হয়ে ২০১২ সালে কুতুপালং বনভূমিতে আশ্রয় নিয়েছিল। সে সময় সরকারিভাবে তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করা হয়নি। তবে গ্রামবাসীর সহযোগিতায় তারা নিজ দেশের মতো চলাফেরা ও বসবাস করতে পারছে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী জানান, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ও রাখাইন জনগোষ্ঠীর অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, খুন, গুম, ধর্ষণ ও ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে অস্তিত্বহীন করায় রোহিঙ্গারা এখানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। সরকার এসব রোহিঙ্গাকে পূর্ণ নাগরিকত্ব দিয়ে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে বিশ্ববাসীর সহযোগিতাসহ কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। রোহিঙ্গারা যে কোনো সময় স্বদেশে ফিরে যেতে পারে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গারা যাতে স্থানীয়দের সঙ্গে কোনো সংঘাতে না জড়ায় বা কোনো সমস্যা না হয়, সেদিকে প্রশাসনের কড়া নজরদারি থাকতে হবে।