রেজাউল করিম বকুল, শ্রীবরদী (শেরপুর)
মেহেদির রঙ না মুছতেই ম্লান হয়ে যায় হাসির মুখ। দরিদ্রতায় নিষ্পেষিত হয় এই নববধূ। মেঘে ঢাকা পড়ে তার স্বপ্ন। দুই বেলা খাবার জোটানো তার স্বামীর পক্ষে ছিল কষ্টসাধ্য। এ নিয়ে দেখা দেয় দাম্পত্য কলহ। বাধ্য হয়ে হাসিও নামে স্বামীর পেশায়। শুরু হয় হাসির জীবনযুদ্ধ। স্বামী হাফেজ উদ্দিন। সমানতালে তার সঙ্গে বাঁশের নানা সামগ্রী বুননে ব্যস্ত। হাসির আত্মবিশ্বাস আর নিরলস প্রচেষ্টায় মাত্র তিন-চার বছরে বদলে যায় সংসারের চিত্র। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মুখ দেখলেও হাসি ভোলেনি অতীতের কষ্টার্জিত স্মৃতিগুলো। তিনি বলেন, এখন কষ্ট করতে হয় না। দুজনে দিনে ২-৩টি বুরোং বুনতে পারি। আয় হয় ৫-৬শ টাকা। ইচ্ছে ছিল পড়ালেখা করার; কিন্তু দরিদ্রতা কেড়েছে সে স্বপ্ন। পারিবারিক জীবনে এ দম্পতির দুই মেয়ে- হাসিনা ও হাদিয়া। দুজনকেই পড়াশোনা করিয়ে নিজের আশা পূরণ করতে চায় হাসি। তার স্বামী হাফেজ উদ্দিন বলেন, ‘মেলা ধকল গেছে। তবে এ কাজ করে আধা একর আবাদি জমি কিনছি। ফসল পাই। অহন মাসে দুই তিন হাজার ট্যাহা জমা অয়।’ হাসির সফলতা দেখে প্রতিবেশী গৃহবধূরাও বসে নেই। কেউবা বাঁশ চেরাই করে শলা তুলছেন। কেউবা শলা দিয়ে কুলা, চালুন, মাছ ধরার বুরোং, পাইরে, খালইসহ বিভিন্ন সামগ্রী তৈরিতে ব্যস্ত। সবাই পরম নিষ্ঠার সঙ্গে কাজটি করছেন। বর্ষায় বেড়ে যায় কাজের চাহিদা। তখন মাছ ধরার বুরোং আর পাইরে তৈরিতেই ব্যস্ত সময় কাটান তারা। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মহাজনরা এসে তাদের তৈরি বাঁশ শিল্পের সামগ্রী নিয়ে যায়।
বাঁশ শিল্পের গ্রাম হিসেবে পরিচিত শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার গোসাইপুর ইউনিয়নের চাউলিয়া ও দহেড়পাড়। এই গ্রামের হাসির মতো প্রায় সবাই স্বাবলম্বী। এজন্য গ্রাম দুটি বাঁশ শিল্পে জেলা শহর পর্যন্ত পরিচিত। গ্রামবাসীদের মতে, প্রতিদিন কমপক্ষে অর্ধলাখ টাকার বাঁশের সামগ্রী বিক্রি হয় এ দুই গ্রামে। চাউলিয়ার বয়োবৃদ্ধ ছাবের আলী বলেন, ‘বাপদাদার আমল থাইক্যা বাঁশের কাজ করি। পূর্বপুরুষরা কীভাবে এ পেশায় নেমেছে, তা স্পষ্ট ধারণা নেই। তবে একশ বছর আগেও এ পেশায় তাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন বলে জানান তার মতো অনেকেই। সম্প্রতি সরেজমিনে গেলে দারিদ্র্যকে জয় করা গৃহবধূ, গ্রামবাসী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার লোকজনের সঙ্গে কথা বললে উঠে আসে এমন তথ্য।
জানা যায়, এ দুটি গ্রামে প্রায় দুই হাজার পরিবারের বসবাস। শুধু বাঁশের সামগ্রী তৈরি করে সংসার চালায়। এসব পণ্যের চাহিদা বাড়ে বছরের বৈশাখ থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত। তখন গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করেন তারা। এসব বুননে পুরুষের অপেক্ষা মেয়েরাই বেশি পারদর্শী। বাঁশ শিল্পের সঙ্গে জড়িত স্থানীয় কারিগর চাউলিয়ার হাফেজ উদ্দিন, গৃহবধূ মাজেদা খাতুন, দহেড়পাড় গ্রামের জোবেদা বেগম ও ছালেহাসহ অনেকের কাছ থেকে জানা যায়, প্রতি বছর পণ্য বিক্রি করে প্রত্যেকে দেড়-দুই লাখ টাকা লাভ করেন। তাদের তৈরি পণ্য গ্রাম থেকেই পাইকারি বিক্রি হয়। এখন সবার ঘরে সফলতার আলো।
এ ব্যাপারে উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা ফাতেমাতুজ্জহুরা বলেন, আমি গ্রাম দুটি ঘুরে দেখেছি। তাদের মতো যদি প্রতিটি ঘরের গৃহবধূরা এসব হস্তশিল্প তৈরি করতেন, তাহলে শ্রীবরদী হতো দেশের অন্যতম উপজেলা। তিনি জানান, বাঁশ শিল্পের কাজ করে অনেকেই স্বাবলম্বী। সরকারি-বেসরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আরো আয় করা সম্ভব বলে মনে করেন এই কর্মকর্তাসহ সচেতন মানুষ।