চট্টগ্রামকে বলা হয় বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ। বলা হয় দ্বিতীয় রাজধানীও। ৫ হাজার ২৮৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের জেলাটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলা হিসেবেও পরিচিত। এ জেলায় রয়েছে দেশের সব প্রান্তের মানুষ। বসবাসরত মানুষের সংখ্যাও ঢাকার তুলনায় খুব যে কম তা কিন্তু নয়। ২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ জেলার মোট জনসংখ্যা ৭৯ লাখ ১৩ হাজার ৩৬৫ জন। ২০১২ সালের ১৬ জুলাই চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের হিসাবে, চট্টগ্রামের মোট জনসংখ্যা হচ্ছে ৮০ লাখ ২১ হাজার ৭৭৮ জন। অর্থাৎ ধরে নিতে পারি, চট্টগ্রামে বছরে এক লাখ জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে হিসাবে বর্তমানে চট্টগ্রামের জনসংখ্যা ৮৭ লাখের কাছাকাছি থাকবে। যাহোক, আমরা জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আর কী কী বৃদ্ধি পাচ্ছে সেটাও লক্ষ করি।
৮৭ লাখ মানুষের এ জেলা আজ অনেকটাই সজ্জিত। বলা যায়, চট্টগ্রামের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হচ্ছে বর্তমানে। এতগুলো মানুষের চাহিদা পূরণ করা এবং তাদের জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা সহজ কথা নয়। কিন্তু বর্তমান সরকার এ কঠিন কাজটিও অনেক সহজভাবে করছে। এ জন্য বর্তমান সরকারকে ধন্যবাদ দেওয়া চট্টগ্রামের মানুষের দায়িত্ব।
আমরা সবসময় কোথায় কী সমস্যা এবং কোথায় কী প্রয়োজন, সেটাই ভালোভাবে তুলে ধরি। এটাকে আমি খারাপ বলছি না; কিন্তু আমাদের উন্নয়ন এবং এগিয়ে যাওয়ার চিত্রগুলোকেও ভালোভাবে তুলে ধরতে হবে। আমি সমস্যা হলে চিৎকার করে বিশ্ববাসীকে বলি, আর সমস্যার সমাধান হলে বোবার মতো থাকি। তাহলে তো আর সেটাকে ভালো বলা যায় না। বলতে যদি হয়, সবকিছুই বলব।
যদি চট্টগ্রামের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নের কথা বলি, তাহলে প্রথমেই ২০১১ সালে ৪৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত শাহ আমানত সেতুর (কর্ণফুলী নতুর ব্রিজ) কথা বলতে হবে, যে সেতু না থাকলে দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষ পড়ত অসহনীয় দুর্ভোগে। এই সেতুর মাধ্যমে যাতায়াত সুবিধা পেয়েছে ওই অঞ্চলের মানুষ। এটা চট্টগ্রামের জন্য বলা যায় এক আশীর্বাদ। এরপর আখতারুজ্জামান চৌধুরী ফ্লাইওভারের কথা বলা যায়। ২০১৪ সালের ১২ নভেম্বর নগরীর মুরাদপুর থেকে লালখানবাজার পর্যন্ত চার লেনের আখতারুজ্জামান চৌধুরী ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ৬৯৮ কোটি টাকা ব্যয়ে করা এই ফ্লাইওভার যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। যার মাধ্যমে চট্টগ্রামের মানুষ দ্রুত যাতায়াত করতে পারছে। এরপর বলতে হবে আগ্রাবাদ জাম্বুরি পার্কের কথা। সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামের মানুষের কাছে এটিই বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ৮.৫৫ একর জায়গাজুড়ে নির্মিত এ পার্কটি গণপূর্ত অধিদফতর চট্টগ্রামের মানুষের জন্য উপহার দিয়েছে। এরপর আমরা দেখতে পারি বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার। এটি নির্মাণ করা হয়েছে ২০১৩ সালে। বর্তমানে এ ফ্লাইওভারের মাধ্যমে অনেকখানি যানজট নিরসন হয়েছে।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম নগরী থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে মিরসরাই ইকোনমিক জোন। এটি শুধু বাংলাদেশ নয়, উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় ইকোনমিক জোন হবে মিরসরাই ইকোনমিক জোন। এ জোনে ১ হাজার ২২২টি শিল্পপ্লট তৈরি করা হবে। এসব প্লটে বিভিন্ন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠলে কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষের নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, যা সত্যি চট্টগ্রামের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের একটি বড় উদাহরণ।
আমরা সবাই পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের কথা জানি। এটা চট্টগ্রামের মানুষের কাছে দারুণ বিষয়। কিন্তু বর্তমান সরকার সেটার সঙ্গে আমাদের যোগ করে দিয়েছে নেভাল সমুদ্রসৈকত। বন্দর নগরী চট্টগ্রাম থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত বাংলাদেশ নেভাল একাডেমি। নৌবাহিনীর শিক্ষানবিস ক্যাডেটদের শিক্ষাদান ও মৌলিক প্রশিক্ষণের জন্য প্রতিষ্ঠিত একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান। সুবজে ঢাকা এই একাডেমির ও পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে নেভাল সমুদ্রসৈকত। বাংলার অপরূপ সৌন্দর্য যেন আছড়ে পড়ছে এখানে। সত্যি কি অপরূপ!
এ পর্যন্ত যা বলেছি সব চোখের সামনেই দেখা। এসব উন্নয়নের সাক্ষী আমরাই। এবার আরো বড় কিছুর সাক্ষী হতে যাচ্ছে চট্টগ্রামবাসী, যা তাদের জন্য অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে সবসময়। আর সেটা হচ্ছে কর্ণফুলীর তলদেশে স্বপ্নের টানেল। কর্ণফুলী নদীর নেভাল একাডেমি থেকে আনোয়ারা প্রান্ত পর্যন্ত দৈর্ঘ্য সোয়া তিন কিলোমিটার। এখানেই নদীর তলদেশের ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীর দিয়ে চলবে সারি সারি গাড়ি। সে লক্ষ্যেই নির্মাণ করা হচ্ছে বাংলাদেশ তথা সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে প্রথম টানেল সড়ক, যার কর্মযজ্ঞ ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। তবে প্রকল্প শুরু করতে দেরি হওয়ায় নির্মাণের মেয়াদকাল ২০২২ সাল নির্ধারণ করা হয়েছে।
টানেল নির্মাণ সমীক্ষায় বলা হয়েছে, কর্ণফুলী টানেলের মাধ্যমে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ চালু হবে। ঢাকা থেকে পণ্যবাহী গাড়ি সরাসরি কক্সবাজার যেতে সময় ও দূরত্ব দুটিই কমবে। যানজট ছাড়াই নিরবচ্ছিন্নভাবে যাওয়া যাবে গন্তব্যে। মহেশখালী থেকে একটি গাড়ি টানেল দিয়ে সরাসরি ঢাকায় পৌঁছতে পারবে চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ না করেই। কর্ণফুলীর ওপার থেকে একজন ব্যবসায়ী ১০ মিনিটেই চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ও চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছতে পারবেন।
বর্তমান সরকারের কাছে প্রত্যাশা রইল চট্টগ্রামের উন্নয়ন যেন আবার থমকে না যায়। কারণ বাংলাদেশের প্রাণ এ চট্টগ্রাম। তাই এ জেলার প্রতি বিশেষ নজর রাখতে হবে সরকারকে। উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যগুলোকে রক্ষা করতে হবে। কর্ণফুলী নদীর পাশে অবৈধ স্থাপনা যেভাবে উচ্ছেদ চলছে, সেভাবে পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে। চট্টগ্রামের গ্রাম ভাবটা থাকতে হবে। পরিশেষে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের একটি ছড়ার ক’টি লাইন বলতে চাই :
তোমার সংকল্পস্রোতে ভেসে যাবে লোহার গরাদ
এ তোমার নিশ্চিত বিশ্বাস।
তোমার প্রতিজ্ঞা তাই আমার প্রতিজ্ঞা, চট্টগ্রাম!
আমার হূৎপিণ্ডে আজ তারি লাল স্বাক্ষর দিলাম।
লেখক : নিবন্ধকার